ঠিক কী হয়েছিল অভিষেকের চোখে? সাত ঘণ্টার অপারেশনের নেপথ্যে লুকিয়ে যে সত্যি

Abhishek Banerjee: কী হলো অভিষেকের? কেন সাত ঘণ্টা লাগল তাঁর চোখের অস্ত্রোপচার করতে? কেন উদ্বেগে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও?

মানিক ভট্টাচার্য গ্রেফতার। টেট-এসএসসি নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির পারদ ফের চড়ছে রাজ্যে। রাজনৈতিক উত্তাপে ব্যতিব্যস্ত হয়েছে তৃণমূল। কিন্তু দেখা নেই রাজ্যের যুবরাজের! তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক গিয়েছেন আমেরিকায়। নাহ্, রাহুল গান্ধীর মতো বিদেশ ভ্রমণে নয়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আমেরিকায় গিয়েছেন চোখের চিকিৎসার জন্য। সেখানেই অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর চোখের। রক্তচক্ষুর ছবি দিয়ে একথা জানিয়েছেন অভিষেক-তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। শুরু হয়েছে বিতর্কও। রাজনৈতিক নেতার চিকিৎসা নিয়েও শুরু হয়েছে রাজনীতি। বাংলায় এত সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল থাকতেও অভিষেক কেন বিদেশে! কটাক্ষ করেছে বিজেপি।

কিন্তু কী হলো অভিষেকের? কেন সাত ঘণ্টা লাগল তাঁর চোখের অস্ত্রোপচার করতে? কেন উদ্বেগে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও?

এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে কয়েক বছর আগে।

আরও পড়ুন: মমতার নীল-সাদা টিমে প্রথম একাদশে কারা? রিজার্ভ বেঞ্চে ঠাঁই যাঁদের

অভিষেকের আঘাত-ইতিহাস

২০১৬ সাল। ১৮ অক্টোবর। মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে সভা সেরে ফিরছিলেন তৃণমূল যুবকংগ্রেসের নেতা, ডায়মন্ডহারবারের তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। হঠাৎ ছন্দপতন। মমতার আন্দোলন-ভূমি সিঙ্গুরের কাছে, দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের মাঝেই উল্টে গেল অভিষেকের গাড়ি। কনভয়ের অন্য গাড়ির তেমন একটা ক্ষতি না হলেও যুবরাজের নিজের গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগল একটি দুধের গাড়িতে। অত্যাধুনিক ব্যবস্থা আর এয়ার ব্যাগের জন্য সে-যাত্রায় কোনওক্রমে প্রাণে বাঁচলেন অভিষেক। কিন্তু অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার হওয়া মমতার ভাইপোর শারীরিক আঘাত ছিল মারাত্মক। তড়িঘড়ি আনা হল কলকাতায়। ভর্তি করা হলো দক্ষিণ কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে।

চিকিৎসকরা জানালেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অভিষেকের বাম চোখ। ভেঙে গিয়েছে ওই চোখের নিচের হাড়। একাধিক দিনের চিকিৎসার পর ২৫ অক্টোবর নাগাদ প্রথম বড় অপারেশন করা হয় তাঁর চোখের। এরপর বহুদিন বিশ্রামে থাকতে হয় তৃণমূল সাংসদকে।

২০১৬। নভেম্বর। আর কলকাতা শুধু নয়, এবার চোখের চিকিৎসায় অভিষেক পাড়ি দিলেন হায়দরাবাদ। এলভি প্রসাদ চক্ষু হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করালেন তিনি।

এরপর ২০১৬ থেকে ২০২১ বহুবার হায়দরাবাদ যেতে হয়েছে তাঁকে। ধীরে ধীরে সেরে উঠেছে চোখ। কিন্তু বাম চোখের দৃষ্টি নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল তাঁর। বারবার চশমা বদলও নাকি করতে হয় তৃণমূল নেতা অভিষেককে।

২০২০। জানুয়ারি। নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে দলের এক কর্মিসভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, অভিষেকের চোখে ইতিমধ্যেই ৬ বার অপারেশন হয়েছে!

২০২২। গরু-কয়লা পাচার মামলায় অভিযুক্ত বিনয় মিশ্র আবহে অভিষেককে দুবাই যেতে হয় সেই চোখের চিকিৎসায়। প্রশ্ন ওঠে। তাঁর বিদেশ যাওয়া আটকাতে আদালতের দ্বারস্থ হয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। আদালতের নির্দেশ নিয়েই দুবাই যান অভিষেক। একাধিকবার ওই যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল চোখের চিকিৎসা।

এবার আমেরিকা। জন হপকিন্স হাসপাতালের চক্ষু সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলছে তাঁর। প্রায় ৭ ঘণ্টা ধরে একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মিলে অভিষেকের বাম চোখের নিচের ক্ষতের স্থায়ী সমাধানে সচেষ্ট হন এবার। চলে দীর্ঘ অপারেশন।

কিন্তু এত সময় কেন?
চিকিৎসক মহলের মতে, বারবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে ওই স্থানে। সেটা যে সফল অস্ত্রোপচার নয়, এমনটা নয়। এই ধরনের গভীর ক্ষতকে সারিয়ে তুলতে একাধিকবার সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। বিশ্বের সেরা হাসপাতালে, সেরা প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রায় ৬ বছর পরে এর একটা স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা হয়তো এবার করা হয়েছে। আর সেটা করতেই সময় লেগেছে। বহু সার্জারির ক্ষেত্রেই প্রচুর সময় লাগে। চিকিৎসা বিজ্ঞান তো শর্টকাট কোনও কৌশল নয়, ধরলাম আর হয়ে গেল!

ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল?
চিকিৎসকরা বলছেন, চোখ। তার উপর একাধিকবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। ঝুঁকি তো ছিলই। শুধু এই ক্ষেত্রেই নয়, যেকোনও অস্ত্রোপচারে একটা রিস্ক ফ্যাক্টর থেকেই যায়। যেকোনও সময় যা কিছু হতেই পারে। রোগীর নানা প্যারামিটার নিয়ন্ত্রণ রাখা জরুরি হয়ে পড়ে। আর বড় অপারেশন করতে গেলে ঝুঁকির সম্ভাবনা বাড়ে। রোগীর অন্য অসুখ থাকলে আরও। সেখানে দাঁড়িয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আলাদা নন, একজন রোগী হিসেবে অপারেশনের সময় নিশ্চিত তাঁরও ঝুঁকি ছিল। যদিও এই অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে বলে শোনা গিয়েছে। সেটা ভালো খবর।

জানা যায়, বাম চোখের বল থেকে শুরু করে ভেতরের হাড় পর্যন্ত, একাধিক ক্ষতি হয়েছিল অভিষেকের। সেগুলো ঠিক করতে বহু চেষ্টার পরে এই অস্ত্রপচার করা হয়েছে। তাই, এত সময় লেগেছে অস্ত্রপচারে!

মমতার উদ্বেগ
অস্ত্রোপচারের দিন ওই সাত ঘণ্টা সময় নাকি উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন অভিষেকের পিসি মমতা। বরাবর স্নেহের পাত্র ভাইপো অভিষেককে নিয়ে এমনিই বারবার স্নেহ প্রকাশ করতে দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রীকে। ঘরোয়া আলোচনায় সেই উদ্বেগও নাকি প্রকাশ করেছিলেন তিনি। যদিও আমেরিকায় অভিষেকের সঙ্গে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী রুজিরা।

চিকিৎসা-রাজনীতি
দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। অনুব্রত মণ্ডল থেকে মদন মিত্র। এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া নিয়ে বিতর্ক হয়েছে বিস্তর। পার্থ কাণ্ডে সমালোচিত হয়েছে ওই সরকারি হাসপাতাল। সরব হয়েছেন বিরোধীরা। আবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় চোখের চিকিৎসায় দুবাই যাবেন, তা নিয়েও সরব হয়েছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা। একদা বিজেপির নবান্ন অভিযানে রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অচৈতন্য অবস্থা দেখেও বিদ্রুপ করেছেন অনেকেই। এবার আমেরিকায় অভিষেক, এই প্রসঙ্গেও বিতর্ক শুরু হয়েছে ফের। বিজেপি-র প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি, মেঘালয়ের প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায় ট‍্যুইট করে কটাক্ষ শানিয়েছেন। তিনি ১৩ অক্টোবর ট‍্যুইটারে লেখেন, ‘অভিষেকের চোখে ঠিক কী হয়েছে, কোন শহরে কোন হাসপাতালে কোন ডাক্তার কি অপারেশন করলেন জানলে বড় ভাল হত। প্রথমে তো শুনেছিলাম উনি চিকিৎসার জন্য দুবাই যাচ্ছেন। ইনসিওরেন্স ছাড়া আমেরিকায় চিকিৎসার খরচ আকাশছোঁয়া। খরচই বা কত হল, টাকাই বা কে দিলেন? কেউ একটু আরটিআই করে দেখবেন নাকি?’

আবার এই প্রসঙ্গেই অভিষেককে খোঁচা দিয়েছেন দিলীপ ঘোষ। সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেন, 'সরকারি হাসপাতালে বিশ্বাস নেই, তাই বেসরকারি হাসপাতালে যান। টাকা-পয়সার গণ্ডগোল থাকতেও পারে। সত্য-মিথ্যা পরে জানা যাবে।’

এই বিতর্কের মাঝেই বেনজিরভাবে একটি ছবি-সহ টুইট করেন তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। চোখের মণি বাদে বাকি অংশ টকটকে লাল! এমন অভিষেকের ছবি-সহ শনিবার টুইটারে কুণাল লেখেন, 'যাঁরা অভিষেকের চোখের চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপচার নিয়ে অমানবিক ভাবে সমালোচনা করছিলেন, তাঁদের ওঁর চোখের অবস্থা দেখা উচিত। অভিষেকের এই চোখটি দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সম্প্রতি তাঁর অস্ত্রপচার হয়েছে এবং তিনি পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। আমরা সবাই তাঁর দ্রুত সুস্থতা কামনা করি।’

More Articles