পাঁচ মাসে ১৭ হাজার মৃতদেহ দাফন! গাজার মৃত্যুমিছিল ঘুমোতে দেয় না বৃদ্ধ জাফরকে

Israel War on Gaza: গত সাতাশ বছরে যে পরিমাণ শবদেহকে সমাধিস্থ করেছেন জাফর, গত পাঁচ মাসে তার দশগুণ দেহ সৎকার করতে হয়েছে তাকে। গাজা এখন গণকবর।

মৃত্যুর পর মৃত্যু, ধ্বংসস্তূপের পর ধ্বংসস্তূপ দেখাটাই এখন অভ্যাস। যুদ্ধের পেরিয়ে গিয়েছে ১৭৫ দিন। গাজায় মৃত্যুর সংখ্যা ছুঁয়ে ফেলেছে প্রায় ৩০ হাজার। জখম কয়েক লক্ষ সম্ভবত। গত বছরের সেই ৭ অক্টোবর থেকে একই রকম পরিস্থিতি রয়েছে প্যালেস্টাইনের বিস্তৃত এলাকায়। আগ্রাসন কমাতে নারাজ ইজরায়েল। বরং প্রতিনিয়ত হামলার পরিধি বাড়িয়েই চলেছে নেতানিয়াহু সেনা। একদিন আগেই রাতভর ইজরায়েলি বোমায় মৃত্যু হয়েছে শতাধিক জনের। আমেরিকা সওয়াল করেছে রমজানের সময় প্যালেস্টাইনে যুদ্ধশান্তির পক্ষে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ চায় থামুক যুদ্ধ। ইজরায়েল কী চায়, তা বোধহয় তারাও জানে না। যে কোনও রকমে গাজা, প্যালেস্টাইনকে সম্পূর্ণ ধ্বংস না করে বোধহয় থামবে না এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। মৃত্যুমিছিল, দুর্ভীক্ষ, ওষুধের অভাবে মুমূর্ষুর শেষ হয়ে যাওয়া, কোনও কিছুই বোধহয় দাগ কাটছে না ইজরায়েল সরকারের মস্তিষ্কে, হৃদয়ে।

শান্তি যেন সেখানে এক দূরতর দ্বীপ। যে কোনও মুহূর্তে ইজরায়েলি গুলি ভেদ করে যাবে শরীর, বোমার টুকরো এসে ছিন্নভিন্ন করে দেবে হাত-পা-মাথা, তার জন্যই যেন দিন গুনছে গাজার মানুষ। ক্রমশ পিছু হঠতে হঠতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে গাজাবাসীর। আপাতত বোধহয় গোটা প্যালেস্টাইনে এমন কোনও জায়গা বেঁচে নেই, যেখানে গিয়ে মাথা লুকোতে পারে গাজাবাসী। গোটা দেশটাই যেন একটা বধ্যভূমি। যেখানে প্রতিদিন মারা যান হাজার হাজার মানুষ। মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ, ইজরায়েলের হামলার মুখ থেকে বাঁচে না কেউ-ই সেখানে। ইতিমধ্যেই গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শাতায়েহ। তাতে পরিস্থিতি বদলায়নি। এখনও প্রতিদিন শত সহস্র মানুষের মৃতদেহ জমছে এদিকে ওদিকে। গণকবর রচিত হচ্ছে প্রতিদিন সমগ্র গাজা জুড়ে।

৬৪ বছরের সাদি হাসান সুলেমান বারাকা। স্থানীয় লোকেরা তাঁকে ডাকেন আবু জাওয়াদ নামে। আবু জাওয়াদ গাজার মানুষের বেহস্তে যাওয়ার দূত। তার হাতেই দাফন হয় এলাকার সমস্ত মৃত মানুষের। গত কয়েক দশক ধরে এটাই তার পেশায়। মৃতদেহ নিয়েই কাজ আবু জাওয়াদের। তবু এই মৃতদেহ যেন সে মৃতদেহ নয়। এ মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মতবিরুদ্ধ এই মৃত্য়ু, যা লিখে দেয় কোনও ইজরায়েলি সেনা তার নিষ্ঠুর বন্দুক বা বোমা হাতে। এ সব কথাই দিনরাত ভাবতে থাকেন জাওয়াদ। ঘুম আসে না তাঁর। ৭ অক্টোবরের পর থেকে ভালো করে ঘুমোননি জাওয়াদ।

আরও পড়ুন: সন্তানের মৃতদেহও আসবে যে কোনওদিন! রোজ ২০০ লাশকে কাফন পরাচ্ছেন গাজার এই বৃদ্ধ

আগে ফজরের নমাজ পড়ে দিন শুরু হত জাওয়াদের। তারপর জলপাই তেল দিয়ে দুক্কা আর জাতার মেখে খেয়ে নিতেন নাস্তায়। তার পর গুটি গুটি পায়ে রওনা হতেন দেইর এল-বালাহের পূব দিকে রওনা হতেন। পেরিয়ে যেতেন খেজুর আর জলপাই গাছের সারি। এই ছিল জাওয়াদের রোজের নিয়ম। কিন্তু গত পাঁচ মাসে সেই নিয়ম একেবারে বদলে গিয়েছে। এখন মাথার উপর বোমারু বিমানের চক্কর। সব সময় যেন উঁকি মারছে মৃত্যুভয়। যে জাফরের হাত ধরে জন্নতপ্রাপ্ত হতেন শত শত গাজাবাসী, সেই জাফর আজ মৃত্যু দেখলে শিউরে ওঠেন। অথচ এমনটা কখনও হয়নি তাঁর।

মধ্য গাজার শরণার্থী শিবিরের প্রথম বাসিন্দা জাওয়াদ। এর আগে স্ত্রী ও ১০৪ বছর বয়সী বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে থাকতেন দেইর এল-বালাহ এলাকারই একটি একরত্তি বাড়িতে। মৃত্যু নিয়েই তাঁর কাজ। অথচ এলাকায় কী দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন জাওয়াদ। আশপাশের সকলেই ভালোবাসতেন হাসিখুশি সহজসরল এই মানুষটিকে। অথচ আজ আর বেঁচে থাকার মধ্যে কোনও সারল্য খুঁজে পান না জাওয়াদ। বরং মনে হয় বিকট এক জন্তুর মতো তার শিয়রে বসে রয়েছে যুদ্ধ নামক এক দানব। যা গাজা থেকে শুষে নিয়েছে সমস্ত প্রাণশক্তিটুকু। বেঁচে থাকাকেই খুব বড় অভিশাপ মনে হয় আজ তাঁর।

মাত্র পাঁচ মাসেই অন্তত ৩০ কেজি ওজন কমে গিয়েছে জাওয়াদের। এই কয়েক মাসে নিজের শীর্ণ হাতে এত এত শরীর কবর দিয়েছেন তিনি, যে গুনে শেষ করতে পারবেন না। তার মধ্যে কেউ তাঁর কাছের মানুষ, কেউ তাঁর পড়শি। যে খুদে শিশুটিকে কালই খেলে বেড়াতে দেখেছেন দাওয়ায়, উচ্ছ্বল, চঞ্চল, তার বোমায় ছিন্নভিন্ন নিথর শরীরখানা মাটির তলায় শুইয়ে দিতে গিয়ে বুক ফেটে যায় জাওয়াদের। সেই যন্ত্রণা গুমরে গুমরে ওঠে বুকের ভিতর সর্বক্ষণ। সমস্তক্ষণ ভয়ের একটা আবহ মাথার মধ্যে ছুটতে থাকে পাগলা ঘোড়ার মতো।

 

গত সাতাশ বছরে যে পরিমাণ শবদেহকে সমাধিস্থ করেছেন জাফর, গত পাঁচ মাসে তার দশগুণ দেহ সৎকার করতে হয়েছে তাকে। গাজা এখন গণকবর। কোনও একটি বিশেষ জায়গা বা এলাকা নয়, গোটা গাজাই যেন এক সমাধিক্ষেত্র। একসঙ্গে তিরিশটি-চল্লিশটি করে দেহ কবর দিতে হয় জাফরকে। হিসেব বলছে, গত ৭ অক্টোবর থেকে অন্তত ১৭ হাজার মৃতদেহকে কবর দিয়েছেন তিনি। যুদ্ধ নিথর হয়ে যাওয়া হাজার হাজার শরীর। অজস্র শিশু, যারা তাঁর নাতি-নাতনির বয়সী।  রোজ, প্রতিদিন।

প্রতিদিন সমাধিক্ষেত্র ভরে ওঠে মৃতদেহের মিছিলে। প্রতিদিন স্বজনবান্ধবকে নিয়ে সেখানে হাজির হন মানুষ। কান্নার কলরোলে ভেসে যায় মাটি। ভোর ৬টা থেকে সন্ধে ৬টা, আবু জাফর কবর খোঁড়েন। কফিন বানান, জানাজা প্রস্তুত করেন। মৃত শরীরগুলোর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করেন সজল হৃদয়ে। যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন মনগুলো অন্তত এমন বেহস্ত পাক, যেখানে যুদ্ধ শব্দটার অস্তিত্ব নেই। মনে মনে সেই ইচ্ছাটা খুব করে বলতে থাকেন জাফর। শোক পালনের উপাচার পেরিয়ে সেই প্রার্থনাটুকু মিশে যায় গাজার বারুদের গন্ধভরা বাতাসে।

আরও পড়ুন: গাজার মৃতদেহ থেকে হৃদপিণ্ড, যকৃত সত্যিই সরিয়ে নিচ্ছে ইজরায়েল? কারণ জানলে শিউরে উঠবেন

জাফরের সারাদিনের কাজে সাহায্য করেন খান ইউনিসের চার যুবক। তাঁরা সকলেই বাস্তুচ্যুত। নিজস্ব মাটি হারিয়ে পথ হারিয়ে ফেলা সহযাত্রীদের মাটি জোগান। একই সঙ্গে যাঁরা রয়ে গেলেন এই যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায়, তাঁদের জন্য একটু খাবার, একটু জল, একটু সাহায্যের ব্যবস্থা করে দেন জাফর আর তাঁর সঙ্গীরা। বিনিময়ে তাঁরা কিছুই চান না, শুধু গাজায় একমুঠো যুদ্ধশান্তি ছাড়া।

More Articles