চাকরি দেওয়ার নামে কী ঘটে মারুতি সুজুকিতে? কেন আন্দোলনের পথে শ্রমিকরা?
Maruti Suzuki Employee Protest: মারুতি সুজুকি নিয়োজিত মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩৬,০০০ যার মধ্যে ৮৩ শতাংশই অস্থায়ী কর্মী এবং মাত্র ১৭ শতাংশ স্থায়ী শ্রমিক।
শিল্প আর কৃষি, সঙ্গে জুড়েছে তথ্য প্রযুক্তি। ভারতের অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রস্তুত হয়েছে এবং এগিয়ে চলছে মূলত এই তিনটি ক্ষেত্রকে ধরেই। এর মধ্যে ভারী শিল্পের ক্ষেত্রে অটোমোবাইল শিল্পের অগ্রগতি উল্লেখ্য। ভারী শিল্প মন্ত্রক অটো শিল্প সমিতি, সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ান অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স এবং অটোমোটিভ কম্পোনেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে ২০৪৭ সালের জন্য অটোমোটিভ মিশন প্ল্যান নিয়ে কাজ করছে। দাবি, এই পরিকল্পনার ফলে ভারত শিল্প শক্তিতে আরও উন্নত হতে পারবে। শিল্পের জন্য মূল প্রয়োজন, জমি, শ্রম, মূলধন এবং সংগঠন। এই সবটির মধ্যে একমাত্র সুলভে মেলে শ্রম, এদেশে তো বটেই। অটোমোবাইল শিল্পকে দেশের সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র করে তোলার দাবিও করেছে সরকার। সত্যিই কি ভারী শিল্পে কর্মসংস্থানের অবস্থা আশানুরূপ? বেশ কয়েকমাস ধরে আন্দোলন চালাচ্ছেন মারুতি সুজুকি কোম্পানির ভারতীয় শ্রমিকরা। তাঁদের অবস্থা থেকেই ভারতে এই শিল্পের বাস্তব চিত্র টের পাওয়া যায়।
জাপানের সুজুকি মোটর কর্পোরেশনের সহযোগী মারুতি সুজুকি ভারতের বৃহত্তম গাড়ি নির্মাতা। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে যাত্রীবাহী যানবাহন বিভাগে এর বাজার শেয়ারের পরিমাণ ছিল ৪৩.৯৪%-এরও বেশি৷ যাত্রীবাহী গাড়ির ব্যবসায় রেকর্ড করেছে এই সংস্থা৷ ইন্ডিয়া ব্র্যান্ড ইক্যুইটি ফাউন্ডেশন থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ১,৭১,৮১৩ ইউনিট গাড়ি বিক্রি হয়েছে মারুতি সুজুকির। গুরুগ্রাম-মানেসারে মারুতি সুজুকি প্ল্যান্টে কাজ করেছেন এবং কাজ করছেন এমন ৩,০০০-এরও বেশি অস্থায়ী (চুক্তিভিত্তিক, প্রশিক্ষণার্থী, শিক্ষানবিশ ইত্যাদি) কর্মীরা স্থায়ী চাকরির দাবি তুলে জড়ো হয়েছেন। মারুতি সুজুকি ইন্ডিয়া লিমিটেডের ইতিহাস বলছে, ২০১২ সালে মারুতি সুজুকির মানেসারের কারখানায় শ্রমিকদের তীব্র অসন্তোষ দেখা গিয়েছিল। ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ওই কারখানার দখল নেওয়ার দিকে এগোন। সেই বছরের ১৮ জুলাই, কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং পরবর্তী হিংসায় প্রায় ১০০ জন ম্যানেজারকে মারধর করা হয়, একজন ম্যানেজারের মৃত্যুও হয়। অটোমোবাইল শিল্পে এ ছিল এক বিধ্বংসী লড়াই। এরপর থেকেই মারুতি সুজুকির কর্মীদের সঙ্গে অদ্ভুত আচরণ শুরু হয়। ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের বিচার হয়। বিচার চলাকালীন এই নেতাদের ওই ম্যানেজারের হত্যার মামলায় ফাঁসানো হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অন্যান্য শ্রমিকদের বহিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে ৫০০ জনেরও বেশি স্থায়ী কর্মী ছিলেন যাঁদের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ তদন্ত পর্যন্ত হয়নি। বিষয়টি পুরোপুরিই ছিল শ্রম আইনের পরিপন্থী। ২০১২ সালের মানেসার আন্দোলনের পর অস্থায়ী শ্রমিকদের সংগ্রাম আরও তীব্র হয়েছে।
আরও পড়ুন- হকার উচ্ছেদ করেই ‘অমৃতভারত’ হবে মোদির দেশ?
বহিষ্কৃত শ্রমিকরা শ্রম আদালতে গিয়েছিলেন, সেখানে তাঁদের মামলা সেই ২০১২ সাল থেকেই বিচারাধীন রয়েছে। মারুতি সুজুকি সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে শ্রমিকরা তখন থেকে মামলা চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি অস্থায়ী শ্রমিকদের পক্ষ থেকেও শ্রম কমিশনারের কাছে অভিযোগ জানানো হয়েছে। এই কমিটি মারুতি সুজুকির অস্থায়ী কর্মীদের সংগঠিত করতে সাহায্য করেছে। অস্থায়ী শ্রমিকরা মারুতি সুজুকি অস্থায়ী মজদুর সংঘ নামে একটি ওয়ার্কিং কমিটিও গঠন করেছে।
কিন্তু কারা এই অস্থায়ী শ্রমিক?
২০১২ সালের আন্দোলনের পর মারুতি সুজুকি ঘোষণা করে যে চুক্তি শ্রম ব্যবস্থা বাতিল করেছে সংস্থা। বদলে নির্দিষ্ট মেয়াদি কর্মসংস্থান বা চুক্তিভিত্তিক কাজ শুরু করেছে। শ্রমিকদের বিভিন্ন শ্রেণি তৈরি হয়: শিক্ষানবিশ, অস্থায়ী কর্মী, নৈমিত্তিক কর্মী এবং বহুমুখী দক্ষ কারিগরি কর্মী। এই শ্রেণীর শ্রমিকরা মারুতি সুজুকির কর্মীবাহিনীর একটি বিশাল বড় অংশ। মারুতি সুজুকি শ্রমিকদের তরফে জানা গেছে, মারুতি সুজুকি নিয়োজিত মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩৬,০০০ যার মধ্যে ৮৩ শতাংশই অস্থায়ী কর্মী এবং মাত্র ১৭ শতাংশ স্থায়ী শ্রমিক।
কীভাবে অস্থায়ী শ্রমিকদের কাজ করানো হয়? ন্যায্য পাওনা কি তারা পান?
২০১৮ সালে শিক্ষানবিশ হিসাবে হিসেবে চাকরি পান গৌতম নামের এক যুবক। দ্য ওয়ারকে তিনি জানিয়েছেন, তাঁকে মারুতি ট্রেনিং স্কুলে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে নথিপত্র যাচাই, বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণের পর তাঁকে পরিচয়পত্র দেওয়া হয় এবং তাঁর মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়। এরপর শুরু হয় এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ। প্রথম দিন শিক্ষানবিশদের মারুতির যাত্রা শুরু, প্রথম Maruti 800 গাড়ি তৈরি ইত্যাদির ইতিহাস বলা হয়। তিন দিন ধরে চলে বক্তৃতা এবং গাড়ি তৈরির প্রক্রিয়ার ভিডিও দেখানো। এরপরে, গৌতমকে মানেসার প্ল্যান্টে পাঠিয়ে কাস্টিং ওয়ার্কশপে রাখা হয়েছিল। প্রথম দুই-তিন দিন তাঁকে হাতে কলমে কাজ শেখান আরেক অস্থায়ী কর্মী, যাঁর চুক্তি শেষের মুখে।
রোবট বা অন্যান্য মেশিন কীভাবে কাজ করে তা গৌতমকে শেখানো হয়নি; এই দক্ষতাগুলি শেখানো হয় একজন স্থায়ী কর্মী। মূল কাজটি করেছিল তিনজন শ্রমিক যারা সকলেই অস্থায়ী কর্মী।
গৌতমের বেতন ছিল ১৩,০০০ টাকা যার মধ্যে সরকার ১০,০০০ টাকা দেয়। কোনও পিএফ বা ইএসআই সুবিধা দেওয়া হয়নি। এক বছর পর, "উজ্জ্বল ভবিষ্যত" কামনা করে একটি চিঠি ধরিয়ে তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় সংস্থা। আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি মারুতি সুজুকি। তিন মাস বসে থাকার পরে, তাঁকে গুরুগ্রামে ওয়েল্ডশপে যোগ দিতে বলা হয়। এবার তাঁর কাজ ছিল গাড়ির দরজার কব্জা ঠিক করা। এবারও তাঁকে কাজ শেখান একজন অস্থায়ী কর্মীই।
সাত মাস কাজ করার পর, তাঁর চুক্তি শেষ হয় এবং তাঁকে একটি চিঠি দেওয়া হয় যে তিনি সাত মাস কাজ করেছেন। আবার গৌতম বাড়িতে ফিরে এসে বেকার বসে যান। অপেক্ষা এবং আশা করেন যে তিনি মারুতি সুজুকিতে স্থায়ী চাকরি পাবেন। চার মাসের অপেক্ষার পর, আবারও জানানো হয় তিনি অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কোম্পানিতে যোগ দিতে পারেন। আবারও সাত মাস পর তার চুক্তি শেষ হয়। এবার এক বছর অপেক্ষার পর স্থায়ী কর্মী পদে পরীক্ষা দিতে বলে ফোন আসে। পরীক্ষা দেন, নির্বাচিত হননি। মারুতি সুজুকি দেখাল যে, তারা তিনজন কর্মী নিয়োগ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, তারা অস্থায়ী কর্মী হিসাবে তিনবার একজন কর্মীকেই নিয়োগ করেছিল।
আরও পড়ুন- “না খেতে পেয়ে মরার চেয়ে ইজরায়েলে মরা ভালো,’ পরিযায়ী শ্রমিকদের কেন যুদ্ধের দেশে পাঠাচ্ছে ভারত?
গৌতম অন্য কোম্পানিতে অন্য চাকরি খুঁজতে মারুতি সুজুকির সার্টিফিকেট দেখান এবং প্রতিটি কোম্পানিই জানায় সেই সার্টিফিকেটগুলো মূল্যহীন। অবশেষে, ১৩,৬১০ টাকা বেতনে একটি কারখানায় চাকরি পান। এই টাকায় সংসার চলবে না জেনে চাকরি নেন না তিনি। গৌতমের মতো প্রায় ৩০,০০০ কর্মী মারুতি সুজুকিতে অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। এখন মারুতি সুজুকি সোনিপাতের খারখোদায় একটি নতুন কারখানা খুলছে। মারুতি সুজুকির অস্থায়ী শ্রমিকরা দাবি করছেন, নতুন কারখানায় যে স্থায়ী শ্রমিকদের নেওয়া হবে, কোম্পানির উচিত এই ৩০,০০০ শ্রমিকের মধ্যে থেকেই তাদের নির্বাচন করা।
মারুতি সুজুকির অস্থায়ী শ্রমিকরা দাবি করছেন সমান কাজের জন্য সমান বেতন। জাপানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসাশি তাকেউচি বার্ষিক ৫১ কোটি টাকার বেশি বেতন পান, সেখানে অস্থায়ী কর্মীরা মাসে ১২ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন। লড়াইয়ের পরে স্থায়ী শ্রমিকরা প্রায় ১.৩ লক্ষ টাকা আয় করেন। বেশ কয়েকজন কর্মীই জানিয়েছেন, মারুতি সুজুকি তাদের জীবন থেকে আনন্দ শুষে নিয়েছে। স্থায়ী চাকরি পাওয়ার স্বপ্নকে পদদলিত করেছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিবাদের পথেই হাঁটছেন এই শ্রমিকরা। হক আদায় হবে কিনা এ প্রশ্ন একইসঙ্গে জটি আবার সহজও কিন্তু দেশের শ্রম আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, দেশের শ্রমকে সুলভেশুষে নিয়ে যে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো এই কাজ করে চলেছে, তাদের শাস্তি দেবে কে?