বহিরাগতর কাছে শোচনীয় পরাজয়! অধীর আর দিলীপকে হারাল তাঁদের দলই?
Adhir Chowdhury Dilip Ghosh: এত বছরে অধীরের মূল প্রতিপক্ষ কখনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছিলেনই না।
বাংলা নিজের মেয়েকেই চায় কিন্তু সাংসদ বহিরাগতকেই চায়। এমনটা বলা নেহাত ভুল হবে না। বাংলার বাইরে থেকে এসে ইউসুফ পাঠান এবং কীর্তি আজাদ তৃণমূলের টিকিটে লড়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন এ বাস্তব। আর পাঠান ও আজাদ হারিয়েছেন কাদের? যারা এই বাংলারই, যারা দুই বিপরীত দলের হলেও রাজ্যে বুনিয়াদ রয়েছে গভীর। পাঁচ বারের সাংসদ অধীর চৌধুরী হারলেন বহরমপুরে, জয়ী হলেন গুজরাত থেকে আসা ইউসুফ পাঠান। কীর্তি আজাদের কাছে বর্ধমান দুর্গাপুর কেন্দ্রে হারালেন বিজেপির দিলীপ ঘোষকে।
বহরমপুর কেন্দ্রে অধীরকে প্রায় ৮৫ হাজার ভোটে হারিয়েছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান। তিনি বাংলার মানুষই নন, বাংলা ভাষাও জানেন না। এমনকী জেতার পর বলে দিয়েছেন গুজরাতে তাঁকে বেশি থাকতে হবে কারণ সেখানে তাঁর বাড়ি। তবু কোন ম্যাজিকে ২৫ বছরের সাংসদকে হারিয়ে দিলেন পাঠান? অধীর বলছেন, বাংলার রাজনীতি ক্রমশই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। হিন্দুদের নামে ভোট চাওয়া যদি বিজেপির কৌশল হয়ে থাকে, পাশাপাশি মুসলিম নামে মুসলিম ভোট টানা শাসকদলের মোক্ষম অস্ত্র হয়ে উঠছে। নিজেকে এই পাকেচক্রে 'স্যান্ডুইচ'ও মনে হয়েছে অধীরের। "আমি স্যান্ডউইচ হয়েছি। একদিকে, হিন্দু ভোটের বিভাজন, অন্য দিকে মুসলিম ভোটের বিভাজন। আমি হিন্দু হতে পারিনি। মুসলিমও হতে পারিনি,’’ বলছেন অধীর। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, অধীর আসলে বিজেপি করেন।
আরও পড়ুন- মোদিকে যোগ্য জবাব! মেইতেই-কুকি মিলে কীভাবে বিজেপিকে উপড়ে ফেলল মণিপুর?
বহরমপুরে এই প্রথম সংখ্যালঘু প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন অধীর। ওই অঞ্চলের জনপ্রিয় চিকিৎসক নির্মলচন্দ্র সাহা বিজেপি প্রার্থী হওয়ায় অধীরের জন্য চাপ বেড়েইছিল এবার। তবে এই অঞ্চলে মুসলিম ভোট বেশি হলেও গত ২৫ বছরে ভোট জিততে মুসলিম প্রার্থীর দরকার পড়েনি। এত বছরে অধীরের মূল প্রতিপক্ষ কখনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছিলেনই না। ২০১৯ সালে অধীরের জয়ের ব্যবধান সাড়ে ৩ লক্ষ থেকে নেমে আসে ৮৭ হাজারে। ভোট কমেছে হু হু করে। পাশাপাশি কংগ্রেস হাইকমান্ডের তরফেও অধীরের প্রতি উদাসীনতা ছিল লক্ক্য করার মতো। বাংলায় রাহুলের ন্যায় যাত্রা যখন আসে তখন তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়েছিলেন অধীর। বামেদের সঙ্গেও জোট করলেন তিনি। কিন্তু ২৫ বছরের সাজানো বাগান তছনছ করে দিল গুজরাতের সন্তান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহরমপুর লোকসভার অন্তর্গত সাতটি বিধানসভার মধ্যে ছ'টিই তৃণমূলের, একটি বিজেপির। খোদ বহরমপুর আসনেই কংগ্রেস তৃণমূলের থেকে ঢের পিছিয়ে। পঞ্চায়েতেও বাম ও কংগ্রেস এখানে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। সিএএ আবহে, সারাদেশে নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি যেভাবে মুসলিম বিদ্বেষী প্রচার চালিয়েছেন, তার পাল্টা প্রচার এখানে তৃণমূল সফলভাবে করেছে। মুসলিম ভোটের বিপুল অংশ টেনেছেন পাঠান। অধীরের গড় ভাঙতে তৃণমূলের দরকার ছিল এই কৌশলটি। পাশাপাশি, তারকা মুখ নিয়ে এখনও অবধি তেমন হারের মুখও দেখেনি তৃণমূল।
অন্যদিকে, দিলীপ ঘোষের হারের নেপথ্যে রয়েছেন খোদ শুভেন্দুই? কীর্তি আজাদের কাছে হারের পর বারেবারেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে জেতা আসন থেকে দিলীপ ঘোষকে উপড়ে বর্ধমান দুর্গাপুরে নিয়ে আসার আসল কারণ। গত লোকসভা ভোটে তিনি ছিলেন বঙ্গ বিজেপির রাজ্য সভাপতি। বাংলায় ১৮ টা আসন জেতে বিজেপি। রাজ্য সভাপতির পদ গিয়েছে তাঁর, সাংসদ পদও গেল, বাংলায় বিজেপির আসনও কমল। এই লোকসভা নির্বাচনে তাঁর জেতা আসন মেদিনীপুরের বদলে বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে দিলীপকে প্রার্থী করেছিল দল। হারার জন্যই?
দিলীপ বলছেন, সারা ভারতেই বিজেপির ফল খারাপ হয়েছে। খোদ নরেন্দ্র মোদির ফলও আগের মতো ভালো হয়নি। কিন্তু জেতা আসন থেকে তুলে নতুন আসনে দেওয়া যে তারও হজম হয়নি তাও স্পষ্ট করেছেন দিলীপ। কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল দল, উত্তর খুঁজছেন তিনি। কিন্তু কীর্তি বহিরাগত, রাজ্যে নতুন প্রার্থী হয়ে জিতলেন কীভাবে? কীর্তি আজাদ বঙ্গে নতুন হলেও রাজনীতিতে ৩৬ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। তৃণমূল বলছে গলসি, ভাতার, বর্ধমান শহরের মতো কয়েকটি জায়গা তৃণমূল অন্তর্দ্বন্দ্ব ভুলে কীর্তি আজাদেরর জন্য মাঠে নেমে প্রচার করেছে। বিজেপি দিলীপ ঘোষের মতো প্রার্থী দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু এই অঞ্চলে তাঁদের বুথভিত্তিক সংগঠন দুর্বল। ফলে ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ কম ছিল। এছাড়া দিলীপের বেলাগাম মন্তব্য, তাঁর ইমেজও খানিক দলের বিরুদ্ধে গেছে। একমাত্র দুর্গাপুর পশ্চিমেই খানিক এগিয়ে ছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন- মোদিই প্রধানমন্ত্রী হবেন? নাকি, শেষ মুহূর্তে মোক্ষম চাল দেবেন নীতীশ-নাইডু?
অন্যদিকে দিলীপ তাঁর জেতা আসন মেদিনীপুর কেন্দ্রের সবক’টি বিধানসভা আসনেই নিয়মিত যাতায়াত করতেন। বর্ধমান-দুর্গাপুর আসন একদম নতুন। এই লোকসভার সাতটি বিধানসভা আসন বর্ধমান দক্ষিণ, বর্ধমান উত্তর, দুর্গাপুর পূর্ব, দুর্গাপুর পশ্চিম, মন্তেশ্বর, ভাতার আর গলসির মধ্যে মাত্র একটি বিধানসভাই বিজেপির দখলে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে দুর্গাপুর পশ্চিম আসনে জিতেছিলেন বিজেপির লক্ষ্মণচন্দ্র ঘড়ুই।
বিজেপিরই একাংশ বলছে, দিলীপ ঘোষের বদলে অন্য কাউকে মেদিনীপুর আসনে প্রার্থী করার জন্য কলকাঠি নেড়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারীই। দিলীপ ঘোষের হয়ে সওয়াল করেছিলেন সুকান্ত মজুমদার। কিন্তু তাঁর ভূমিকা শুভেন্দুর দাপটের কাছে নিতান্তই ফিকে! তাই মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র দিলীপ ঘোষ হারলেন। নেপথ্যে শুভেন্দু কিনা এই উত্তর দিলীপ নিশ্চয়ই পাবেন একদিন।