'কালো কিন্তু ভালো খেলে ছেলেটা'
African Football and Slavery: প্রতি বছর আফ্রিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অন্তত ৬০০০ কিশোর এভাবে ইওরোপ রওনা দেয় বেপথে, বেরুটে।
আমার মামাবাড়ির পাড়ায় একটি লোক ছিল। তার নাম ছিল কালোব্যাঁকা। অদ্ভুত নাম, নাম তো নয় যেন আয়না। আমরা মানুষকে যে চোখে দেখি, প্রথমেই তার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকাই - আমাদের মনের গড়নটাই আসলে রাখা আছে এই চার অক্ষরে। ভাবি যার নাম কালোব্যাঁকা কী পরিমাণ অপমান তাকে প্রতিদিন সইতে হয়েছে স্রেফ আকৃতি ও রঙের কারণে। কালোব্যাঁকার নামটা মনে পড়ছে আসলে একটা অন্য একটা প্রেক্ষিতে। আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলির পাতায় পড়ছি, ব্রাজিলের উঠতি খেলোয়াড়রা আর ইওরোপ যেতে চাইছে না। কেন যেতে চাইছে না? বিআর ১০১ হাইওয়ের ঘেঁষা সাও গনসালোর ছেলে, গোটা দেশের নয়নের মণি ভিনিসিয়াস জুনিয়র রিয়ালের হয়ে মাঠে নামা ইস্তক তাঁকে বাঁদর বলে টিটকিরি দিচ্ছিল ভ্যালেন্সিয়ার দর্শকরা। ভিনিসিয়াসের কীর্তি, অনায়াস গতায়ত তাদের সমীহ আদায় করতে পারেনি, তাঁকে সর্বোচ্চ অপমান করতে, মনোবল ভেঙে দিতে প্রথম থেকেই গায়ের রঙ নিয়ে অপদস্থ করা হতে থাকে। অর্থাৎ ভিনিসিয়াসকে নব্বই মিনিটের ম্যাচে দু'বার লড়তে হচ্ছে। একটা লড়াই মাঠে, প্রতিপক্ষের সঙ্গে। আরেকটা লড়াই মাঠের বাইরে থেকে ধেয়ে আসা কটূক্তিতে ছিন্নভিন্ন হওয়া মনের সঙ্গে। তাতে অবশ্য কারও কিছুই এসে যায়নি। শুধু তিনি একবার মাঠে মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলেন, ওই দর্শকদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পাল্টা দিয়েছিলেন। ততদিনে তিনি জেনে গিয়েছেন, যে কীর্তিই স্থাপন করুন না কেন, ইওরোপ হাসবে, বলবে মুখপোড়া বাঁদর। সাংবাদিক সম্মেলনে বলেও ফেলেন, এ আর নতুন কী, আকছার হচ্ছে, এমনটাই যেন স্বাভাবিক, হবেই। এই কালোব্যাঁকাও তেমন, সে জানে তার আসল পরিচয় কালোব্যাঁকা। সে যাই করুক, কালোব্যাঁকা, এটাই মোদ্দা কথা। বড়জোর একদিন রেগে যাবে সে। এমনিতে অপমানে নিচু মুখ নিয়ে চুপ করে বাড়ি ফেরাই ওর নিয়তি।
এই বাড়ি ফেরার পথেই ওদের আমি দেখেছি। আপনিও দেখেছেন। তবে ওদের সঙ্গে কথা হয়নি আমার আপনার কারও। বড়জোর চোখ চাওয়াচাওয়ি হয়েছে। অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নিয়েছি দু'পক্ষই। কীসের অস্বস্তি? পরস্পরকে না-চেনার। এই অপ্রস্তুতি এড়াতে, নিজেকে সপ্রতিভ দেখাতে বন্ধুদের সামনে আমরা বলে উঠেছি, নিগ্রো। গ্রানাইট পাথর-খোদাই দেহ, চুলে নানা কারুকাজ, এই ছেলের দল হাসতে হাসতে মিলিয়ে গিয়েছে জনপদের কোনও প্রান্তে, কোনও নির্মীয়মাণ আবাসনে। সেই হাসিতে লেগে ছিল বিকেলের শেষ আলো, চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার আগে, যখন দেখা হয়েছিল, ওদের হাতে ছিল ফুটবল। এই সেই সুবর্ণগোলক, যা ওদের নীলাম্বর এই গোলকধামে ঘুরিয়ে মারছে। এখানে ওরা খেলতে আসে, ছোট ক্লাবে, খেপ, কেউ কেউ একটু বড় ক্লাবে, এক-দু'জন ইস্ট-মোহনে। ওই এক-দু'জনকে দেখেই আরও অনেকে আসে। চোখে তারকা হওয়ার স্বপ্ন, মনে দেশ-গাঁ-র স্মৃতি আর পায়ে ফুটবল, এই নিয়েই ওরা জলস্রোতে ভাসে। বিশ্বকাপের আলোসাজ আর মেসি রোনাল্ডো ইত্যাদি মহাপ্রাণের রবরবার মধ্যে দাঁড়িয়ে, আফ্রিকান ফুটবলের ম্যাজিক দেখতে দেখতে, ওদের কথা হঠাৎ মনে পড়তে পারে। তখন খুঁজলে দেখা যাবে, সমুদ্রগর্জন বুকে ধারণ করে, বিষণ্ণ করুণ এক বিউগলের সুরের মতো ওরা বেঁচে আছে, গোলে ফুটবল জড়িয়ে বাড়িতে দ্রুত টাকা পাঠানোর আশায়।
আরও পড়ুন- শোকের বিগ্রহ
ওদের ভিটেমাটি আফ্রিকা। দেশের নাম ঘানা, টোগো, আইভরি কোস্ট, মালি বা নাইজেরিয়া। মানে ওরা আসছেন সেই বিপুলা মহাদেশের গর্ভ থেকে, যেখান থেকে চারশো বছরের বেশি সময় ধরে মানুষের চেয়ে সস্তা দাস লাগাতার পৌঁছে গিয়েছে ইওরোপে। সেই দাসের শরীরের, শ্রমের, ঘামের মূল্য নির্ধারণ করেছে স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, ব্রিটেন, আমার-আপনার চেনা ফুটবল-খেলিয়ে দেশের শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। উপনিবেশ ব্যবস্থা নিপাত গিয়েছে। কিন্তু কোনও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই আসলে চিরতরে হারিয়ে যায় না। ফেলে আসা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি ভূতের মতো প্রচ্ছায়া ফেলে অন্য সময়তলে। আর এই কারণেই ওদের আমরা, আমি-আপনি, চিনি। ফুটবল হাতে, জার্সি গায়ে ঘুরতে দেখি আজও আমাদের চেনা চৌহদ্দিতেও।
কেউ বলতে পারেন, এসব মনগড়া, কই ফরাসিদের দলে কত কৃষ্ণাঙ্গ! এরা কি দাস নাকি! তাদের মনে করিয়ে দেব, বিশ্বকাপের ফাইনালে মার্টিনেজ গোল বাঁচানোর পরে এই ফুটবলারদের ব্যর্থতা স্রেফ একজন ক্রীড়াবিদের বিপর্যয় হিসেবে দেখা হয়নি, ফরাসি নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ দেখেছে কৃষ্ণাঙ্গের না পারা, একজন দাসের পরাজয়। অনলাইনে তুলোধনা করা হয়েছে তাদের। সভ্যতার গরিমা বাঁচাতে এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে ফরাসি ফুটবল ফেডরেশনকে। তুমি কালো মানে তোমাকে জিততেই হবে প্রভুর হয়ে, এমনটাই রেওয়াজ।
৪০০ বছরে কমবেশি এক কোটি তিরিশ লক্ষ আফ্রিকান দাস এসেছিল ইওরোপে, সমুদ্রপথে নরকের ঋতু পেরিয়ে। পথে নৌকোডুবি হয়ে মারা যান অন্তত ১০ লক্ষ। বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে, যন্ত্রণা সয়ে মৃত্যু হয়েছে আরও লাখ দশেকের। যারা বেঁচেছে, শুধু খাবারের বিনিময়ে শরীরের উপর ন্যূনতম অধিকার হারিয়েছে তারা। ২১ শতকজুড়ে এই অন্যায়ের জন্য 'ক্ষমা' চেয়েছে বহু সভ্য দেশ। কিন্তু ফুটবলকে সামনে রেখে আফ্রিকান দাস কেনাবেচা আজও চলছে। পরিভাষাগত ভাবে একে বলা হচ্ছে ফুটবল ট্রাফিকিং। স্বপ্ন ছিল সভ্য হওয়ার, ইওরোপে খেলে বড় হওয়ার, যেমনটা ভিনিসিয়াস হয়েছে, বাড়িতে টাকা পাঠিয়েছে, পুরনো বাড়িটা সারানো হয়েছে, এখন সেই স্বপ্নটা আর দেখছে না ভিনিসিয়াসের ভাইয়েরা।
ভিনিসিয়াসদের খুঁজে বের করাটা খুব কঠিন নয়। পেটে খিদে, পায়ে ফুটবল, এমন শরীরের খোঁজে আফ্রিকা চষে বেড়ায় শিকারিরা। তারা নিজেদের পরিচয় দেয় এজেন্ট হিসেবে। রাতারাতি দরিদ্র দেশে ফুটবল ক্যাম্প খুলে ফেলে। বিপন্ন বিস্ময়ে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলার স্বপ্ন নিয়ে এই ক্যাম্পগুলির দিকে রওনা দেয় শত শত নবীন কিশোর। 'অবজার্ভার' পত্রিকা ২০০৮ সালে একটি প্রতিবেদনে দেখায়, ঘানার রাজধানী আক্রাতে অন্তত ৫০০ এমন ভুয়ো অ্যাকাডেমি রয়েছে, যেখানে সামান্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত ইউরোপীয়রা নামী ব্র্যান্ডের জ্যাকেট গায়ে পরিত্রাতা সেজে স্বপ্ন সওদা করেন। তারা নিজেদের বিখ্যাত ক্লাবের প্রাক্তন খেলোয়াড় হিসেবে পরিচয় দেয়, সঙ্গে রাখে ম্যাঞ্চেস্টর ইউনাইটেড, বার্সেলোনার জাল প্যাড। জেহাদি ক্যাম্পের মতোই এসব ক্যাম্পে ব্রেনওয়াশ চলে। মাথায় ইউরোপ যাত্রার পোকা একবার ঢুকে গেলে ছেলেমেয়েরাই বাবা-মায়ের উপর চড়াও হয় টাকার জন্যে। ঘটিবাটি, জমি বাড়ি, গয়না বিক্রি করে, সর্বশান্ত হয়ে ২০০০-৩০০০ ইউরো জোগাড় হয়। মালি-র মতো জায়গার বাসিন্দাদের জন্য এই অর্থ এক জীবনের সঞ্চয়। জুয়াটা বাবা-মায়েরা খেলে, কারণ তাদের চোখেও তখন ডলার-ঝিকমিক। অনেকে ছেলেমেয়ের বয়স সরকারিভাবে কমিয়ে ক্যাম্পে পাঠান। পরিবারে একজন ইওরোপযাত্রী ফুটবলার মানে বরাত খুলে গেল, এই সরল বিশ্বাসেই এত লড়াই।
‘ম্যাজিক সিস্টেম: আফ্রিকান ফুটবলারস অ্যান্ড দ্য মডার্ন স্লেভ ট্রেড’ গ্রন্থে সাংবাদিক ক্রিস্টোফার গ্লেইজেস এবং বার্থেলমি গেলিয়ার্ড দেখাচ্ছেন, প্রতি বছর আফ্রিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অন্তত ৬০০০ কিশোর এভাবে ইওরোপ রওনা দেয় বেপথে, বেরুটে। জিওগ্রাফিকাল ম্যাগাজিনের মতে, সংখ্যাটা অন্তত ১৫ হাজার। এরা সকলেই যে খুব চৌকস খেলোয়াড়, তা কিন্তু নয়। ফুটবলটা যে মগজে নিয়েই জন্মেছে, শৈশব থেকেই যে বল নাচায় শয়নে-স্বপনে, তার পথ ততটা চড়াই-উৎরাই নাও হতে পারে। স্কিলের জোরেই সে নিজেরটুকু হাসিল করে নিতেও পারে। কিন্তু এই সংখ্যাটা একশোরও কম। আবার এই প্রথম একশোতে জায়গা পাওয়ার জন্য বাবা-মায়েরাও ছেলেমেয়েদের লড়িয়ে দেন, ছোটরা স্বপ্নের ওজন বুঝে লড়তে থাকে। দাসের বৈশিষ্ট্যই তো তাই, যে কোনও পরিস্থিতিতে লড়াইয়ের জন্য নিজেকে তৈরি করা।
আরও পড়ুন- পথ বেঁধে দিল…
'অবজার্ভার' পত্রিকার একটি রিপোর্ট বলছে, কাতারের অ্যাস্পায়ার ফুটবল অ্যাকাডেমিতে ২৩ জন শিশু-কিশোরকে নেওয়া হচ্ছিল। ঘানা, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, মালি-র মতো দেশগুলি থেকে সাড়ে সাত লক্ষ ছেলেমেয়ে যোগ্যতা অর্জনের লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। এরা জানে নাইজেরিয়ার রাজধানীর লাগসের নোংরা দুর্গন্ধে ভরপুর বস্তিতে এজেন্ট বারবার আসবে না। তাই একটা অ্যাকাডেমিতে মাথা গলিয়ে ফেলাই বেঁচে থাকার অন্যতম লক্ষ্য হয়ে ওঠে। সেরার সেরাদের বাদ দিলে, সংখ্যাগরিষ্ঠই ফুটবলটা অর্জন করতে চায়, নিজের এবং পরিবারের অন্ন নিশ্চিত করতে, আরেকটু ভালো থাকার আশায়। এজেন্টদের পাখির চোখ হয় এরাই। এর নিচেও আছে আরেকটি শ্রেণি, ক্রিস্টোফার গ্লেইজেস এবং বার্থেলমি গেলিয়ার্ড, যাদের নিজেদের বইয়ে জিরো নাম দিয়েছেন। এরা ফুটবলে দড় নন, এদের অ্যাসেট শুধু শরীর, খাটতে পারার ক্ষমতা, যে কোনো কাজ সস্তায় এবং আগে করে দেওয়ার দাসপ্রত্যয়। ফুটবলটাকেও তারা একটা কাজ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত ছোটবেলা থেকে। এদেরই ছলে-বলে, কৌশলে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে এজেন্টরা। কখনও কখনও ধারও দেয় চড়া সুদে। কোন পথে দেশ ছাড়বে তারা? যে চোরা পথে ট্রান্সআটলান্টিক দাসরা গিয়েছে চারশো বছর ধরে, সেই জোয়ারভাটাতেই পাড়ি দিতে হবে এদেরও।
১৯৯৫ সালে আইন করে ইওরোপে বসম্যান রুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। বলা হয়, ইওরোপের ক্লাবগুলিতে অ-ইওরোপিয় খেলোয়াড়রা খেলতে পারবে অবাধে, চুক্তি শেষ হলে ট্রান্সফার ফি না দিয়েই অন্য ক্লাবেও যেতে পারবে। এই সময় থেকেই এই নয়া দাস কেনাবেচার বাড়বাড়ন্ত। ঠগ এজেন্ট এদের ইওরোপের বড় ক্লাবে খেলার স্বপ্ন দেখায়। ইওরোপে গিয়ে তারা আবিষ্কার করে, না আছে ক্লাব, প্রতিশ্রুতিমাফিক থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা, না আছে কোনও চুক্তি। কোনওরকমে স্থানীয় ক্লাব জুটিয়ে বাঁচার জন্য খেলা শুরু করে তারা। প্রতিদিন খেতে হবে, চোরাপথে জোগাড় করা ভিসার মেয়াদ বাড়াতে হবে, দাসের শরীর লড়তে থাকে এগুলি মাথায় রেখে। আসলে আফ্রিকায় ফেরাটা লজ্জার। সন্তানের মধ্যে ট্যালেন্ট রয়েছে এ কথা প্রমাণে আফ্রিকার সিংহভাগ পরিবার রাস্তায় নামতে রাজি। গোটা গ্রাম শুনতে চায়, করিৎকর্মা ছেলের ইওরোপবিজয়কাব্য। ফলে ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে, ক্লাব না পেলেও, অনেকে ফিরে যেতে চায় না। অন্য এক রাষ্ট্রের চোখে অপরাধী হয়ে তারা গা ঢাকা দিয়ে থাকে। ছোটখাটো কাজ খুঁজে বেড়ায়। গলাধাক্কা খায়।
২০০৮ সালে 'অবজার্ভার' পত্রিকার বিদেশ-প্রতিনিধি ড্যান ম্যাগডোগাল ফ্রান্সে ঘুরে ঘুরে এই ধরনের ফুটবল-দাসদের সঙ্গে দেখা করেন। ড্যান প্রথম আলাপে সিমন নামের একটি ছেলের গল্প বলেছিল আমাকে। প্যারিসের সেন্ট জার্মান ক্লাবে খেলার জন্য মাত্র দু’মাসের ভিসা নিয়ে সিমন ফ্রান্স আসে ক্যামেরুন থেকে। দিনদশেকেই সে বুঝে যায় সে ফাঁদে পড়েছে। সিমনের মা ক্যামেরুনের একটি স্থানীয় বারে কাজ করে। এজেন্টকে একটু একটু করে টাকা শোধ করে মাইনে থেকে। অনিঃশেষ দুঃখে কুঁকড়ে গিয়ে সিমন প্রথমেই ভেবে নেয়, সত্যটা লুকোতে হবে। বাড়িতে সে জানিয়ে দেয়, খেলা ভালো চলছে। খুব শিগগির এজেন্টকে দেওয়ার জন্য মোটা টাকা পাঠাবে সে। প্রতিবার ফোন রাখার আগে সিমনের মা বলেন, শুধু তিনি নন, ক্যামেরুনের ছোট্ট গ্রামটার সব্বাই তার জন্যে গর্বিত। সিমনের চোখের কোটরে জল জমে। এই সিমনদেরই গ্রামতুতো, দেশতুতো ভাই, যারা চোরাপথে ইউরোপে যাবার মতোও যোগ্য নয়, সেই ‘জিরো’-দেরই ঠাঁই ভারতে বা নেপালের মতো আরও সস্তার বাজারে।
আরও পড়ুন- পথে যে বিবস্ত্র, সে আমার কেউ না
২০১৮ সালের ১৬ মে পিট প্যাটিসন 'দ্য গার্ডিয়ান' পত্রিকায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তুলে ধরেন, কীভাবে হাজার হাজার আফ্রিকান কিশোর-তরুণকে ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দিয়ে নেপালে চালান করে দেওয়া হয়েছে। নেপালে এসে ওই তরুণরা বুঝতে পেরেছেন, কোনও ক্লাব তাদের জন্য অপেক্ষা করছে না। ২৭০০ ডলারের জন্য তাদের সস্তা শ্রমের বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ঋণ নিয়ে দেশছাড়া, তাই খালি হাতে দেশে ফেরা যাবে না। এদিকে নেপালের ফুটবল ফেডারেশন বলছে, ক্লাবের আমন্ত্রণ থাকলে তবেই এই বিদেশিরা বৈধ। দেশে ফেরার জায়গা নেই, যেখানে থাকা সেখানেও জুটেছে অবৈধ ট্যাগ, ওরা এবার স্থানীয় ক্লাবগুলিতে নামে-বেনামে খেপ খেলে।
এই খেপ খেলতে যাওয়ার পথে আমি ওদের দেখেছি, খেপ খেলার মাঠে আপনিও ওদের দেখতে পারেন। ওদের যন্ত্রণার শরিক হওয়া সম্ভব নয়। জার্সি গায়ে দেশ ছেড়ে, স্বজন ছেড়ে, ভাষা ছেড়ে অন্যত্র অপরাধীর মতো মুখচোরা বেঁচে থাকার জার্নাল অলিখিত, অপঠিতই থাকে। আধুনিক ফুটবল এই দাসব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে। আজ উত্তরাধুনিক ফুটবল দেখতে বসে যখন চোখে পড়ে, বিশ্বমানের ফুটবলাররা যন্ত্রের তালে তালে চলছে, একচুল নড়লে যন্ত্র শাস্তি দিচ্ছে, খেলাটা যান্ত্রিক হয়ে গিয়েছে, ক্রমে অমানবিকীকরণ হচ্ছে, তখন মনে মনে বলি, বেশ হয়েছে। বোঝো এবার দাসশরীর বয়ে বেড়ানোর জ্বালা। যখন দেখি কালোবাঁদররা সাদাদের ট্রে়ড সিক্রেট ধরে ফেলেছে তখন মনে হয়, আইসক্রিম কিনে খাই।
মনে পড়ে ছোটবেলায় দেখা সেই শরীরগুলোর কথা, যাদের গায়ের রং দেখে, আত্মবিশ্বাসে ভর করে আমরা চিৎকার করে বলেছি, চিমা! ওকোরো! ওরা হেসেছে। গোলে বল জড়িয়ে দ্রুত বল তুলেও নিয়েছে আবার। ওরা তো মানুষ নয়। দাস। দাসেদের খেলা থামে না। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ খেলা চলবে।