হার্ট, লিভার, ফুসফুস অথবা কিডনি, মৃত ব্যক্তির অঙ্গেই জীবনমুখী হাজার হাজার রোগী

Organ Transplant : ব্রেন ডেথে মৃত একজন ব্যক্তির হার্ট, লিভার, ফুসফুস, কিডনি অথবা কর্নিয়ায় নতুন জীবন পাচ্ছেন আরও অনেক মানুষ

সৈনিক তিনি। তাই মৃত্যুর পরেও জীবন বাঁচানোর কারিগরের পদে অটুট রইলেন। ব্রেন ডেথ হয়ে মারা যাওয়া ২৭ বছরের কর্পোরাল শচীন নতুন জীবনের পথ দেখালেন আরও অনেককে। তাঁর হার্ট, লিভার, ফুসফুস, উভয় কিডনি এবং কর্নিয়া দিল্লির AIIMS এবং আর্মি রিসার্চ অ্যান্ড রেফারেল হাসপাতালে দান করা হয়েছে।

ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, গত ১২ ডিসেম্বর মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে নয়া দিল্লির আর্মি হাসপাতাল, রিসার্চ অ্যান্ড রেফারালে (এআরএইচএইচ) নিয়ে আসা হয়েছিল ২৭ বছর বয়সী ভারতীয় সেনা কর্পোরাল শচীনকে। চিকিৎসকদের হাজার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, তরুণ কর্পোরালকে বাঁচানো যায়নি। অতঃপর ১৪ ডিসেম্বর চিকিৎসকেরা ঘোষণা করেন যে তাঁর ব্রেন ডেথ হয়েছে।

একজন তরুণ সৈনিকের অকাল মৃত্যু যেমন একদিন দেশের অপূরণীয় ক্ষতি ঠিক তেমন অন্যদিকে ক্ষতি তাঁর পরিবারেরও। সদ্য বিবাহিত ছিলেন কর্পোরাল শচীন। তাঁর এই আকস্মিক মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই ভেঙে পড়েছে তাঁর পরিবার। কিন্তু একজন সৈনিকের যোগ্য পরিবারের মতোই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা।

সূত্র মারফৎ জানা গিয়েছে, তাঁর স্ত্রী মনীষা এবং বাবা-মা তার অঙ্গ দান করতে সম্মতি দিয়েছেন। সেই মতো নয়া দিল্লির মেদান্ত মেডিক্লিনিকে পাঠানো হয়েছে ফুসফুস। অন্যদিকে একটি কিডনি এবং উভয় কর্নিয়া ব্যবহার করা হয় আর্মি হাসপাতালে। প্রতিটি অঙ্গই সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে সেনামন্ত্রক।

আরও পড়ুন - ভারতে আবার ভাইরাসের হানা! কীভাবে সংক্রমণ, কতটা ক্ষতিকর?

ব্রেন ডেথের ঘটনায় মৃত ব্যক্তির অঙ্গ প্রতিস্থাপন এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি মাইলফলক। চুক্ষ দানের নজির অবশ্য বহুদিন ধরেই প্রকাশ্যে আসে তবে বিজিত কয়েক বছরে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের হিসেবটিও যথেষ্ট নজর কেড়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও যে মন সচেতনতা বৃদ্ধি হচ্ছে তা সার্বিকভাবে উন্নতি সাধন করতে পারে এই সমাজেরই।

আমাদের দেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়ে আইন (ট্রান্সপ্লান্ট অফ হিউম্যান অরগ্যানস অ্যাক্ট) পাশ হয় ১৯৯৪ সালে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি মাইলফলক।এরপরই তামিলনাড়ু বা মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্য ইনটেনসিভ থেরাপি ইউনিটে রোগীর ব্রেন ডেথ হলে তা ঘোষণা করা বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে এ ঘটনা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। খোদ কলকাতাতেও ব্রেন ডেথের পর অঙ্গ প্রতিস্থাপনের নজির নতুন নয়। মাঝে করোনার সময় বছর দেড়েক এই প্রতিস্থাপনের ঘটনা বন্ধ থাকতো নিউ নর্মালে আবারও ফিরেছে এই অভ্যাস। ২০১৩ সালে কলকাতার আইপিজিএমইআর (সাধারণ ভাবে যা পরিচিত এসএসকেএম হাসপাতাল হিসেবে) কে রিজিওনাল সেন্টার ফর অরগ্যান ট্রান্সপ্লান্টের তকমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ তারপর থেকেই আরও বেশি সচেতনতার আলো পেয়েছে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিষয়টি। মানুষ বুঝতে শিখেছে এর গুরুত্ব। তাই এখন আকচার রক্ত অথবা চক্ষুদানের পাশাপাশি মরণোত্তর দেহদানের ঘটনাও সামনে আসছে।

ব্রেন ডেথের পর অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মধ্য মৃত মানুষটি বেঁচে থাকতে পারবেন আরও অনেকের মধ্যে। এমন যুগান্তকারী পদক্ষেপের বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব যখন মানুষের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। যদিও এ ঘটনাকে এখন আর বিরল বলা চলে না। গোটা দেশেই এখন এই উদাহরণের সাক্ষী থাকছে অহরহ।

শুধু দিল্লির এআরএইচএইচ সংস্থার এ বছরের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের হিসেবটা দেখলেই চমকে যেতে হয়। গত এক বছরে নয়টি হার্ট, চারটি লিভার এবং একাধিক কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে এই সংস্থা।সরকারী তথ্য অনুসারে, বেসরকারি হাসপাতালের পুনরুজ্জীবনের ফলেও নয়া দিল্লিতে অঙ্গ দান এবং প্রতিস্থাপন কর্মসূচি বেড়েছে। দিল্লির ARHH এবং অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস (AIIMS)-এর যৌথ প্রয়াসে এই কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত হয়েছে বলেই জানা গিয়েছে। অন্যদিকে রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতাল হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি পুনরায় শুরু করেছে বলেও জানা গিয়েছে। এআরএইচএইচ সূত্র আরও বলেছে, যে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ছয় থেকে সাতটি অঙ্গ দানের ঘটনা ঘটে। শুধুমাত্র ব্রেন দেথের ফলে মৃত্যু হলেই শরীরে অন্যান্য অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়, অন্যথায় হার্ট অ্যাটাকের কারণে মৃত্যুর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র চোখ দান করার অনুমতি রয়েছে আমাদের দেশে।

আরও পড়ুন - ব্রেনের মধ্যে ছোট্ট চিপ, তাতেই ধরা পড়বে শারীরিক গতিবিধি, এলন মাস্কের আবিষ্কার তাক লাগাবেই

করোনা আবহে দেশব্যাপী লকডাউন চলাকালীন, ভারতের অঙ্গদানের হার ব্যাপকভাবে ধাক্কা খেয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অঙ্গদান এবং জনসাধারণকে এই বিষয়ে সচেতন করার জন্য প্রচারাভিযান চালানো শুরু হয়েছে। করোনা চলাকালীন হায়দ্রাবাদের কৃষ্ণা ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস (KIMS)-এর অতিরিক্ত ডিরেক্টর এবং চিফ ট্রান্সপ্লান্ট পালমোনোলজিস্ট ডক্টর ভিজিল রাহুলান জানিয়েছিলেন, কীভাবে অঙ্গদানের হার হ্রাস পেয়েছিল। এবং পাশাপাশি বাড়তে থাকে সম্ভাব্য প্রাপকের সংখ্যাও। এরপর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে আসে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও। মানুষের মধ্যে অঙ্গ দান নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অঙ্গ দানের মাধ্যমে কিভাবে সমাজের মূল স্রোতে ফিরেছেন হাজার হাজার মুমূর্ষ রোগী সে বিষয়ে প্রচার চালায় তারা। তথাকথিত যে সংস্কার মানুষ মনের মধ্যে পুষে রেখেছিল মৃত্যু ঘিরে সেই মিথ নিয়ে ভয় কাটাতেও অগ্রসর হয় তারা।

ORBO, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (BSF) এর সহযোগিতায় ২০২১-২০২২ জুড়ে কর্মীদের সেবা দেওয়ার জন্য একটি গণ শপথ প্রচারের আয়োজন করেছিল। গ্লোবাল অবজারভেটরি অন ডোনেশন অ্যান্ড ট্রান্সপ্লান্টেশন ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের নিরিখে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। শুধু তাই নয় এই প্রচেষ্টায় ভারত পিছনে ডেকেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনকেও।

আমাদের দেশে ২৭ নভেম্বর পালন করা হয় জাতীয় অঙ্গদান দিবস। ২০১৩ সালের এই আইন আজ অনেকটা পথ পেরিয়ে গিয়েছে। কোভিড-এর আগের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে, এই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১২,৭৪৬, প্রতি বছরে। তারপর মহামারী এই প্রথাকে খানিকটা মন্দার দিকে টেনে নিয়ে গেলেও সমাজ পরিবর্তনের কারিগররা মোটেই হাল ছাড়েননি। দিকে দিকে আবারও সামনে আসছে সচেতনতার নজির। মানুষই পারেন সমাজ বদলাতে, এ তাই বিশ্বাস চিরকালীন।

More Articles