অবশেষে বাস্তব হতে চলেছে অসম্ভব! এইডস এবার সারবে 'কাঁচি' দিয়েই?
CRISPR AIDS Recovery: ওষুধ এইচআইভি-র ডিএনএ-কে দমিয়ে রাখে, যাতে সে আর নিজেদেরকে সংখ্যায় বাড়িয়ে তুলতে না পারে। ওষুধের ভূমিকা এখানে এতটাই।
এইডসের নিরাময় সম্ভব হতে পারে কাঁচি দিয়েই। তবে যে সে কাঁচি নয়। এর ডাকনাম আণবিক কাঁচি বা মলিকিউলার সিজার। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে সংক্ষেপে বলে ক্রিস্পার। নেদারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ আমস্টার্ডামের বিজ্ঞানীদের ধারণা, ক্রিস্পার প্রযুক্তির সাহায্যে সহজেই আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে নির্মূল করা যাবে এইডসের ভাইরাস।
এইচআইভি শরীরে ঢুকলে প্রথমেই আক্রমণ করে আমাদের রোগপ্রতিরোধী কোশগুলিকে। আর তারপরে নিজেদের ভেতরে থাকা ডিএনএ – যা কিনা অনায়াসেই আবার আরএনএ-তে রূপান্তরিত হতে পারে – তা ঢুকিয়ে দেয় রোগপ্রতিরোধী কোশের ভেতর। যার ফলে এই কোশগুলি নিজেদের রোগপ্রতিরোধী ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এদিকে এই কোশগুলির ভেতরে এইচআইভি-র ডিএনএ গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে দিনের পর দিন। সেই ডিএনএগুলি আবার নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করে, তিলে তিলে নিজেদের সংখ্যায় বাড়িয়ে তোলে। ফলে ভাইরাসটিও আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে একপ্রকার রয়ে যায়।
আরও পড়ুন- সদ্য হওয়া মায়েদের জীবন শেষ করছে যে ভয়াবহ রোগ
প্রসঙ্গত, এ যাবৎ এইচআইভি-প্রতিরোধী কোনও টিকা আবিষ্কার না হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কার হওয়া ওষুধ রোগীদের সুস্থ রাখে। তবে তার মানে কিন্তু এই নয় যে এই ওষুধ শরীর থেকে ভাইরাসটিকে চিরতরে নির্মূল করে ফেলবে। আদতে এই ওষুধ এইচআইভি-র ডিএনএ-কে দমিয়ে রাখে, যাতে সে আর নিজেদেরকে সংখ্যায় বাড়িয়ে তুলতে না পারে। ওষুধের ভূমিকা এখানে এতটাই। শেষমেশ ভাইরাসের ডিএনএ কিন্তু শরীরে থেকেই যায়। আর তাই সুস্থ থাকতে গেলে এই ওষুধ রোজ নিয়ম করে নিতেই হবে। নতুবা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে শরীরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা এইচআইভির ডিএনএ। বিজ্ঞানীদের এখন লক্ষ্য ক্রিস্পারকে হাতিয়ার করে শরীরে ওই ঘাপটি মেরে বসে থাকা এইচআইভি-র ডিএনএ-গুলিকে একেবারে নির্মূল করা। প্রকারান্তরে যা আদতে গোটা ভাইরাসকেই শরীর থেকে সমূলে উৎখাত করবে। এর আগে নানারকম পদ্ধতি অবলম্বন করেও এইটা করা যায়নি।
ক্রিস্পার আদতে জিন এডিটিং-এর হাতিয়ার, যার সাহায্যে সিকেল সেল অ্যানিমিয়া থেকে শুরু করে নানারকম জেনেটিক অসুখ সারানো যায়। সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার চিকিৎসার জন্য ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইংল্যান্ডে ক্রিস্পার প্রযুক্তি অনুমোদনও পেয়েছে। ক্রিস্পার কীভাবে কাজ করে একটু সহজ করে বলা যাক। যে জিনে খুঁত থাকার কারণে একটি জেনেটিক অসুখ হয়, ক্রিস্পার গিয়ে হাজির হয় সেই ডিএনএ-এর কাছে যেখানে সেই খুঁত থাকা জিনটি বসে রয়েছে। ক্রিস্পার গিয়ে সেই জিনটিকে কাঁচির মতো কেটে দেয়। আর সেই শূন্যস্থানে খুঁত থাকা জিনটির বদলে বসিয়ে দেওয়া হয় স্বাভাবিক জিনকে। এইডস নির্মূল করতে হলে, এইচআইভি-র ডিএনএ-এর নির্দিষ্ট একটি জায়গাকে কাঁচির মতো কেটে দেবে ক্রিস্পার। আর সেখানে বসিয়ে দেওয়া হবে এমন একটি জিন, যা এইচআইভি-র আস্ত ডিএনএ-কেই অকেজো করে দেবে। ব্যস কেল্লা ফতে!
আরও পড়ুন-আদৌ কি টিকায় নির্মূল হয় এই রোগ? কীভাবে মানব শরীরে প্রথম প্রবেশ করেছিল এইডস?
অন্তত ইউনিভার্সিটি অফ আমস্টার্ডামের বিজ্ঞানী এলেনা হেরেরা ক্যারিলোর এবং তাঁর সহকর্মীরা কাঁচের পাত্রে (পেট্রিডিশ) রাখা এইচআইভি-আক্রান্ত রোগপ্রতিরোধী কোশে ক্রিস্পার প্রযুক্তি প্রয়োগ করে এমনটাই দেখেছেন। তবে এখনও ল্যাবরেটরির ইঁদুরের শরীরে এই পরীক্ষা করে দেখা বাকি। সেই ধাপ পেরোলে শুরু হবে হিউম্যান ট্রায়াল অর্থাৎ কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যাক এইচআইভি-আক্রান্তদের শরীরে ক্রিস্পার প্রয়োগ করে তাঁদের শরীর থেকে এইচআইভি সমূলে উৎখাত করার পরীক্ষা। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল যদি সফল হয়, একমাত্র তখনই সাধারণ মানুষের চিকিৎসার কাজে ব্যবহার শুরু হবে এই প্রযুক্তির। এইচআইভি নির্মূলে এই প্রযুক্তি কতখানি সফল হবে, সেই ভাবনার পাশাপাশি এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করলে কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে এবং সেগুলি কতখানি ভয়ের, সে চিন্তাও রয়ে যাচ্ছে।
লন্ডনের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের জোনাথন স্টয়ের মতে, ল্যাবরেটরিতে এই পরীক্ষার ফল উৎসাহিত হওয়ার মতোই। যদিও অ্যানিম্যাল এবং হিউম্যান ট্রায়ালই শেষ কথা বলবে।
২০২২ সালে স্যান ফ্রান্সিসকোর জৈব-প্রযুক্তিক সংস্থা এক্সিশন বায়োথেরাপিউটিকসও ক্রিস্পারকে হাতিয়ার করে এইচআইভি-কে চিরতরে নির্মূলের লক্ষ্যে এগিয়ে গেছিল। তিনজন এইচআইভি-আক্রান্তর শরীরে ক্রিস্পার প্রয়োগ করেও দেখা হয়। গত বছর সেই পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত গবেষক ও ডাক্তাররা জানান, এই চিকিৎসা সুরক্ষিত এবং কোনও গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। কিন্তু তাঁরা এই পরীক্ষা নিয়ে কোনও রকম তথ্য প্রকাশ না করায়, বিশেষজ্ঞ মহলে জল্পনা শুরু হয়, আদৌ এই চিকিৎসা সফল হয়েছিল কিনা। এমনকী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়েও কোনও তথ্য প্রকাশ হতে দেখা যায়নি সংস্থার পক্ষ থেকে। এক্সিশন বায়োথেরাপিউটিকসের প্রাথমিক ল্যাবরেটরি-ভিত্তিক গবেষণাতে যদিও এইচআইভি আক্রান্ত ইঁদুরের চল্লিশ শতাংশই সেরে উঠেছিল।