রোগী নয়, রোগের মৃত্যু! পোলিও মুক্তির অসম্ভব যেভাবে সম্ভব হলো এদেশে

Polio Free India: ভারতবর্ষের সর্বশেষ পোলিও আক্রান্ত শিশুটির নিবাস এই পশ্চিমবঙ্গেই।

রোগ থেকে মৃত্যু সর্বকালীন সত্য কিন্তু রোগের মৃত্যু? শুনতে আশ্চর্য লাগলেও একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব জনস্বাস্থ্য কার্যক্রমের সাফল্যের সুবাদে এই আপাত অসম্ভব আজ বাস্তব। জনস্বাস্থ্যের ইতিহাসে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার আমরা একটি রোগকে চিরতরে বিদায় জানাবার সম্মুখীন| সত্তরের দশকের শেষের দিকে গুটি বসন্ত রোগ নির্মূল হয় গোটা বিশ্ব থেকে। টিকাকরণ কর্মসূচির বিশ্বব্যাপী প্রয়োগ এবং সাফল্যের নিরিখে এটি একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়। এই সাফল্যে ভর করে ১৯৮৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল এবং অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত হয় পোলিও উন্মুলন কর্মসূচি।

পোলিও একটি ভাইরাস জনিত সংক্রামক ব্যাধি এবং শিশুদের পঙ্গুত্বের অন্যতম কারণ। পোলিও উন্মুলন কর্মসূচি প্রথম গৃহীত হওয়ার সময়ে সারা বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার শিশু এই রোগে আক্রান্ত হয়ে সারা জীবনের মতো পঙ্গুত্বের শিকার হতো। বিগত প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে এই বিশ্বব্যাপী পোলিও নির্মূল প্রয়াসে যোগদান করেছে প্রায় দু' কোটি স্বেচ্ছাসেবক এবং স্বাস্থ্যকর্মী যারা পোলিও প্রতিষেধক টিকা পৌঁছে দিয়েছে প্রতিটি ঘরে ঘরে – ‘পালস পোলিও’ কর্মসূচির মাধ্যমে। ফলস্বরূপ, আজ পোলিওর সংক্রমণ ও এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকেছে। ভারতবর্ষের সর্বশেষ পোলিও আক্রান্ত শিশুটির নিবাস এই পশ্চিমবঙ্গেই। কলকাতা থেকে অদূরে, ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে পাওয়া গেছিল এদেশের শেষতম পোলিও আক্রান্ত শিশু। এরপর আরও তিন বছর কোনও নতুন পোলিও রোগে আক্রান্ত শিশুর সন্ধান না মেলায় আজ থেকে ঠিক এক দশক আগে, ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ভারতবর্ষ তথা সমগ্র দক্ষিণপূর্ব এশিয়াকে পোলিও রোগ মুক্ত ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

নবজাতকের প্রথম টিকাকরণ: মধুবনী, বিহার

পোলিও নির্মূল করার ভারতবর্ষের এই সাফল্য জন স্বাস্থ্য কর্মসূচির ইতিহাসে এক অনন্য, নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। কেন্দ্রীয় তথা রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধান, আন্তর্জাতিক সহযোগ, স্বাস্থ্যকর্মীদের অনলস একনিষ্ঠতা এবং সর্বোপরি তৃণমূলস্তরে স্বেচ্ছাসেবক ও টিকাকর্মীদের নিরন্তর পরিশ্রম - এই সকলের এক অসাধারণ সমন্বয়ে বাস্তবায়িত হয়েছিল পোলিও নিধন যজ্ঞ। আসমুদ্র হিমাচল ভারতবাসী এই কর্মসূচিতে সামিল হয়ে পোলিওকে চিরতরে নির্বাসিত করতে সক্ষম হয়। যার ফলে আজ এক দশক পরেও এ দেশের শিশুরা এই ভয়ানক রোগের থেকে সুরক্ষিত। দেশের জনপ্রিয় তারকারাও সামিল হয়েছিলেন এই কার্যক্রমকে মানুষের আরও কাছে পৌঁছে দিতে। বারো-মাসে-তেরো-পার্বণের এই দেশ যেন আরও একটি উৎসব খুঁজে পেয়েছিল ‘পোলিও রবিবার’-গুলির মাধ্যমে।

কোশি নদীর বন্যাপীড়িত এলাকায় পোলিও টিকাকরণ কর্মসূচি : মধুবনী, বিহার

আরও পড়ুন- জীবনের ৭২ বছর লোহার ফুসফুসে বেঁচে আছেন! অবাক করবে এই বৃদ্ধের কাহিনি

তবে, বিশ্বের নানা প্রান্তে অসামান্য সাফল্যের পরও পোলিও নির্মূল করার কাজ আজও অসম্পূর্ণ। মূলত রাজনৈতিক অস্থিতরতা ও ভৌগোলিক অবস্থানগত বাধা বিপত্তির জেরে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান - এই দুই দেশে পোলিও তথা অন্যান্য টিকাকরণ কর্মসূচি অনেকাংশেই ব্যাহত হচ্ছে। এই অঞ্চলের বিক্ষিপ্ত হিংসাত্মক ঘটনায় স্বাস্থ্য তথা জনহিতকর কর্মসূচির ব্যাঘাত ঘটেছে, এমনকী বেশ কিছু স্বাস্থ্যকর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবক নিহতও হয়েছেন। মানব সমাজের কিছু অংশের এই আত্মঘাতী অভিমুখ সম্ভবত আপামর ভাইরাসকুলকেও বিব্রত করবে।

নবজাতকের প্রথম টিকাকরণ : পুরুলিয়া, পশ্চিমবঙ্গ

করোনা অতিমারীর আবর্তে ভারতবর্ষের আজকের এই পোলিও-মুক্তি ঘোষণার দশকপূর্তি ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। করোনা ভাইরাসের মতোই পোলিও ভাইরাস বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে খুব দ্রুত ছড়াতে সক্ষম। স্বভাবতই, ভারত তথা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলি পোলিও-মুক্ত হলেও পোলিও বিপদমুক্ত নয়, যতদিন না বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে পোলিও নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে। নিয়মিত টিকাকরণের মাধ্যমে শিশুদের যথাযথ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা একান্ত জরুরি। অন্যদিকে, পোলিও কর্মসূচির দেশব্যাপী সাফল্য ও অভিজ্ঞতা করোনা ভাইরাস টিকাকরণ পরিকল্পনার জন্য এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

পোলিও টিকাকরণ কর্মসূচির সাফল্যের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে দৃঢ়ভাবে আশা করা যায় যে, শিশুদের স্নায়ুতন্ত্রে নয়, খুব শীঘ্রই পোলিও ভাইরাসের স্থান হবে জন স্বাস্থ্য কর্মকাণ্ডের উজ্জ্বল সাফল্যের ইতিহাসের পাতায়।

 

ছবি: পোলিও টিকাকরণ কর্মসূচি ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিরীক্ষণ: মোরাদাবাদ, উত্তর প্রদেশ

 

লেখক ডাঃ আনন্দ শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম কলকাতায়। কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে স্বর্ণপদক পেয়ে ডাক্তারি ডিগ্রি লাভ ও পরবর্তীকালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতোকত্তোর পড়াশোনা বিশ্ব জন স্বাস্থ্য নিয়ে। কর্মজীবনের প্রথমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে পোলিও নির্মূলের জন্য কাজ এবং বিগত প্রায় দেড় দশক বিশ্বব্যাপী পোলিও ভাইরাস ও টিকাকরণ গবেষণায় নিয়োজিত। বর্তমানে তাঁর নিবাস ও কর্মস্থল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটেল শহরে। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ব বিদ্যালয়ে সংক্রামক ব্যাধি ও টিকাকরণ সংক্রান্ত বিষয়ের অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত।

More Articles