দূষণে নাভিশ্বাস, রাজধানী দিল্লি পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হবে?
Air pollution in Delhi: ভারতের রাজধানীর ধোঁয়া চিত্র বদলাচ্ছে না। সাম্প্রতিক দূষণের পরিমাণ দেখে চমকে উঠছেন সাধারণ মানুষ।
ভোর হলেই চারিদিকে ঘন ধোঁয়া। আর এই ধোঁয়া গোটা এলাকা ঢেকে রেখেছে। গাড়ি চালানোই দায় হয়ে উঠছে। একপ্রকার প্রাণ হাতে নিয়েই রাস্তায় বেরোতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এই মুহূর্তে দিল্লির ছবিটা ঠিক এমনই। বিগত কয়েক বছরেও ভারতের রাজধানীর ধোঁয়া চিত্র বদলাচ্ছে না। রাজনীতি, অপরাধ, খুন ইত্যাদি ঘটনার পাশাপাশি দূষণের জন্যও খবরের শিরোনামে জায়গা করে নিচ্ছে দিল্লি। সাম্প্রতিক দূষণের পরিমাণ দেখে চমকে উঠছেন সাধারণ মানুষ। কোন জায়গার বাতাস কতটা দূষিত, সেটা জানতে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআইয়ের দিকে নজর থাকে বিজ্ঞানীদের। সেখানেই উঠে এসেছে ৪ ডিসেম্বর, রবিবারের হিসেব। দেখা যাচ্ছে, ২৪ ঘণ্টার গড় হিসেবে দিল্লির এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ৪০৭!
এই খবরেই নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। গত নভেম্বর থেকে এই দূষণের ভয়াবহতা চিন্তায় রেখেছে আধিকারিকদের। তাই তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নেওয়ার পথে হাঁটল তারা। কেন্দ্র সরকারের এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট কমিশন বা সিএকিউএম (Commision for Air Quality Management) একটি বিশেষ নির্দেশিকা জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, দিল্লিজুড়ে এই মুহূর্তে অনেক নির্মাণকাজ চলছে। যে কাজগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কেবলমাত্র সেগুলি বাদ দিয়ে বাকি যাবতীয় নির্মাণকাজ আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হবে। পাশাপাশি কোথাও কোনও ইমারত ভাঙার কাজ চললে সেটাও বন্ধ করে দিতে হবে। গ্রেডেড রেসপন্স অ্যাকশন প্ল্যানের তৃতীয় পর্যায়ে যে কাজগুলি রয়েছে সেগুলির ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। রেল, মেট্রো, এয়ারপোর্ট, ডিফেন্স, হাইওয়ে এবং রাস্তা তৈরির মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন : আর কিছুদিনেই পরিত্যক্ত নগরী হতে চলেছে রাজধানী দিল্লি! বিষের বাষ্পে যে ইঙ্গিত
তবে কেবল নির্মাণকাজই নয়। ইটভাটা থেকেও প্রবল দূষণ ছড়ায়, এই ব্যাপারটি অনেকেরই জানা। অভিযোগ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইটভাটাগুলিতে পরিশ্রুত জ্বালানি ব্যবহার করা হয় না। ফলে দূষণের মাত্রা আরও বাড়ে। সেই ইটভাটাগুলোকেও অবিলম্বে সমস্ত কাজ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে যানবাহনের দিকেও বিশেষভাবে নজর দেওয়া হয়েছে। বিএস থ্রি পেট্রোল এবং বিএস ফোর ডিজেল গাড়িগুলির ক্ষেত্রে কড়া সিদ্ধান্তও নেওয়ার ভাবনায় প্রশাসন। ওই গাড়িগুলি থেকে অত্যাধিক দূষণ ছড়ায় বলে বারবার অভিযোগ এসেছে। রাজধানীর দূষণ কমাতে ভবিষ্যতে আরও অনেক পদক্ষেপ নেওয়ার পথে হাঁটতে পারে দূষণ নিয়ন্ত্রক কমিশন।
কোনও জায়গায় বায়ুদূষণের মাত্রা কতটা ভয়াবহ, সেটা নির্ণয় করার একটি বিশেষ স্কেল আছে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে সেই সূচকগুলিকেই চিহ্নিত করা হয়। এই সূচক ০ থেকে ৫০-এর মধ্যে থাকলে বাতাসের অবস্থা সবচেয়ে ভালো থাকে। ৫০-১০০ এর মধ্যে থাকলে সেটাকে ভালোর মধ্যেই ধরা হয়। তবে ২০০-র ওপরে গেলেই কপালে ভাঁজ পড়া শুরু হয় পরিবেশবিদদের। ২০১ থেকে ৩০০-র মধ্যে হলে খারাপ, ৩০১ থেকে ৪০০-র মধ্যে থাকলে বিপজ্জনক এবং ৪০০-র ওপরে থাকলে অতি বিপজ্জনক অবস্থা। এই শেষ ধাপটিতে রয়েছে দিল্লি।
আরও পড়ুন : ধোঁয়ার জেরে জাঁকিয়ে বসছে অবসাদ! চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আনলেন বিজ্ঞানীরা
তবে ডিসেম্বরেই এমন অবস্থা প্রথম হল, এমনটা নয়। গত নভেম্বরের শুরুতে দিল্লির এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স চলে যায় ৪৪৭-এর অঙ্কে। সেই সময়ও দিল্লি এনসিআর এলাকায় নির্মাণকাজ বন্ধের পথে হেঁটেছিল দূষণ নিয়ন্ত্রক কমিশন। উল্লেখ্য, সেই সময় ছিল দীপাবলি ও অন্যান্য উৎসবের মরসুম। দূষণ নিয়ন্ত্রণে কড়া মনোভাব দেখালেও আখেরে লাভের লাভ যে কিছু হয়নি, তা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সেই স্পষ্ট। সেই সময় দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের মাসিক ৫০০০ টাকা দেওয়ার ঘোষণা করেন। এবারও সেই ব্যবস্থা শুরু হবে কিনা, সেটাই দেখার।
বিগত কয়েক বছর ধরে বারবার বায়ুদূষণে জেরবার হয়েছে দেশের রাজধানী। কেবল বাতাসই নয়, যমুনা-সহ বেশকিছু নদী ক্ষতিকারক রাসায়নিক মিশ্রিত ফোমে ভরে গিয়েছিল। তার মধ্যেই স্থানীয় মানুষেরা নিজেদের কাজকর্ম করেছেন। নভেম্বরের দূষণে ফের ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ নীতি প্রয়োগ হয় দিল্লিতে। শিশুদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি। শহরের রাস্তায় জল ছিটিয়ে, ধোঁয়া প্রতিরোধক মেশিন ব্যবহার করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ডিসেম্বরের শুরুতেও একই পরিস্থিতি সম্মুখীন সেখানকার মানুষজন।
আরও পড়ুন : মাতৃদুগ্ধেও প্লাস্টিক! রোজ যাচ্ছে শিশুর পেটে! ভয়াবহ তথ্য এবার সামনে
কেন বায়ু দূষণের এমন সমস্যা? কেবল দিল্লি নয়, উত্তর ভারতের একটা বড়ো অংশের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। সেইসঙ্গে রয়েছে চাষের ইস্যুও। দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানার একটা বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে কৃষিক্ষেত। শীতের ঠিক আগে আগে ফসল কাটা হয়ে যায় কৃষকদের। সমস্ত কিছু ঘরে তুলে শীতের চাষের প্রস্তুতি শুরু হয়। মূলত এই সময়ই বিপত্তির সূত্রপাত। ফসল কাটার পর তার অবশিষ্ট অংশ এক জায়গায় জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলেন কৃষকরা। এই বিপুল বর্জ্য, জঞ্জাল পোড়ানোর ফলে তৈরি হয় ক্ষতিকারক ধোঁয়া। সেই ধোঁয়াই ক্রমশ গ্রাস করে দিল্লি সহ উত্তর ভারতের একটা বড়ো অংশকে।
সেইসঙ্গে থাকে কারখানা, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া। নির্মাণকাজের ফলে ছোটো ছোটো মাইক্রো পার্টিকলও ধোঁয়ায় মিশে যায়। ফলে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স নিজের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধোঁয়ায় থাকে ক্ষতিকারক গ্যাস সহ অসংখ্য ছোট ছোট ধূলিকণা। শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে যা শরীরের ভেতর ঢুকে পড়ে। কেবল শ্বাসযন্ত্র নয়, এই দূষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মস্তিস্কও। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বক্তব্য, এই সমস্যা আজকের নয়, বহুদিনের। এর জন্য কৃষকদেরও সম্পূর্ণ দায়ী করা ঠিক নয়। বৈজ্ঞানিক উপায়ে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। কৃষকদের কাছেও সেই সমাধান পৌঁছে দিতে হবে। এর ফলে তাঁরাও উপকৃত হবেন, দূষণের সমস্যাও কমবে। আপাতত এই সমাধান খোঁজার চেষ্টাতেই প্রশাসন। নয়তো এই দূষণ সমস্যা স্বাভাবিক জনজীবন নষ্ট করে দেবে, পরিত্যক্ত করে দেবে দিল্লিকে, এমনটাই আশঙ্কা পরিবেশবিদদের।