সইফ আলি খানের আক্রমণকারী পরিচয়ে বাংলাদেশি বলেই এত বিতর্ক?

Saif Ali Khan Bangladeshi Attack: সইফ আলি খানকে আক্রমণ করেছিলেন যে ব্যক্তি, তাঁর নাম মহম্মদ শরিফুল ইসলাম। তিনি আদতে বাংলাদেশের বাসিন্দা।

১৬ জানুয়ারি নিজেরই বাড়িতে দুষ্কৃতীর হামলায় ভয়ানকভাবে আহত হয়েছিলেন বলিউডের অভিনেতা সইফ আলি খান। খানিক সিনেমার পর্দায় দেখা দৃশ্যের মতো ঘটনাই ঘটে গিয়েছিল বাস্তবে। ডাকাতি রুখতে গিয়ে হামলাকারীর ছুরিতে ৬বার আহত হন সইফ। চলে হাতাহাতি। তারপর অবশ্য সদ্য সইফ খানিক সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। সিসিটিভি দেখে দুষ্কৃতীকে গ্রেফতারও করা গেছে। তবে নতুন একটি বিষয় নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। বিষয়টি আর কেবলই অভিনেতার নিরাপত্তা নিয়ে নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও।

জানা গেছে, সইফ আলি খানকে আক্রমণ করেছিলেন যে ব্যক্তি, তাঁর নাম মহম্মদ শরিফুল ইসলাম। তিনি আদতে বাংলাদেশের বাসিন্দা। সাত মাস আগে ভারতে আসেন তিনি। অবৈধ উপায়ে ডাউকি নদী পাড়ি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন তিনি। ভারতের মোবাইল সিম কার্ড পেতে এই রাজ্যের জনৈক বাসিন্দার আধার কার্ড ব্যবহার করেন এবং শেষমেশ চাকরির সন্ধানে মুম্বই চলে যান। মুম্বই পুলিশ বলছে, মহাম্মদ শরিফুল ইসলাম ওরফে বিজয় দাস যে সিম কার্ডটি ব্যবহার করেছিল তা পশ্চিমবঙ্গের 'খুকুমনি জাহাঙ্গীর সেখ'-এর নামে নথিভুক্ত করা হয়। এই নামের ব্যক্তির আধার কার্ডই ব্যবহার করা হয়েছিল বলে সন্দেহ পুলিশের।

পুলিশের দাবি, শরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন যে তিনি বাংলাদেশে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তাঁর দুই ভাই আছে এবং চাকরির সন্ধানেই তিনি ভারতে এসেছেন। শরিফুল দাবি করেছেন, ভারতে আসার জন্য মেঘালয়ের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ডাউকি নদী পার হয়েছিলেন তিনি। আর ভারতে এসে বিজয় দাস নামে জাল পরিচয় ব্যবহার করেছিলেন বলে অভিযোগ। পশ্চিমবঙ্গে কয়েক সপ্তাহ থাকার পর, শরিফুল মুম্বইয়ে এসে এমন জায়গায় কাজ করতে যান যেখানে নথিপত্রের প্রয়োজন ছিল না। শ্রমিকদের ঠিকাদার অমিত পাণ্ডে শরিফুলকে ওরলি এবং থানের পাব এবং হোটেলগুলিতে কাজ পেতে সাহায্য করেছিলেন বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন- ফেলানি খাতুন থেকে স্বর্ণা দাস! যেভাবে সীমান্তে বারবার প্রাণ যায় সাধারণ বাংলাদেশিদের…

পুলিশ বলছে, জিজ্ঞাসাবাদে শরিফুল ইসলাম প্রথমে দাবি করেছিলেন যে তিনি কলকাতার বাসিন্দা। পুলিশ তাঁর মোবাইল তল্লাশি করতে গিয়ে দেখে বাংলাদেশের নম্বরে বেশ কয়েকটি ফোন করা হয়েছে। পুলিশ তখন শরিফুলের পরিবারকে ফোন করে এবং বাংলাদেশে শরিফুলের এক ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়। সেখান থেকেই মেলে পরিচয়পত্র, যে নথিপত্রে শরিফুল যে আসলে বাংলাদেশি নাগরিক তা নিশ্চিত করা রয়েছে।

পুলিশ আরও বলছে, সইফ আলি খানের বাড়িতে ঢোকার আগে শরিফুল ইসলাম নাকি প্রতিবেশী বলিউডের আরেক সুপারস্টারের একটি বাংলোতেও ঢোকার চেষ্টা করেন। সেখানে কুকুরের আওয়াজে তিনি পালিয়ে যান। সইফের বাড়িতে যাওয়ার সময় একটি ছুরি ও অন্য কিছু সরঞ্জাম সঙ্গে নেন শরিফুল। জানা গেছে, সইফ আলি খানের বাড়ি থেকে পালানোর পর, অভিযুক্তরা বান্দ্রার একটি কলেজের কাছে একটি বাগানে ঘুমিয়ে পড়ে। সেখানেই তাঁরা পোশাকও পরিবর্তন করেন। তারপর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তন্নতন্ন করে খুঁজে রবিবার গ্রেফতার করা হয় শরিফুলকে।

কিন্তু কেন শরিফুল সইফের বাড়িতে চুরি করতে গিয়েছিলেন? পুলিশের দাবি, শরিফুল জানিয়েছেন, তাঁর মা অসুস্থ। মাকে সাহায্য করার জন্য কিছু টাকা লুঠ করে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। সইফের বাড়ি বাছার পিছনে কোনও নির্দিষ্ট কারণ নেই। কোনও একজন বড়লোকের বাড়িতে চুরি করাই ছিল লক্ষ্য। শরিফুল এখানে এসে একটি কাজ জুটিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু যে রেস্তোরাঁয় কাজ করছিলেন, সেই রেস্তোরাঁর সঙ্গে জিতেন্দ্র পাণ্ডের ম্যানপাওয়ার এজেন্সির চুক্তি শেষ হয়ে যায়। ফলে কাজও চলে যায়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে থানের একটি রেস্তোরাঁয় কাজ শুরু করেন শরিফুল। এর আগে ওরলির একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন তিনি। মাসে ১৩,০০০ টাকা পেতেন। মায়ের চিকিৎসার জন্য ১২,০০০ টাকা পাঠাতেন বাংলাদেশে। অগাস্ট মাসে তিনি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন এবং তাঁর চাকরি চলে যায়। এরপর থানের এক রেস্তোরাঁয় কম বেতনে একটি কাজ পান।

শরিফুল বাংলাদেশি, এই পরিচয় প্রকাশ্যে আসার পরেই, সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটের বিচারে ব্যাপক বিতর্ক চলছে। শরিফুল অপরাধ করেছেন। বিচার হবে। কিন্তু তাঁর বাংলাদেশি পরিচয়কে নিয়ে রাজনৈতিক ঘোলাজলে নিজের নিজের পছন্দের মাছ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলি। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে শিবসেনার (উদ্বভ শিবির) সাংসদ সঞ্জয় রাউত বিজেপিকে আক্রমণ করেছেন। সঞ্জয় রাউত বলছেন, সব বাংলাদেশিকে দেশ থেকে 'সরিয়ে' দিতে হবে। আআর শুরুটা করতে হবে শেখ হাসিনাকে দিয়ে। গত বছরের অগাস্টে বাংলাদেশে গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে আসেন হাসিনা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পদত্যাগও দাবি করেছে শিবসেনা।

আরও পড়ুন- ৫০ বছর পর প্রকাশ্যে মুজিবের হত্যাকারী মেজর ডালিম! ফিরবেন বাংলাদেশে?

মহারাষ্ট্রের বিরোধীরা মুম্বইয়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য শাসক মহাযুতি সরকারের নিন্দা করেছে। প্রতিবেশী দেশ থেকে অবৈধ অভিবাসীদের এই দেশে আসা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার বিচারে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশি=অপরাধী তা প্রমাণ করে প্রায় সাজা ঘোষণাও হয়ে গেছে। বাংলাদেশিরা অবৈধভাবে এই দেশে ঢুকে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। কীভাবে নিরাপত্তা নিয়ে এত ঢাকঢাক-গুড়গুড় সত্ত্বেও নথিপত্র ছাড়া সীমান্ত পার হচ্ছেন ওপারের মানুষ? কাগজপত্র পাওয়া, চাকরি পাওয়া এবং তারপর অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়াতে কি রাষ্ট্রীয় মদতই আছে তবে? বিজেপি আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য অবশ্য চেনা পরিচিত মুসলিম-তাসই খেলেছেন। অমিত মালব্য বলছেন, সাইফ আলি খানকে যিনি আক্রমণ করেছিলেন তিনি বাংলাদেশি মুসলিম যিনি হিন্দু পরিচয় ভাঁড়িয়েছিলেন। "হিন্দুদের অপমান করার জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত," বলেও নিদান তাঁর।

শরিফুলের জবানবন্দি অনুযায়ী তিনি একজন দরিদ্র বাংলাদেশি। তাঁর কাজ নেই, বাড়িতে অসুস্থ মা। টাকা রোজগার করতে গিয়ে অনিশ্চয়তা এবং অল্প সময়ে অধিক উপার্জনের লোভ তাঁকে অপরাধের পথে নিয়ে গেছে। এই অপরাধে বিচার কাম্য। কিন্তু শরিফুল একে মুসলিম, তায় বাংলাদেশি! ফলে সোশ্যাল মিডিয়াতে বহু 'শিক্ষিত'দের নিদানও সঞ্জয় রাউতের মতোই। বাংলাদেশিদের বের করে দেওয়াটাই নিরাপত্তা রক্ষার একমাত্র উপায় যেন। ভারতে বিভিন্ন মহানগরে বাংলাদেশের নাগরিকের সংখ্যা কম নয়। তা সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের ঢের আগে থেকেই। পড়াশোনা, চাকরি, সম্পর্ক নানা কারণেই দুই দেশের মানুষের বোঝাপড়া আছে। তবে এই মুহূর্তে দুই দেশের সম্পর্কই অস্থির। সেই আবহে মুসলিম ও বাংলাদেশি দুই পরিচয়ই ভীষণভাবে রাজনৈতিক। সেই পাকেচক্রে শরিফুলের ভবিতব্য নিছক কোনও চোর বা ডাকাতের মতো রইল না আর।

More Articles