৪৬ হাজার মৃত, অনাহারে সাড়ে তিন লাখ! যুদ্ধের ১৫ মাসে যা যা ক্ষতি হয়েছে গাজার

Israel Gaza War: বিমান হামলায় নিহত প্রায় ১০,০০০ মানুষ গুঁড়িয়ে যাওয়া বাড়ির তলায় চাপা পড়ে গিয়েছে বলে মনে করা হয়। তাঁদের লাশ বের করার মতো পরিকাঠামোও নেই গাজায়।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজার গোষ্ঠী হামাস ইজরায়েলে মিসাইল হামলা করে। আনুমানিক ১,২০০ মানুষের মৃত্যু হয় এবং ২৫১জনকে বন্দি করে নিয়ে আসে গাজায়। এর ঠিক পরেই ইজরায়েল এই হামলার প্রতিশোধ নিতে গাজা আক্রমণ করে। সেই আক্রমণ চলল টানা ১৫ মাস! এই দেড় বছরে গাজা ধ্বংস হয়ে গেছে, ৪৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বড় অংশই শিশু। ১৫ মাস পর অবশেষে যুদ্ধবিরতি। আপাতত ছয় সপ্তাহের যুদ্ধহীনতা, যা আগামীতে আরও অনেকটা সময়ই বাড়ানো হবে বলে আশা। ১৯৪৮ সালের সংঘাতের পর এটিই ইজরায়েলের দীর্ঘতম যুদ্ধ।

৭ অক্টোবর হামাস জঙ্গিদের হাতে নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন সাধারণ নাগরিক এবং হামলার মাত্রা ও নৃশংসতাও ছিল নজিরবিহীন। ইজরায়েল পাল্টা হামলায় শতগুণ নৃশংসতা ফিরিয়ে দিয়েছে গাজাকে। তবে এর আগে ২০২৩ সালের নভেম্বরে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতি এবং বন্দি মুক্তির চুক্তি হয়েছিল। তখন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হামাসকে সম্পূর্ণভাবে নিকেশ না করা অবধি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথাই বলেছিলেন। কথামতোই, গণহত্যা চলেছে। যুদ্ধের কোনও আন্তর্জাতিক নীতিই মানেনি ইজরায়েল। নেতানিয়াহু এবং তাঁর প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। হামাসের সামরিক নেতা মহম্মদ দেইফের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আর এই প্রায় ৪৬০ দিনের অবিশ্রান্ত যুদ্ধে গাজা মানচিত্র থেকে প্রায় মুছেই গিয়েছে। গাজার চেহারা, মানুষের দুর্দশা অবর্ণনীয়।

আরও পড়ুন- অবশেষে যুদ্ধবিরতি! ছয় সপ্তাহ পরে কী ঘটবে গাজায়? রহস্য জিইয়ে রাখল ইজরায়েল

গাজায় নিহত ও আহত

গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, ইজরায়েলি হামলায় গাজায় ৪৬,০০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই সাধারণ নাগরিক। সংখ্যাটা গাজায় যুদ্ধপূর্ব জনসংখ্যার প্রায় ২%। মৃতদের মধ্যে ১৩,৩১৯ জনই শিশু। সবচেয়ে কম বয়সি মৃতের বয়স ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টা। মৃতদের মধ্যে ১০১ বছরের বৃদ্ধাও ছিলেন। প্রায় ১১০,০০০ মানুষ আহত হয়েছেন, যাদের এক চতুর্থাংশের বেশির আঘাত ভয়াবহ। বহুজনের অঙ্গহানি ঘটেছে, বীভৎসভাবে পুড়ে গিয়েছে এবং মাথায় গভীর আঘাত রয়েছে।

তবে এই পরিসংখ্যান থেকে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর সম্পূর্ণ ছবি পাওয়া সম্ভব না। যুদ্ধে নিহতদের সরকারি গণনায় কেবলমাত্র বোমা ও বুলেটে নিহত ব্যক্তিদের, যাদের মৃতদেহ উদ্ধার ও সমাধিস্থ করা হয়েছে এমন মানুষেরই নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বিমান হামলায় নিহত প্রায় ১০,০০০ মানুষ গুঁড়িয়ে যাওয়া বাড়ির তলায় চাপা পড়ে গিয়েছে বলে মনে করা হয়। এই চাপা পড়া মানুষদের সন্ধান করার জন্য ওই বিপুল ইস্পাত এবং কংক্রিটের ধ্বংসাবশেষ খননের দরকার। তার জন্য ভারী সরঞ্জাম বা জ্বালানির প্রয়োজন। আর এসব কিছুই আর গাজায় নেই।

এই মাসে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুদ্ধের প্রথম নয় মাসে ট্রমাজনিত আঘাতের ফলে মৃত্যুকে সরকারি সংখ্যায় অন্তর্ভুক্তই করা হয়নি। আশঙ্কা, ২০২৪ সালের অক্টোবরেই মৃতের সংখ্যাটা সম্ভবত ৭০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে।

খাবার, আশ্রয় এবং ওষুধের অভাব, সংক্রামক রোগের দ্রুত বিস্তার এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ার কারণে আরও অনেক ফিলিস্তিনির প্রাণ গেছে।

ভিটেমাটিহীন মানুষ

ইজরায়েলের তীব্র বোমা হামলা এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞে গাজার কিছু অংশ একেবারেই ধ্বংসস্তূপ হয়ে গিয়েছে। আশেপাশের এলাকাগুলিও আর বাসযোগ্য নেই। জাতিসংঘের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, গাজায় প্রতি ১০টি বাড়ির মধ্যে নয়টি বাড়িই ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ, কবরস্থান, দোকান ও অফিসও গুঁড়িয়ে গেছে। ধ্বংসযজ্ঞ এতটাই তীব্র যে বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, ব্যাপক আকারে বাড়িঘর এবং দৈনন্দিন জীবনের পরিকাঠামো ধ্বংস করাকে একটি নতুন যুদ্ধাপরাধ হিসাবে স্বীকৃত করা উচিত।

আরও পড়ুন- একদিনের শিশু, ৩০০০ ভ্রুণকে হত্যা ইজরায়েলের! গাজায় আর শিশুদিবস আসবে?

যেখানে বাড়িঘর এখনও দাঁড়িয়ে আছে সেখানে বাসিন্দাদের থাকার অবস্থা নেই। গাজার ভূখণ্ডের ৮০ শতাংশ এলাকাতেই বাসস্থান উচ্ছেদ হয়ে গেছে। প্রায় ১.৯ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সংখ্যাটা মোট জনসংখ্যার ৯০%। লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন তাঁবুতে বসবাস করছে। না আছে নিকাশী ব্যবস্থা, না আছে বিশুদ্ধ পানীয় জল। ইজরায়েল এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলিতেও হামলা চালিয়েছে।

গাজাকে পুনর্নির্মাণ করার জন্য শুরু করার অভাবনীয় কোনও অভূতপূর্ব পরিকল্পনা প্রয়োজন এখন। যুদ্ধে ৪০ মিলিয়ন টন ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট রয়েছে। এসব সরাতে এক দশকেরও বেশি সময় লাগতে পারে।

স্কুল এবং শিক্ষাব্যবস্থা

গাজার প্রায় প্রতিটি স্কুলবাড়িই ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজার ৬৬০,০০০ স্কুল-বয়সি শিশু এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ পায়নি। এই যুদ্ধের ফলে গাজার শিক্ষাব্যবস্থা পাঁচ বছর পিছিয়ে গেছে। স্থায়ীভাবে শারীরিক ও মানসিক আঘাত পাওয়া একটা বড় প্রজন্মই হারিয়ে যেতে বসেছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ৫৬৪টি স্কুলবাড়ি ছিল। এর মধ্যে ৫৩৪টি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে এবং ১২টি ক্ষতির মুখে। ইউনিসেফের অক্টোবরের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাকি ১৮টি স্কুলের অবস্থা বর্তমানে জানাই যায়নি।

অনেক স্কুলই জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে সেখানেও ইজরায়েল বোমা ফেলেছে। ইজরায়েলের দাবি, হামাস যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। ইজরায়েলের দাবি, স্কুলবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে হামাস যোদ্ধারা এবং নাগরিকদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে তারা।

আরও পড়ুন-পৃথিবী আবার শান্ত হবে! গাজায় যুদ্ধবিধ্বস্ত কিশোরীদের স্বপ্ন দেখায় বক্সিং

হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা

যুদ্ধের সময় ইজরায়েলি বাহিনী বারবার বোমাবর্ষণ করেছে গাজার হাসপাতালে। চিকিৎসকদের হত্যা করা হয়েছে, আটক ও নির্যাতন করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)জানিয়েছে, যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে ৬৫৪টি আক্রমণ হয়েছে।

নার্স, প্যারামেডিকস, ডাক্তার এবং অন্যান্য চিকিৎসা কর্মী সহ ১,০৫০ জনেরও বেশি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী নিহত হয়েছেন। বহুজনকে আটক করা হয়েছিল, এবং কমপক্ষে তিনজন ইজরায়েলি হেফাজতে মারা গিয়েছেন।

২০২৪ সালের শেষে, গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৭টি আংশিকভাবে কার্যকর ছিল। ১১টি ফিল্ড হাসপাতাল চালানো হয় কিন্তু ইজরায়েল সাহায্য এবং ত্রাণ কর্মীদের ঢুকতে না দেওয়াতে চিকিৎসার অভাব দেখা দেয়। ২০২৪ সালে ১.২ মিলিয়নেরও বেশি শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ঘটেছে এখানে, ৫৭০,০০০জন আক্রান্ত হন তীব্র ডায়রিয়ায়।

খাবার ও সাহায্যের ঘাটতি

গাজায় মানবিক সাহায্য ঢুকতে বাধা দিয়েছে ইজরায়েল। ব্যাপক দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টির সৃষ্টি হয় গাজায়। জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজায় দুই বছরের কম বয়সের ৯৬% শিশু এবং মহিলারা তাঁদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাচ্ছে না। ৩৪৫,০০০ জন মানুষ খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হয়েছে এবং ৮৭৬,০০০ জন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন।

গর্ভাবস্থায় অপুষ্টি এবং শৈশবেই মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। তাই যে শিশুরা যুদ্ধ থেকে বেঁচে গেছে তারা খাদ্য ঘাটতির কারণে আজীবন ভুগতে চলেছে।

পরিবেশ

গাজার অন্তত অর্ধেক গাছ শেষ হয়ে গেছে। মাটি ও জল ভয়াবহভাবে দূষিত এবং কৃষি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই ধ্বংস বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্য, খাদ্য নিরাপত্তা এবং বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা পরিবেশবিদ ও শিক্ষাবিদদের।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, গত অগাস্টের শেষের দিকে ইজরায়েলি সেনাবাহিনী ৫৪টি জলাশয়ের মধ্যে অন্তত ৩১টি ক্ষতিগ্রস্থ বা ধ্বংস করেছে। গোলাবারুদ এবং আগুনের বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ মাটি এবং জল দুই-ই দূষিত করেছে।

 

More Articles