১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় প্রাক্তন বিএনপি নেতার মুক্তি! কোন বার্তা দিচ্ছে বাংলাদেশ?
Bangladesh Arms Haul Case: সাক্ষীদের জবানবন্দিতে জানা যায়, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্যই ওই অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশের জলসীমা ব্যবহার করে আনা হয়েছিল।
প্রায় ২১ বছর আগের এক দিন। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা বা সিইউএফএল জেটিঘাটে খালাসের সময় ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক করা হয়েছিল। অস্ত্রের পাশাপাশিই ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয় পাঁচ ব্যক্তিকেও। পরের দিন, ২ এপ্রিল পুলিশি প্রহরায় ওই আটক অস্ত্র চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইনসে নিয়ে যাওয়া হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সেদিন আটক হওয়া অস্ত্র পরিদর্শনও করেন। কর্ণফুলী থানায় অস্ত্র আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে অস্ত্র চোরাচালানের অভিযোগে দু'টি মামলা দায়ের হয়। ঘটনার ১০ বছর পর, ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এক রায়ে অস্ত্র চোরাচালান মামলায় প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া এবং দু'টি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৪ জনকে ফাঁসির আদেশ দেয়। অস্ত্র আইনে করা অন্য মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হয় এই একই আসামিদের।
২১ বছর পরে, অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনায় অস্ত্র আইনে করা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ছয়জন মুক্তি পেলেন। উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াসহ পাঁচজনের সাজাও কমানো হয়েছে। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের করা আপিলের শুনানি শেষে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এই রায়ে জানিয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াকে ১৪ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর আগে ১৮ ডিসেম্বর, এই অস্ত্র চোরাচালানের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের আদেশ থেকে মুক্তি পান লুত্ফুজ্জামান বাবরসহ ছয়জন।
আরও পড়ুন- ব্রিটেনের মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ! মাসি শেখ হাসিনার সঙ্গে দুর্নীতিতে যুক্ত টিউলিপ সিদ্দিকও?
লুৎফুজ্জামান বাবর ছাড়া প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির প্রয়াত মতিউর রহমান নিজামীও যাবজ্জীবনের সাজা থেকে মুক্তি পেয়েছেন পেয়েছেন। তিনি মারা যাওয়ায় তাঁর আপিলকে 'অ্যাবেট' (পরিসমাপ্তি) ঘোষণা করে হাইকোর্ট। এছাড়া যাবজ্জীবনের সাজা থেকে মুক্তি পাওয়া অন্য চারজনের মধ্যে আছেন রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) প্রাক্তন পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও শিল্প মন্ত্রকের প্রাক্তন অতিরিক্ত সচিব নুরুল আমিন।
মতিউর রহমান নিজামী ছাড়াও আরও তিনজনের আপিলের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। তাঁরা হলেন এনএসআইয়ের প্রাক্তন মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মহ. আবদুর রহিম, শ্রমিক সরবরাহকারী দ্বীন মহম্মদ ও ট্রলারমালিক হাজি সোবহান।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ১৪ জনের মধ্যে পরেশ বড়ুয়াসহ পাঁচজনের সাজা কমানো হয়েছে। পরেশ বড়ুয়ার সাজা এখন ১৪ বছর করা হয়েছে। বাকি চার আসামির সাজা কমিয়ে ১০ বছর করা হয়েছে। এই চারজন হলেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সংস্থার তৎকালীন মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, এনএসআইয়ের প্রাক্তন উপপরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন, তৎকালীন পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ ও হাফিজুর রহমান।
আরও পড়ুন- ৫০ বছর পর প্রকাশ্যে মুজিবের হত্যাকারী মেজর ডালিম! ফিরবেন বাংলাদেশে?
২০০৪ সালে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের জেটিতে যে ১০ ট্রাক অস্ত্র ও গোলাবারুদ আটকের ঘটনা ঘটে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে ধরা পড়া অস্ত্র চোরাচালানের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ। সাক্ষীদের জবানবন্দিতে জানা যায়, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্যই ওই অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশের জলসীমা ব্যবহার করে আনা হয়েছিল। মোট ৪৬৩টি বাক্স অস্ত্র উদ্ধার করা হয় যেগুলির মধ্যে ছিল এমটিটি, এসএমজি, টমিগান ৭৯০টি, গ্রেনেড ২৭ হাজার, রকেট লঞ্চার ১৫০, ম্যাগজিন ৬২০ এবং ১১ লাখ ৪৩ হাজার ৫২০টি গুলি। এগুলির আনুমানিক মূল্য ২৭ হাজার কোটি টাকা। জানা যায়, উলফা চিন থেকে এই অস্ত্র কিনে কিউসি নামের একটি জাহাজে করে বাংলাদেশের জলসীমায় নিয়ে আসে এই বিপুল অস্ত্র এবং দুটি ‘কনটেইনার বোট’-এ করে বাংলাদেশের ভূমিসীমায় তা অবতরণ করায়। চট্টগ্রাম থেকে তারপর স্থলপথে ভারতে উলফার কাছে এই অস্ত্র পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল।
হাসিনা সরকারের পতনের পর নিঃসন্দেহে এই রায় এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। লুৎফুজ্জামান বাবর ছিলেন বিএনপির সরকারের সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। লুৎফুজ্জামান বাবর ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নেত্রকোনা-৪ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সাংসদ হন। প্রাক্তন বিএনপি নেতার মুক্তি কি বাংলাদেশের বর্তমান বিএনপিকে নতুন করে সাহস জোগাবে, প্রশ্ন উঠছেই।