শঙ্কুর শেষ গল্পে লুকিয়ে ছিল বাবরি মসজিদ ভাঙার অশনি সংকেত?
Satyajit Ray Professor Shanku: শঙ্কুর শেষ কাহিনিতে যখন স্বৈরতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থার বিরোধিতা করছিলেন সত্যজিৎ, তখন তাঁর দেশের রাজনীতির অবস্থা কী?
গিরিডি-নিবাসী ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুকে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করেছিলেন সত্যজিৎ। শঙ্কু যা ছিলেন, আর শেষ অবধি শঙ্কু যা হলেন- দুয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য। সে তো হতেই পারে। লিখতে লিখতে কোনও একটা চরিত্র সম্বন্ধে লেখকের মনোভঙ্গি অনেক সময় বদলে যায়। শঙ্কুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ শঙ্কু সিরিজের প্রথম লেখা, ধারাবাহিকভাবে তিন কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল সন্দেশ পত্রিকায়– আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ ১৩৬৮ সংখ্যায়। শঙ্কুর শেষ পূর্ণাঙ্গ কাহিনি ‘স্বর্ণপর্ণী’ প্রকাশ পেল পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলার ১৩৯৭ সংখ্যায়। 'ব্যোমযাত্রীর ডায়রি'-তে শঙ্কু প্রোফেসর চ্যালেঞ্জারের মতোই রাগী। বাড়ির কাজের লোক প্রহ্লাদকে নস্যাস্ত্র মেরে তেত্রিশ ঘণ্টা হাঁচিয়ে মেরেছিলেন। 'স্বর্ণপর্ণী'-র শঙ্কু একেবারেই এজাতীয় ‘অনৈতিক’ কাজের পক্ষপাতী নন। সত্যজিৎ যখন ‘স্বর্ণপর্ণী’ লিখছিলেন, সেই সময়েই ‘আগন্তুক’ ছবির কাজ করছিলেন। সত্যজিতের ‘আগন্তুক’ গভীর অর্থে রাজনৈতিক ছবি। এই ছবিতে বামপন্থী উৎপল দত্তকে সত্যজিৎ প্রধান চরিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি সচেতনভাবে কতগুলি কথা সত্যজিতের হয়ে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেন। সেই চরিত্র, মনমোহন মনে করে, পুঁজিকেন্দ্রিক প্রযুক্তিনির্ভর নগরসভ্যতা যে রাষ্ট্রতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে, সেই রাষ্ট্রতন্ত্র প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। প্রকৃতি-সংলগ্ন জনজাতিগুলো যে জীবনযাপনে অভ্যস্ত, তার মধ্যে শিল্প-সংস্কৃতি-বিজ্ঞানের নানা চিহ্ন খুঁজে পাওয়া সম্ভব, অথচ আধুনিক সভ্যতা সেকথা স্বীকার করে না। ভেষজ উদ্ভিদের জ্ঞানে ও প্রয়োগে আধুনিক মানুষের ভরসা নেই। প্রকৃতি-সংলগ্ন জনজাতির শৈল্পিকতা ছবিতে, নৃত্যে, গীতে প্রকাশিত– এই চলচ্চিত্রের শেষের দিকের দৃশ্যে শান্তিনিকেতন-সংলগ্ন সাঁওতাল পল্লিতে সেই শিল্প-সংস্কৃতির পরিচয় মেলে।
এমনিতে সত্যজিৎ মৃণাল সেনের মতো প্রত্যক্ষ রাজনৈতিকতার ছবি করেন না বটে, কিন্তু তাঁর ছবিতে বড় অর্থে রাজনীতির নানা স্তর চোখে পড়ে। তাঁর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিটি যে অর্থে রাজনৈতিক, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিটি সে অর্থে রাজনৈতিক নয়। 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' ছয়ের দশকের গোড়ায় মুক্তি পেয়েছিল, সেই ছবিতে পারিবারিকতার গল্প, সম্পর্কের টানাপড়েন এসবের মাঝেও পক্ষীপরিদর্শক ভালোমানুষটির মুখে পাখির যাত্রাপথ ভুলিয়ে দেওয়া মারণাস্ত্র পরীক্ষারত রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা উচ্চারিত হয়েছিল। সেই অংশটুকু ‘আগন্তুক’ ছবিতে আরেকটু বিস্তারে পুনরাবৃত্ত। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে রাজনীতি আরও প্রত্যক্ষ– বিশেষ করে ইন্টারভিউয়ের দৃশ্যে। চাকরি-প্রত্যাশী রাগী যুবকটিকে ইন্টারভিউ বোর্ডের টাই-পরিহিত কর্তারা জিজ্ঞাসা করেন, "আর ইউ এ কমিউনিস্ট?" মানুষের চন্দ্রাভিযানের চাইতে ভিয়েতনামের যুদ্ধ তার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে এই জিজ্ঞাসা তার প্রতি ধেয়ে আসে।
কেবল বড়দের ছবিতে নয়, ছোটদের ছবি নিহিতার্থে রাজনৈতিক করে তুলতে সত্যজিতের জুড়ি মেলা ভার। উপেন্দ্রকিশোরের গুপী-বাঘা তাঁর হাতে যুদ্ধবিরোধী রূপকথায় রূপান্তরিত। আর ‘হীরক রাজার দেশে’ তো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার নানা পর্যায়কে তুলে ধরছে। স্বৈরাচারী শাসক হিরের খনির শ্রমিক আর মজুরদের খাটিয়ে মারেন। গণতন্ত্রহীন ব্যবস্থায় মানুষের মগজধোলাই করে ইচ্ছেমতো কথা বসান। অন্য দেশের অতিথিদের নিজের রাজ্যের ভালো দিকগুলোকেই দেখান। মুক্তচিন্তার বিদ্যালয় বন্ধ করে দেন। এই ছবিতে গুপী-বাঘা কৌশলে মগজ ধোলাইয়ের যন্ত্রে রাজা ও তাঁর মন্ত্রীদের বদলে দেন। তাঁরা ছবির শেষ দৃশ্যে হীরক রাজা স্বয়ং নিজের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। হীরক রাজা নিজেই নিজের মূর্তি ভেঙে খানখান করতে সাহায্য করেন। স্বৈরাচারী শাসকের মগজ ধোলাইয়ের এই গল্প ফিরে এল শঙ্কুর একটি গল্পে। আর শেষ গল্পে ফিরে এল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ববর্তী জার্মানির কথা– যুদ্ধের সলতে পাকানো তখন শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন: ‘সোনার কেল্লা’ কমেডি থ্রিলার, বলেছিলেন সত্যজিৎ
শঙ্কুর শেষ গল্পে সত্যজিৎ এই ভারতীয় বিজ্ঞানীর জীবনকথা পাঠকের সামনে তুলে ধরলেন। শঙ্কু যে সর্বরোগহর ওষুধটি আবিষ্কার করেছিলেন, তার পিছনে একটি ভারতীয় ভেষজের অবদান রয়েছে। সেই ভেষজটির সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন এক ভারতীয় সন্ন্যাসীর কাছ থেকে। এই ওষুধের গুণেই তাঁর বন্ধু সন্ডার্সের ক্যান্সার নিরাময় হয়েছিল। ১৯৩৭ সালে শঙ্কু এলেন হ্যাম্পস্টেডে সন্ডার্সের বাড়ি। প্রত্যক্ষ করলেন নাৎসি জার্মানির চরিত্র।
ডরথির কথা শুনে এটা বুঝলাম যে, ভারতবর্ষে বসে শুধু খবরের কাগজ পড়ে ইউরোপে কী ঘটছে না ঘটছে সে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা যায় না। গত কয়েক বছরে জার্মানিতে হিটলারের অভ্যুত্থান ও নাৎসি পার্টি সংগঠনের কথা অবিশ্যি জানতাম, কিন্তু সেটা যে কী ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে এবং হিটলারের আত্মম্ভরিতা ও তার শাসনতন্ত্রের যথেচ্ছচারিতা যে কোন স্তরে পৌঁছেছে, সেটা দেশে বসে বুঝতে পারিনি।
পাওয়ার-ম্যাড হিটলারের দলবলের সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করেছিলেন শঙ্কু, তাই সেই গল্পের বিষয়। শঙ্কু কৌশলে শেষ পর্যন্ত নাৎসিদের হাত থেকে মুক্তি পেলেন। তাঁর সর্বরোগহর নাৎসিদের হাতে যায়নি।
হিটলারের কথা যে কেবল শঙ্কুর এই শেষ গল্পেই এসেছে, তা কিন্তু নয়। নব্য নাৎসিদের কথা এসেছিল আরেকটি গল্পে। ‘শঙ্কু ও ফ্র্যাঙ্কেন্সটাইন’ গল্পে জানা যায় ‘হিটলারের চিন্তাধারা আবার জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করার’ চেষ্টা চলছে। সেই গল্পে নব্য নাৎসিদের নেতার মগজ ধোলাই করেছিলেন শঙ্কু। নব্য-নাৎসি রেডেলের মাথায় তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন বোরিস অ্যারনসনের মগজ। ফলে নাৎসি নেতা উলটো কথা বলতে শুরু করেন। মগজ ধোলাইয়ের পর যেমন হীরক রাজা নিজেই নিজের মূর্তি খান খান করার পক্ষে, তেমনই রেডেল বলে তার নাৎসি অনুচরদের, "তোমরা সব শয়তানের দল।"
শঙ্কুর শেষ কাহিনিতে যখন স্বৈরতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থার বিরোধিতা করছিলেন সত্যজিৎ, তখন তাঁর দেশের রাজনীতির অবস্থা কী? ভারতীয় রাজনীতিতে বাবরি মসজিদ বিতর্কের সূত্রপাতের কিছুটা পূর্ববর্তী সে সময়। হিন্দুত্ববাদী স্বৈরতন্ত্রের, এক ভাষা এক দেশের, এক ধর্ম এক দেশের উপসর্গগুলো উঁকি মারছে। সেই বিতর্কের পথ বেয়ে তারপর আজকের ভারতের রাজনীতি এত দূর। শঙ্কুর বদলে দেওয়া মগজের গুণে রেডেল বলে চলে, "তোমাদের জন্যই জার্মানি আবার জাহান্নমে যেতে চলেছে। এক্ষুনি চলে যাও আমার সামনে থেকে।" শঙ্কুর শেষ গল্প ‘স্বর্ণপর্ণী’-তে নাৎসি গোয়রিং বলে, "এ ওষুধ ব্যবহার করবে শুধু আমাদের পার্টির লোক। যারা পার্টির মাথায় রয়েছে তারাও নানান রোগে ভুগছে।" শঙ্কু হতে দেয়নি তা। ভেষজের সন্ধান দিয়েছিলেন যে প্রকৃতিপ্রেমী সন্ন্যাসী, সেই ভেষজের খবর যাঁদের হাতে, তাঁরা কেউ ক্ষমতা ও সম্পদকে কুক্ষিগত করে রাখতে চান না।
শঙ্কু জার্মানিতে যা করতে পেরেছিল, প্রয়োজনে তো তা সব দেশের স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধেই করা উচিত। শাস্তি একটাই– মগজ ধোলাই।