ফুরিয়ে যাচ্ছে আমাজন, চার দশকে যেভাবে কুঠার চলেছে বিশ্বের বৃহত্তম বৃষ্টিঅরণ্যে

Amazon Forest Deforestation: কখনও খনি খননের প্রয়োজন, তো কখনও কৃষিজমির দরকারে, কখনও বা গবাদি পশুর চারণভূমি তৈরি করার জন্য অবাধে নষ্ট করা হয়েছে জঙ্গল। দখল হয়ে গিয়েছে পৃথিবীর সাধের আমাজন।

ফুরিয়ে যাচ্ছে আমাজন। না, অনলাইন শপিং অ্য়াপ আমাজনের কথা বলা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে, বিশ্বের বৃহত্তম বৃষ্টিঅরণ্য আমাজনের। গত চার দশকে যা উজাড় হয়ে গিয়েছে মানুষের উৎপাতে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, একটা গোটা জার্মানি বা ফ্রান্সের আয়তনের জঙ্গল-এলাকা হারিয়ে গিয়েছে আমাজন বৃষ্টি অরণ্য থেকে। আর তার জন্য অবাধ বৃক্ষচ্ছেদন, জমি-ভরাটকেই দায়ী করেছেন গবেষকেরা।

দাপিয়ে বাড়ছে গরম। গলে যাচ্ছে হিমবাহ, বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রের জল। পাল্টে যাচ্ছে জলবায়ু। এই সমস্ত দুশ্চিন্তাই শুধু পরিবেশবিদদের। তাঁরা উদ্বিগ্ন পৃথিবী ধ্বংসের কথা ভেবে ভেবে। হুঁশ নেই পৃথিবীর জল-হাওয়া সম্পদ নিত্য ফুরিয়ে যারা বুকের হাঁপরে অক্সিজেন ভ'রে নেন, তাঁদেরই। বহু প্রচার, সচেতনতা সত্ত্বেও পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝানো যায়নি তাঁদের। তাই দিব্যি চলছে গাছ কাটা, পুকুর বুজিয়ে সাজিয়ে নেওয়া অট্টালিকা। হুঁশ যে নেই, তার প্রমাণ খোদ বিশ্বের বৃহত্তম রেইনফরেস্ট বা বৃষ্টি-অরণ্য আমাজনই।

মোট ন'টি দেশ জুড়ে বিস্তৃত দক্ষিণ আমেরিকার এই জঙ্গল পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কারণ এই জঙ্গলই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে একটা বড় অংশের কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে থাকে। সরবরাহ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় অক্সিজেন। ফলে ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ু সমস্যার জন্য লড়ার জন্য অত্যান্ত জরুরি এই আমাজন জঙ্গল।

আরও পড়ুন: শুকোচ্ছে আমাজন, চিরতরে বন্ধ হতে চলেছে চকলেটের জোগান?

কিন্তু সেই বৃহত্তম বৃষ্টিঅরণ্য ক্রমশ বহরে কমছে, ছোটো হচ্ছে আয়তনে। গবেষক ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা RAISG জানাচ্ছে, এর জন্য দায়ী গত চার দশক ধরে খনি খনন ও কৃষির প্রয়োজনে জঙ্গল উজাড় করে দেওয়া। গবেষণা জানাচ্ছে, ১৯৮৫ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আমাজনের বৃক্ষচ্ছায়ার প্রায় ১২.৫ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। সেই হারিয়ে যাওয়া বনভূমির পরিমাণ প্রায় ৮৮ মিলিয়ন হেক্টর অর্থাৎ ৮৮০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, গুয়ানা, সুরিনাম এবং ফ্রেঞ্চ গুয়ানা জুড়ে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা আমাজন বৃষ্টি-অরণ্য ক্রমশ ফুরিয়ে গিয়েছে।


কখনও খনি খননের প্রয়োজন, তো কখনও কৃষিজমির দরকারে, কখনও বা গবাদি পশুর চারণভূমি তৈরি করার জন্য অবাধে নষ্ট করা হয়েছে জঙ্গল। দখল হয়ে গিয়েছে পৃথিবীর সাধের আমাজন। বন নষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কমেছে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের পরিমাণ, যে কার্বন ডাই অক্সাইড প্রতিনিয়ত উৎপন্ন করছি আমরা। কার্যত এই বিপুল পরিমাণ বনভূমির হারিয়ে যাওয়া নষ্ট করছে আমাদের বাস্তুতন্ত্র, জলবায়ুর হাইড্রোলজিক্যাল চক্রকে ঘেঁটে দিচ্ছে একেবারে। ফলে প্রতিবছর লাফিয়ে বাড়ছে গরম।

চলতি বছর এল নিনোর প্রভাব গোটা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে ভয়ঙ্কর রকম গরমের। যে সব দেশে গরম পড়েই না বলতে গেলে, তারাও গরমের চোটে অস্থির এ বছর। আর যারা গ্রীষ্মপ্রধান দেশ, তাদের দেশে লাফিয়ে বেড়েছে গরমে মৃত্যুর সংখ্য়া। কোথাও গিয়ে এই ভয়াবহ গরম, আবহাওয়ার দ্রুত পাল্টে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে কিন্তু এই অবাধ বৃক্ষচ্ছেদন, আমাজন জঙ্গলকে নিশ্চুপে ফুরিয়ে ফেলার অপরাধ।

পেরুভিয়ান গবেষণায় অংশ নেওয়া ইনস্টিটিউট অফ দ্য কমন গুড সংস্থার প্রতিনিধি সান্দ্রা রিও ক্যাসেরেস জানাচ্ছেন, তাঁর বিশ্বাস আমাজনে এই বিরাট পরিমাণ গাছপালা ধ্বংসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আমেরিকার একাধিক দেশের ভয়াবহ খরা ও দাবানলের ঘটনাগুলি। ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক জানাচ্ছে, বিশ্বের বৃহত্তম গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলাভূমি এলাকা প্যান্টানালে দাবানলের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে বায়ুমণ্ডল থেকে শোষণ না হওয়া এই কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ। যা এতদিন নিশ্চুপে শোষণ করে ভারলাম্য বজায় রাখত আমাজন জঙ্গল।

পাশাপাশি জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর সমস্যাও আমাজন ও প্যান্টানাল জলাভূমিতে মারাত্মক দাবানলের জন্য দায়ী এবং ঝুঁকি সৃষ্টিকারী বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানী। কিছুদিন আগেই শোনা গিয়েছিল, শুকিয়ে যাচ্ছে আমাজন নদী। দক্ষিণ আমেরিকার এই নদীর জন্ম পেরু আন্দিজ পর্বতের নেভাদো মিসমি চূড়া থেকে। তার পর তিন দেশের উপর দিয়ে প্রায় তিন হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে পড়ে আমাজন। বিশ্বের সমস্ত নদীর থেকে এই নদীর জলের পরিমাণ বেশি বলেই এতদিন শোনা যেত। তবে সেই আমাজন নদীও বর্তমানে শুকিয়ে যাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। যার পলে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আমেরিকার একাধিক দেশ জুড়ে ভয়াবহ খরা দেখা দিচ্ছে সাম্প্রতিক কালে। যার ফলে বিপদের মুখে পড়েছে প্রায় ৪৭ মিলিয়ন জীবন। আর এই নদী শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে আমাজনের জঙ্গল ফুরিয়ে যাওয়া যে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত, তা মানেন বৈজ্ঞানিকেরা।

আরও পড়ুন: শুকিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম নদী! যে ভয়াবহ বিপদের মুখে আমাজন নদী

ব্রাজিল, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া এবং পেরুর মতো বহু জায়গাতেই এখনও কৃষিজমি পরিষ্কার করার জন্য আগুনের সাহায্য নেওয়া হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ক্ষেত কে ক্ষেত। সেই আগুন বহু সময়েই দাবানলের আকার নেয়। ক্ষতি হয় পরিবেশেরও। উৎপন্ন হয় অতিরিক্ত পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড। যা শোষণ করে নিতে পারত যে আমাজন জঙ্গল, তাকে তো আগেই ফুরিয়ে ফেলেছি আমরা। দূষণে দূষণে নষ্ট করে ফেলেছি নদীর জল। গোটা পৃথিবীটাকে কার্যত হাতড়ে-কামড়ে গভীর থেকে নিঃশেষ করে দিয়েছে এবং ক্রমাগত করে চলেছে মানুষ। এবার কি ফেরত দেওয়ার পালা প্রকৃতির? ধ্বংসের ঠিক কতটা সামনে আমরা? সেই উদ্বেগই নতুন করে বাড়িয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক এই গবেষণা।

More Articles