মুদির দোকানি থেকে বীরভূমের বেতাজ বাদশা, অনুব্রতর উত্থান হার মানাবে বলিউডকে
ভাগ্যের উত্থানপতন কাকে বলে, অনুব্রতকে না দেখলে টের পাওয়া যায় না। এই অনুব্রত মন্ডল, যাঁর নির্দেশে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়, সেই বেতাজ বাদশা আজ সিবিআইয়ের জালে।
এ যেন চোর-পুলিশ খেলা। অনেকবার লুকোচুরি খেলেও আর রেহাই পেলেন না অনুব্রত মন্ডল। রাখিপূর্ণিমার দিনেই গ্রেফতার দিদির প্রিয় কেষ্ট। ১০ বার তলবে হাজিরায় একবার সাড়া বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মন্ডলের। ১০ অগাস্টও হাজিরা এড়ান। অগত্যা লক্ষ্মীবারে কেষ্টর দুয়ারে সিবিআই। বাড়ি থেকে সোজা কেন্দ্রীয় সংস্থার জালে 'বাহুবলী’। ভাগ্যের উত্থানপতন কাকে বলে, অনুব্রতকে না দেখলে টের পাওয়া যায় না। এই অনুব্রত মন্ডল, যাঁর নির্দেশে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়, সেই বেতাজ বাদশা আজ সিবিআইয়ের জালে। তবে অনুব্রত রাতারাতি এভাবে বাদশা হয়ে ওঠেননি। ছিলেন সামান্য মুদি দোকানের মালিক। মাছও বিক্রি করেছেন একসময়। তাঁর উত্থানের বাঁকে বাঁকে রয়েছে চমক।
অনুব্রতর উত্থান
পশ্চিমবঙ্গের বুকে তৃণমূল নেতাদের মধ্যে সর্বদা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন বীরভূমের তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মন্ডল। কখনও 'খেলা হবে', আবার কখনও 'ভয়ংকর খেলা হবে’- ইত্যাদি হুঙ্কার দিয়ে সর্বদা থেকেছেন খবরের শিরোনামে। এমনকী, বীরভূম জেলার অনেকের মতে, তিনি এতটাই প্রভাবশালী যে, তাঁর কথায় বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়। রাজনীতিতে বিতর্কিত ব্যক্তি অনুব্রতর উত্থান যেন এক সিনেমার চিত্রনাট্য।
প্রচারমঞ্চ থেকে সংবাদমাধ্যমে সামনে থাকা দোর্দণ্ডপ্রতাপ এই নেতার কাহিনি শুনলে যে-কোনও সাধারণ মানুষের চোখ কপালে উঠবে। জানা যায়, রাজনীতিতে প্রবেশের আগে বাবার মুদির দোকানে কাজ করতেন। ফলে প্রশ্ন উঠতে পারে, এই অবস্থা থেকে কী করে উত্থান? বীরভূমবাসীর কথায়, অষ্টম শ্রেণি পাস করে তিনি তাঁর বাবার মুদির দোকানে কাজ শুরু করেন। তবে রাজনৈতিক প্রতিভা থাকার জন্য তাঁর উঠতে বেশি সময় লাগেনি।
আরও পড়ুন: অসুস্থতাকে হাতিয়ার করে আর কতদিন? সুতোয় ঝুলছে মমতার প্রিয় কেষ্টর ভবিষ্যৎ
প্রথম জীবনে অনুব্রত কংগ্রেস করলেও পরবর্তীকালে এই এলাকায় সদ্যপ্রয়াত চিকিৎসক সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল ছেড়ে চলে গেলে, আসেন কেষ্ট। এরপরই বীরভূমের জেলা সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। জেলা সভাপতি হিসেবে কাজ করতে করতে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহের পাত্র হয়ে ওঠেন। ফলে এরপর তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার পর কখনও 'খেলা হবে’, আবার কখনও 'চড়াম চড়াম ঢাক বাজবে’ ইত্যাদি বলে শিরোনামে থেকেছেন। এই নেতার নিজের শরীরের অবস্থাও ভালো নয়। বিভিন্ন রোগের পাশাপাশি অক্সিজেন নিতে অসুবিধে হয়। কিন্তু এরপরেও রাজ্যের বুকে নিজের প্রভাব খাটিয়ে চলেছেন।
নিচুপট্টিতে ছোট ঘর থেকে নীল প্রসাদোপম বাড়ি। ২০১১-র পর বাংলার রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য নাম অনুব্রত। বলা যেতে পারে, লালমাটির ভোট ফ্যাক্টর তিনি। তাই অল্পদিনেই হয়ে উঠেছেন দিদির প্রিয় ভাই। 'চড়াম চড়াম ঢাকের বোল’ থেকে `গুড়-বাতাসা’- অনুব্রতর বোলবচন বারবার এসেছে নির্বাচনের শিরোনামে।
অনুব্রতর পতন
পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে জেরবার তৃণমূল। তাঁকে ঝেড়ে ফেলেও দায় এড়াতে পারছে না দল। এই অবস্থায় দ্বিতীয় উইকেটের পতন। এবার সিবিআইয়ের কোপ অনুব্রতর মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার ঘাড়ে। তৃণমূলের যে শিরে সংক্রান্তি দশা, তা বলাই বাহুল্য। সেই সঙ্গে এতদিন সযত্নে কেষ্ট যে রাজনৈতিক কেরিয়ার লালন করেছিলেন, সেই গ্রাফ একলাফে নেমে গেল সাপে ভর করে। এর শেষ কোথায় কে জানে?
গরু পাচার মামলায় সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার অনুব্রত মণ্ডল। অনেক লুকোচুরির পর অবশেষে তিনি গ্রেফতার। আরও এক হেভিওয়েট নেতা এজেন্সির জালে। গরু পাচার মামলায় তৎপর সিবিআই। ১০ অগাস্ট হাজিরা এড়ানোর পর এদিন সকালে আদালতের নির্দেশনামা ও মেডিক্যাল রিপোর্ট নিয়ে বোলপুরের নিচুপট্টিতে বীরভূমের জেলা সভাপতির বাড়িতে পৌঁছে যান সিবিআই অফিসাররা। অনুব্রতর বাড়ি ঘিরে ফেলে কেন্দ্রীয় বাহিনী। বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন সিবিআই আধিকারিকরা। বাড়ির সকলের মোবাইল ফোন নিয়ে নেওয়া হয়।
গরু পাচার মামলায় অনুব্রত মন্ডলের বাড়িতে সিবিআই হানার খবর পেয়ে বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতির বাড়ির সামনে ভিড় জমান এলাকাবাসী। প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, আজই কি গ্রেফতার? অবশেষে তাই হলো।
গরু পাচার মামলায় এর আগে বেশ কয়েকবার তাঁকে শমন পাঠায় সিবিআই। যদিও এর মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই তিনি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে হাজিরা এড়িয়েছেন। তবে একবার তিনি কলকাতায় এসে সিবিআইয়ের জেরার মুখোমুখি হয়েছিলেন। সূত্র মারফত জানা গেছে, গরু পাচার মামলায় এবার দিন কয়েক আগে চালানো তল্লাশিতে মেলা লক্ষ লক্ষ টাকা, হার্ড ডিস্ক, পেনড্রাইভ, ফোন ও নথি খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। সেগুলি খতিয়ে দেখে বেশ কিছু তথ্য হাতে এসেছে তাঁদের। এবার সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৃণমূল জেলা সভাপতিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, অনুব্রতর কেরিয়ার কোন তরীতে গিয়ে ভিড়বে? পার্থর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তাঁর গ্রেফতার এবং তাঁর ঘনিষ্ঠর বাড়ি থেকে পাহাড়প্রমাণ টাকা উদ্ধার হওয়ায়, সেই গলার কাঁটা আর বেশিক্ষণ আটকে থাকতে দেননি অভিষেকরা। পার্থকে উগরে দিয়ে তৃণমূল নিস্তার পাওয়ার চেষ্টা করে। বলাই বাহুল্য, আদতে এই দায় ঝেড়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। তার ওপর আরও এক উইকেটের পতন। যদি পার্থর মতো কেস এক্ষেত্রে না ঘটে, তাহলেও কি দলে তাঁর প্রতাপ একই থাকবে, না কি কেষ্টর দাপট কমবে? সেটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। সেই সঙ্গে এই প্রশ্নও মাথাচাড়া দিচ্ছে যে, তৃণমূলে একের পর এক দাপুটে নেতাকে ছেঁটে ফেলা হলে, দল কি ডানা-ছাঁটা মৃত পাখিতে পরিণত হবে না? এরপর দলের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?