সীমান্তে মায়ানমারের সশস্ত্র গেরিলা অভ্যুত্থান আদৌ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত? 

Arakan Army Myanmar: মংডু দখল করে, আরকান আর্মি বাংলাদেশের সঙ্গে প্রায় ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত দখল করেছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে মায়ানমারের যে সীমান্ত রয়েছে, তা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলেছে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী! পশ্চিম মায়ানমারের এই শক্তিশালী সশস্ত্র গেরিলা বাহিনীর দাবি, মংডু শহরে মায়ানমারের শেষতম সামরিক ঘাঁটিটি অতিক্রম করার পর এখন বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত তাঁদের দখলে। সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর জন্য একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র গঠনের জন্য লড়াই করছে। গত রবিবার মংডুর কাছে বর্ডার গার্ড ৫ নম্বর পোস্ট নামে পরিচিত সামরিক ঘাঁটি দখল করে এই বাহিনী। মংডু দখলের মধ্যে দিয়ে আরকান আর্মি বাংলাদেশের সঙ্গে প্রায় ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত দখল করেছে। 

এক বিবৃতিতে জানা গিয়েছে, মায়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা, যারা ওই ঘাঁটি রক্ষা করছিলেন তারা মোটরবোট এবং ক্যানো ব্যবহার করে নাফ নদী পেরিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এই নাফ নদীটিই বাংলাদেশের সঙ্গে মায়ানমারের সীমান্ত। আরাকান আর্মির দাবি, সে দেশের সৈন্যদের সঙ্গে ছিল মুসলিম রোহিঙ্গা যোদ্ধারাও। আরাকান আর্মি জানিয়েছে, "সংঘর্ষ এখনও ঘটছে ... অতএব, সামরিক প্রয়োজনীয়তা এবং জননিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে নাফ নদীতে সমস্ত নদী পরিবহন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হবে।"

সেদেশের সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবদি জানিয়েছে, আরাকান আর্মির ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরেইন তুন, মিলিটারি অপারেশন কমান্ড ১৫-র কমান্ডার, ও সেনারা প্রায় ৮০ জন রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সহ পালাচ্ছিলেন, গ্রেফতার হন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। আরাকান আর্মির দাবিগুলি কতখানি সত্য, তা যাচাই করা যাচ্ছে না কারণ মংডুর যুদ্ধ তীব্র হওয়ার কারণে এই অঞ্চলে ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন পরিষেবা অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। এই গেরিলা বাহিনী মংডু দখল করলেই রাখাইন রাজ্যের উত্তর অংশে তাদের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ হবে। একটি স্বশাসিত রাখাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এটি।

আরও পড়ুন- উদ্বাস্তুদের মানচিত্র কোথায়? কীভাবে বাংলাদেশে ভিটেহারা হয়ে এলেন রোহিঙ্গারা?

আরাকান আর্মির সাম্প্রতিক প্রচারে রোহিঙ্গাদের উপর হিংসার আতঙ্ক ফিরেছে। মুসলিম রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের সদস্যদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হিংসা যে আবারও বাড়তে পারে সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা জাতিকে নির্মূল করার যে অভিযান চালানো হয়েছিল সেই অভিযানের ফলেই ২০১৭ সালে প্রায় ৭ লক্ষ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হন। দক্ষিণ-পূর্ব মায়ানমারের একটি শহর বুথিডাং দখলের পর সেখানে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ চলে, চলে অভাবনীয় হামলা। হাজারে হাজারে সাধারণ নাগরিক বাস্তুচ্যুত হন। এদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম রোহিঙ্গা। মানবাধিকার সংস্থাগুলিও আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে গত অগাস্টে মংডুতে একদল রোহিঙ্গা নাগরিককে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে।

আরাকান আর্মি স্বাভাবিকভাবেই এসব দাবি অস্বীকার করেছে। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর বিভিন্ন স্তরে তারা যে আক্রমণ শুরু করেছে সেই তথ্য ভুল বলে উড়িয়ে দিয়েছে এই গেরিলা বাহিনী। তবে আরাকান আর্মি ক্রমাগত বলে চলেছে যে, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা যোদ্ধা মায়ানমারের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ নাকি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীরও অন্তর্ভুক্ত। আরাকান আর্মির আরও দাবি, অনেক রোহিঙ্গাই জোর করে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীতে নানা পদে আসীন।

আরাকান আর্মি বা AA রাখাইন সম্প্রদায়ের সামরিক শাখা। ২০০৯ সালে প্রাক্তন ছাত্র কর্মী ত্বোয়ান মারত নাইং এই গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন এবং নেতৃত্ব দেন। বিদ্রোহী এই গোষ্ঠী জেডপাথরের খনিতে কাজ করা পুরুষদের মধ্যে প্রথম নিজের যোদ্ধাদের নিয়োগ করেছিল। এই সেনাদল উত্তর মায়ানমারে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির কাছে আশ্রয় চেয়েছিল। ২০১৯ সালে, আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতা দিবসে চারটি পুলিশ স্টেশনে আক্রমণ করেছিল। এর পরেই আন সান সু কি সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন জঙ্গীদের নিকেশ করার, যদিও পরে দুই পক্ষই যুদ্ধবিরতির ডাক দেয়।

রাখাইন রাজ্য কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? রাখাইন মায়ানমারের গৃহযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এখানে গণতন্ত্রপন্থী গেরিলা এবং সংখ্যালঘু সশস্ত্র বাহিনী স্বায়ত্তশাসনের জন্য দেশটির সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ২০২১ সালে সেনাবাহিনী আন সান সু কি-র নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর এই দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করে।

আরও পড়ুন- চক্ষু চিকিৎসক থেকে স্বৈরশাসক! অবাক করবে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের উত্থান

আরাকান আর্মি হচ্ছে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সদস্য। গত বছরের অক্টোবরে অপারেশন ১০২৭ শুরুর পর থেকে উত্তর শান রাজ্যের বিশাল এলাকা দখল করেছে। এর শরিকরা লাশিওতে সামরিক বাহিনীর উত্তরপূর্ব আঞ্চলিক কমান্ডের ঐতিহাসিক পরাজয় ঘটিয়েছে। পাশাপাশি শান রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে জান্তাও দখল করেছে। আর ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মুখ দেখেছে।

মংডুতে প্রতিরোধ কাটিয়ে ওঠার পর, আরাকান আর্মি এখন রাজ্যের ১৭টি শহরের মধ্যে ১১টির উপর প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এই গেরিলা বাহিনী বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী তিনটি শহরও দখল করেছে যার মধ্যে রাখাইন রাজ্যের বুথিডাং-ও রয়েছে। গত বছরের মে মাসে দখল হয় বুথিডাং। প্রতিবেশি চিন রাজ্যের পালেতওয়া শহরটি জানুয়ারিতে দখল হয়ে যায়।

আরাকান আর্মি বর্তমানে রাখাইন রাজ্যের দক্ষিণ অংশে তিনটি শহর গ্বা, তাউংগুপ এবং আন দখল করার জন্য লড়াই করছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, আরাকান আর্মির সৈন্যরা ৩০টিরও বেশি জান্তা ঘাঁটিসহ আন শহরের বেশিরভাগটাই দখল করে নিয়েছে। এই শহরটিতে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর পশ্চিম আঞ্চলিক কমান্ডের সদর দফতরও রয়েছে। পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে স্পষ্ট হচ্ছে যে, এখন সম্ভবত দক্ষিণ অংশেও সৈন্য পাঠাবে আরাকান আর্মি। অর্থাৎ রাখাইন রাজ্যে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর অবস্থান পুরোপুরি ভেঙে যাওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের সাম্প্রতিক উত্তেজনার মধ্যে আরাকান আর্মির যে ভূমিক নিরন্তর প্রচার করে চলেছে গোদি মিডিয়া, তা যে অবান্তর, বলার অপেক্ষা রাখে না। আরাকান আর্মির উত্থানে ইউনূসের 'মহাবিপদে'-র কথা প্রচার করা হচ্ছে, চটুল শিরোনামে 'আসছে আরাকান, ইউনূস পালান' জাতীয় সংবাদ পরিবেশন হচ্ছে, যার কোনও ভিত্তিই নেই। তা যে সত্যের অপলাপ, বলা বাহুল্য!

More Articles