পেরিয়ে গিয়েছে আরও বিশ্বকাপ, কোথায় রয়েছেন '৮৬-র বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা?

1986 FIFA World Cup Argentina Players : রয়ে গিয়েছেন ’৮৬-র বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনা দলের অন্যান্য ফুটবলাররা। তাঁরাও যে সমান ভাগীদার এই সম্মানের।

১৮ ডিসেম্বর, ২০২২। এই দিনটার পর পেরিয়ে গিয়েছে বেশ অনেকটা সময়। নতুন বছরের মার্চের শেষলগ্নও চলে এল। কিন্তু আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের ভক্তদের সেই ঘোর এখনও কাটেনি। পেনাল্টি শ্যুটআউটে ফ্রান্সকে হারিয়ে তৃতীয়বারের জন্য বিশ্বকাপ জিতেছিল লা আলবিসেলেস্তেরা। মেসির হাতে উঠুক বিশ্বকাপ, এমনটাই চাইছিল ফুটবল বিশ্বের একাংশ। সেই স্বপ্ন পূর্ণ হতে দেখে যেন ঘোর কাটছে না তাঁদের। শুধু দুঃখ একটাই, যে মানুষটা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি খুশি হতো, তিনিই অকালে চলে গেলেন, সবাইকে ফাঁকি দিয়ে। কাতারের স্টেডিয়াম সেই উদ্দীপনার ফাঁকে বারবার স্মরণ করছিল দিয়েগো মারাদোনাকে।

মারাদোনা বলতেই চোখে ভেসে উঠবে আরও একটা বিশ্বকাপ। ৩৭ বছর আগে, ১৯৮৬ সালে তিনি প্রায় একার কাঁধে দলকে নিয়েছিলেন। বুনো ঘোড়ার মতো দৌড় তাঁর, ঝাঁকরা চুলের ছেলেটাকে কম কথা শুনতে হয়নি। সবকিছু ছাড়িয়ে ’৮৬-র সেই সোনায় মোড়া বিশ্বজয়ের মুহূর্ত তিনি উপহার দিয়েছিলেন দেশবাসীকে। ২০২০ সালে অকালেই চলে যান ফুটবলের রাজপুত্র। কিন্তু তাঁর অবদান, তাঁর খেলা, তাঁর শিল্প আর জীবন কখনও ভোলেনি বিশ্ববাসী। তবে রয়ে গিয়েছেন ’৮৬-র বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনা দলের অন্যান্য ফুটবলাররা। তাঁরাও যে সমান ভাগীদার এই সম্মানের। এখন কোথায় রয়েছেন সবাই? কী করছেন? আসুন, এক নজরে জেনে নেওয়া যাক তাঁদের কথা।

নেরি পাম্পিদো (গোলকিপার)

’৮৬-র জাতীয় দলে আর্জেন্টিনার এক নম্বর গোলকিপার ছিলেন নেরি পাম্পিদো (Nery Pumpido)। ওই বিশ্বকাপে মোট সাতটি খেলায় ছিলেন তিনি। মাত্র পাঁচটি গোল হজম করেছিলেন, বাঁচিয়েছিলেন তিনটি নিশ্চিত গোল। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ – এই ক’বছরই আর্জেন্টিনার হয়ে ফুটবল খেলেছেন তিনি। ১৯৯০-র বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচ চলাকালীন হঠাৎই পা ভেঙে যায় তাঁর। তারপর খেলোয়াড়ের কেরিয়ারে ইতি পড়ে। কিন্তু কোচ হিসেবেও কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। ১৯৯৯ সাল থেকে অলিম্পিয়া, ইউনিয়ন সান্টা ফে, নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের মতো ক্লাবে কোচিং করিয়েছেন পাম্পিদো। শেষমেশ ২০১৩ সালে সবকিছুর থেকে অবসর নিয়ে নেন তিনি।

জোসে কুচিউফো (সেন্ট্রাল ব্যাক)

১৯৮৬-র বিশ্বকাপ অনেকের কাছে একমাত্র স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থেকে গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন কুচিউফো। ’৮৬-র বিশ্বকাপে মোট ছ’টি ম্যাচ খেলেছিলেন, এবং প্রতি ম্যাচেই নিজের সেরাটা উজাড় করে দিয়েছিলেন। বিশ্বকাপ জেতার পর খুব একটা আলোচনার মধ্যে আসেননি তিনি। দুর্ভাগ্য, ২০০৪ সালে শিকার করতে গিয়ে পেটে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই মারা যান কুচিউফো।

জোসে লুইস ব্রাউন (সেন্ট্রাল ব্যাক)

’৮৬ আর্জেন্টিনা দলে ডিফেন্সের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন জোসে ব্রাউন। টিমের ভেতর তাঁর ডাকনাম ছিল ‘তাতা’। ব্রাউনের নাম এলেই মনে পড়বে ’৮৬-র বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের কথা। ২২ মিনিটে বুরুচাগার পাস থেকে প্রথম গোলটি করেছিলেন তিনিই। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ব্রাউন। কোপা আমেরিকায়ও আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেছিলেন। মাত্র ৬২ বছর বয়সে, ২০১৯ সালে মারা যান তিনি।

অস্কার রুগেরি (সেন্ট্রাল ব্যাক)

দলে তাঁর নাম ছিল ‘এল কাবেজন’। ১৯৮৬, ১৯৯০, ১৯৯৪ – তিনটে বিশ্বকাপেই আর্জেন্টিনার রক্ষণের স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন রুগেরি। ’৮৬-র বিশ্বকাপে তাঁর পারফর্মেন্স চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। অন্যতম সেরা ডিফেন্ডারের তকমাও পেয়েছিলেন। কিন্তু বাকি দুটো বিশ্বকাপে দেখেছেন স্রেফ হতাশা। ১৯৮৩ থেকে ’৯৪ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার হয়ে ৯৭টি ম্যাচ খেলেছেন। গোল করেছেন সাতটি। ক্লাব আলমাগ্রো, অ্যাটলেটিকো রাফায়েলার মতো কিছু ক্লাবে কোচিংও করিয়েছেন। বর্তমানে ফক্স ফুটবল লাতিন আমেরিকার একটি শো-এর অন্যতম অংশ।

রিকার্ডো জিউস্তি (রাইট মিডফিল্ডার)

আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডের অন্যতম স্তম্ভ জিউস্তি ’৮৬-র বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচই খেলেছেন। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল অবধি ৫৩টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। পাশাপাশি ক্লাব ইন্ডিপেন্ডিয়েন্তেও দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। ক্লাব ফুটবলে তিনি প্রায় কিংবদন্তি। ১৯৯০ সালের সেমিফাইনালে ইতালির বিরুদ্ধে খেলার সময় লাল কার্ডও দেখেন। ১৯৯২ সালে ফুটবল থেকে চির অবসর নেন।

হেক্টর এনরিকে (সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার)

জর্জে ভালদানো ’৮৬-র ফাইনালের দ্বিতীয় গোলটি করেছিলেন। আর অ্যাসিস্ট করেছিলেন কে? এই হেক্টর এনরিকে। গোটা বিশ্বকাপে অনবদ্য পারফর্মেন্স দেখিয়েছিলেন তিনি। সেইসঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও একটি প্রসঙ্গ। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মারাদোনার সেই প্রবাদপ্রতিম গোলটির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? শতাব্দীর সেরা গোল নির্বাচিত হয়েছিল সেটি। সেই গোলে এনরিকের সঙ্গেই শেষ পাসটি খেলে গোল করেছিলেন মারাদোনা। এখন আরবের আল ওয়াসল ক্লাবের সহকারী কোচ হিসেবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।

সার্জিও বাতিস্তা (সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার)

১৯৮৬-র বিশ্বকাপের মাত্র এক বছর আগেই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সেরকম অভিজ্ঞতাও ছিল না। তা সত্ত্বেও নিজের পজিশনে বাতিস্তা যা খেলেছিলেন, তা মনে রাখার মতো। ফাইনালে জার্মানির বিরুদ্ধে কার্যত দাপিয়ে বেরিয়েছিলেন মাঠে। অবসরের পর ২০১০-১১’র মরসুমে আর্জেন্টিনার কোচ হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০১৮ সালে কাতার এসসির কোচ ছিলেন।

জুলিও ওলার্তিকোয়েচিয়া (লেফট মিডফিল্ডার)

রেসিং ক্লাবে তিনি প্রায় কিংবদন্তির মর্যাদা পান। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০-র মধ্যে আর্জেন্টিনার হয়ে ৩২টি ম্যাচে খেলেছিলেন তিনি। পরে ২০১৫ সালে আর্জেন্টিনার মহিলা ফুটবল দলের কোচ হিসেবেও দ্দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

জর্জে বুরুচাগা (অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার)

মারাদোনা, বাতিস্তুতার পাশাপাশি এই মানুষটিকেও চিরকাল মনে রাখবে আর্জেন্টিনা। ’৮৬-র বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রথম গোলটি অ্যাসিস্ট করেছিলেন। তারপর শেষ মুহূর্তে ৮৪ মিনিটে জয়সূচক গোলটি করেন বুরুচাগা। মারাদোনার পাশাপাশি টিমকে চাঙ্গা রাখার কাজে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। অবসরের আগে দেশের জার্সি গায়ে ৫৭টি ম্যাচ খেলে ১৩টি গোল করেছিলেন। ২০১৮-র বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবেও কাজ করেছেন।

জর্জে ভালদানো (ফরোয়ার্ড)

আর্জেন্টিনার আক্রমণ ভাগে মারাদোনার পাশাপাশি ভালদানোর ওপরও দায়িত্ব ছিল অনেকটা। এতটুকুও নিরাশ করেননি তিনি। ’৮৬-র বিশ্বকাপে মোট চারটি গোল করেছিলেন। সঙ্গে ছিল ফাইনালে করা তাঁর দ্বিতীয় গোলটি। বর্তমানে বেইন স্পোর্টসের হয়ে ধারাভাষ্য দেন ভালদানো।

দিয়েগো মারাদোনা (ফরোয়ার্ড)

নতুন করে তাঁর কথা বলার মতো নেই আর। ’৮৬-র বিশ্বকাপ মানেই তিনি। তাঁকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখেছিল গোটা আর্জেন্টিনা। কোয়ার্টার ফাইনালের হ্যান্ড অফ গড, তারপর শতাব্দীর সেরা গোল; বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ ফুটবল – মারাদোনা কার্যত শিল্পে পরিণত করেছিল এই খেলাকে। পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ক্রীড়াবিদ মাত্র ৬০ বছর বয়সে, সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে যান।

More Articles