ক্রিকেট যেন সাক্ষাৎ যুদ্ধ! যে ভয়ঙ্কর খেলা হল ২০২৩-র বিশ্বকাপে
ICC cricket world cup 2023: খেলায় হারজিত তো লেগেই থাকে। তবে এবারের বিশ্বকাপের ফাইনাল শেষে শুধু হার নয়, নজিরবিহীন এক স্পোর্টসম্যানশিপনেসের অভাব দেখল দেশ।
এতগুলো বছর পর ভারতে আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ। তা-ও আবার সেরার সেরা টুর্নামেন্ট খেলে ফাইনালে উঠল ভারত। ফাইনালে মুখোমুখি পাঁচবারের বিজয়ী অস্ট্রেলিয়া। না শেষপর্যন্ত শিকে ছেড়েনি ভারতের কপালে। ষষ্ঠ বারের জন্য ট্রফি জিতে নিয়েছে অজিরা। খেলায় হারজিত তো লেগেই থাকে। তবে এবারের বিশ্বকাপের ফাইনাল শেষে শুধু হার নয়, নজিরবিহীন এক স্পোর্টসম্যানশিপনেসের অভাব দেখল দেশ। অজি-অধিনায়কের হাতে বিশ্বকাপ তুলে দিয়ে দেশনায়কের মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়া থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণার ওড়াউড়ি, অনেক কিছুই দেখল ক্রিকেট বিশ্ব। শুধু কি তাই, ক্রিকেটের এমন রাজনীতিকরণও বোধহয় আগে দেখেনি বিশ্বকাপের মঞ্চ।
নমো নমো
কান পাতলেই মোদি-ধ্বনি। রণে বনে জলে জঙ্গলে সর্বত্র তিনি। তাঁর নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের উদ্বোধন হয়। বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটিও হয়েছে সেখানেই। যার এককালে নাম ছিল বল্লভভাই প্যাটেল স্টেডিয়াম। সেই গুজরাটের মোতেরা স্টেডিয়াম এখন পরিচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নামেই। সেই ম্যাচের শুরুটা হয়েছিল রীতিমতো যুদ্ধের ঢঙেই। বায়ুসেনার কসরৎ, যা আমরা সাধারণ ভাবে স্বাধীনতা দিবস বা প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানেই দেখতে পাই, তেমন ভাবেই শুরু হল বিশ্বকাপের চূড়ান্ততম ম্যাচ। বিশ্বকাপ ম্যাচের গ্যালারিতে চাঁদের হাট। বলিউড থেকে শুরু করে খেলার জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত। তার মাঝখানে সভা আলো করে বসে আছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং তাঁর পুত্র জয় শাহ। ঘটনাচক্রে তিনি আবার বিসিসিআইয়ের সচিবও। বলাই বাহুল্য তাঁর ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের চেয়েও অনেক উপরে। কারণ প্রেসিডেন্ট রজার বিনির সেই দাপট আমরা দেখতে পাইনি এতদিনেও। বিশ্বকাপের মঞ্চ তো দূরের কথা।
আরও পড়ুন: ‘পাশে আছি’! ড্রেসিংরুমে ঢুকে মহম্মদ শামিকে জড়িয়ে ধরলেন মোদি
ক্রিকেটে ক্রিকেট নেই
তবে মনে রাখতে হবে, বন্দে ভারত ট্রেনের কামরায় উঠলেই বিরাট পর্দায় মোদিকে যেমনভাবে আমরা দেখি, ক্রিকেটের মোদি এবং তাঁর প্রভাব ঠিক তেমন সপাট ও সরাসরি নয়। বরং একে সফট পলিটিকস বলা চলে। মূল ব্যাপারটাকে আসলে এমন ভাবে মাখিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে, যাতে মোটা চোখে দেখা যায় না। তবে ক্রিকেট বিশ্বকাপ, বিশেষত ২০২৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ যে চরিত্র বদলেছে, তা এককথায় বলাই যায়। এ যেন নয়া ভারত। যে ভারত হারতে জানে না। যে খেলায় খেলোয়ার থেকে দর্শক, সকলেই সৈন্য। আর খেলা সাক্ষাৎ যুদ্ধ। এবারের বিশ্বকাপে থিম সং তথা যে অফিশিয়াল অ্যান্থেমটি বাধা হল, তার নেপথ্যে ছিলেন সুরকার প্রীতম। সেখানে দেখা গেল তারকা রণবীর সিংকে। উল্লাসের কমতি ছিল না সেখানে, তবে দেখা গেল না একজন ক্রিকেটারকেও। নিশ্চয়ই সেই গানটি বা মিউজিক ভিডিওটিকে দেখেশুনেই অনুমোদন করেছে আইসিসি। কিন্তু কেমন মনে হল, সেখানে ক্রিকেট ব্যাপারটিই যেন নগন্য হয়ে গিয়েছে। ক্রিকেটের রেফারেন্স সেখানে সামান্যতম। আছে শুধুই উন্মাদনা। যা আসলে ক্রিকেটেও কাজে লাগানো যায়, আবার ভোটেও। ক্রিকেটের সঙ্গে এ হেন জিঙ্গুয়িজমের যোগ কিন্তু শুরু হয়েছে অনেকদিন ধরেই। এ দেশে বহু দিন ধরেই ক্রিকেট প্রায় ধর্ম। ধর্মের মতোই একধরনের আফিম। মানুষ সমস্ত ভুলে ক্রিকেটের নেশায় মজে থাকে। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু আগের সেই ক্রিকেটের নেশার সঙ্গে আজকের ক্রিকেটের যেন আকাশপাতাল পার্থক্য।
তারা খসে পড়ে...
১৯৯৬ সালে বিনোদ কাম্বলির চোখের জল আমাদের অনেকেরই বুকের পাঁজর ভেঙে দিয়েছিল। ২০০৩ সালে রিকি পন্টিংয়ের ব্যাটিং বা জাহির খানের ফার্স্ট ওভার আমাদের অনেককেই কাঁদিয়ে ছেড়েছে। এই হৃদয়ভঙ্গের যন্ত্রণা যেন এই বিশ্বকাপ হারে নেই। হ্যাঁ, আশাভঙ্গ নিশ্চয়ই। গোটা বিশ্বকাপ জুড়ে এত ভালো খেলে এই হার হয়তো প্রাপ্য ছিল না ভারতের। তবে এই বেদনার সঙ্গে আগের হারের বেদনার যেন মিল নেই। তবে এই কয়েক বছর শিখিয়ে গিয়েছে আমাদের শিল্প আর শিল্পীকে আলাদা করে দেখতে। যে সচিন তেন্ডুলকর ক্রিকেটের বটগাছ, তার কভার ড্রাইভ যেমন আমরা ভুলতে পারি না, তেমন ভাবেই তিনি যখন বিজেপির আইসি সেলের লেখা টুইট নিজের দেওয়ালে ফরওয়ার্ড করেন, তা-ও আমরা ভুলতে পারি না। রোহিত শর্মার দুরন্ত ছক্কা, শামির বোলিং বা গিলের ব্যাটিং যেমন আমরা ভুলতে পারি না, তেমনই ভুলতে পারি না প্রতিদিন জুয়ার বিজ্ঞাপনে আমরা রোহিতের মতো বিশ্বমানের তারকাকে দেখতে পাই। আসলে 'স্টারস হ্যাভ অল বিট্রেড আস'। তারকারা আমাদের স্বপ্ন দেখান, কিন্তু সামাজিক দায়দায়িত্বর পাড়া মাড়ান না তাঁরা। এ আমরা যুগে যুগে দেখে এসেছি। ক্রিকেটের ময়দানে বাণিজ্যিকরণ ছিল। ২০০০ সাল থেকেই ক্রিকেটে তার প্রবেশ। তবে এখন তার সঙ্গে জুড়েছে রাজনীতিকরণ। বীরেন্দ্র সহবাগের মতো আন্তর্জাতিক এক খেলোয়ারকে আমরা দেখেছি উগ্র জাতীয়তাবাদী টুইট করতে। স্পোর্টিং স্পিরিট শব্দটাই কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ খেলা থেকে। এখন ক্রিকেটও যেন যুদ্ধ।
জাতীয়তাবাদের উল্লাস
তাই বোধহয় ফাইনাল ম্যাচ শুরুর আগে বায়ুসেনার কসরৎ। যা আমরা প্রজাতন্ত্র কিংবা স্বাধীনতা দিবসে দেখে অভ্যস্ত সাধারণত। কিন্তু বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের আগে এই ধরনের জিনিসপত্র কি খেলোয়ারদের উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে না। একটা বিশ্বকাপ ম্যাচে মাঠভর্তি মানুষ হনুমান চল্লিশা পড়ছেন, জয় শ্রীরাম স্লোগান দিচ্ছেন, এ দৃশ্য আমরা আগে দেখেছি কি? মনে পড়ে না। প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির এই যে আত্মমগ্নতা তা নতুন নয়। এর আগেও আমরা সংবাদপত্রে একটি মাত্র ছবিতে চার-চারজন নরেন্দ্র মোদিকে একই সঙ্গে দেখেছি। এ নতুন কিছু নয়। ফাইনালের আগে থেকে সোশ্যাল মিডিয়াতে দক্ষিণপন্থীরা লিখতে শুরু করলেন, জিতলে মূল কৃতিত্ব বিসিসিআইয়ের। বিসিসিআই-ই নাকি তৈরি করে দিলেন জয়ের মঞ্চটি। সেই বিসিসিআই, খাতায়-কলমে যার মাথায় রজার বিনি বটে, কিন্তু সংস্থার রাশ আদতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পরিবাদমুক্ত পুত্র জয় শাহের হাতেই। আমরা টিভির সামনে বসে যে ধারাভাষ্য দেখলাম, তাতে যেন বিদেশি দলগুলির কথা জায়গা পেল না। গ্যালারিতে খুঁজে পাওয়া গেল না বিদেশি দলের সমর্থকদের। বহু বাংলাদেশী সাংবাদিকই অভিযোগ তুলেছেন, তাঁরা ভিসা পাননি বলে। কিন্তু কেন? এর নেপথ্যেও কি আদতে লুকিয়ে নেই অন্য এক রাজনীতি।
স্পোর্টসম্যানশিপ কোথায়?
অতিথি দেব ভবঃ-র দেশে এ দৃশ্য যেন নজিরবিহীন। এর আগে বিশ্বকাপের মঞ্চ এমন নৈরাজ্য, বিদেশি দলদের প্রতি এমন অবজ্ঞা বোধহয় দেখেনি কখনও। মনে পড়ছে ১৯৯৯-র ম্যাচ। কোমরের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ব্যাট ধরেছিলেন সচিন। আর পারছিলেন না যেন। প্রতিটি ওভারের বিরতিতে নিজেও একবার করে বিরতি নিচ্ছেন তিনি। কোমরের ব্যথা সামলাতে ব্যায়াম করছেন, কখনও বা পিচের উপরেই শুয়ে পড়ছেন। একটা সময় আর সহ্য না করতে পেরে ওভারটি মেরে খেলার সিদ্ধান্ত নিলেন সচিন। ঠিক সে সময় ছুটে এল সাকলিন মুস্তাকের একটা দুসরা। সচিনের ব্যাটে লেগে বল সোজা গিয়ে উঠল ওয়াসিম আক্রমের হাতে। তখনও সাত না আট রান বাকি! সেটা না করতে পেরে দু-তিনজন ব্যাটসম্যান আউট হয়ে গেল। জেতা ম্যাচ যেন হাতের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। সে ঘটনা অবশ্যই হৃদয়বিদারক ছিল। কিন্তু পাকিস্তান যখন ভিকট্রি ল্যাপে গিয়ে দাঁড়ালো, তখন গোটা চিপক স্টেডিয়াম তাঁদের উঠে দাঁড়িয়ে প্রশংসা করেছিল। প্রশংসা করেছিল পাক খেলোয়ারদের দক্ষতার। না, পাক দলের প্রতি কোনওরকম জিঘাংসা কিন্তু দেখায়নি সেদিন চিপক। তেমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। যে কোনও স্টেডিয়ামে দর্শকদের কাছ থেকে এমনটাই তো কাম্য। কারণ আদতে তো এটা খেলা। কোনও যুদ্ধ তো নয়। প্রশ্ন জাগে, চিপক বা মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ের মতো ঐতিহ্যশালী স্টেডিয়ামে কেন হল না বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যাচ। না, ইডেনের কথা বলবো না। কারণ ইডিনের দর্শক চেন্নাই বা মুম্বইয়ের মতো নয়। বহু বার ইডেনের দর্শকের ভয়াবহ রূপ দেখেছে ক্রিকেটের ময়দান। ইডেনের দর্শক দলকে হেনস্থা করতে অভ্যস্ত। ১৯৯৬-র ম্যাচ শেষ করতে দেয়নি এই ইডেন। কিন্তু চিপক বা ওয়াংখেড়ের দর্শক বরাবরই স্পোর্টসম্যানশিপ দেখিয়েছে। তেমন দুটি মাঠ ছেড়ে কেন গুজরাট?
আরও পড়ুন: বিশ্বকাপ ফাইনালে গ্যালারিতে ডাক পেলেন না ৮৩-র নায়ক কপিল দেব
ব্রাত্য কপিল!
উত্তরটা বোধহয় জলের মতোই সোজা। যাতে বিশ্বকাপের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারে মোদিজি, অমিতজি ও তাঁর পরিবারবাদমুক্ত সন্তানেপ নাম। যাতে গোটা লাইমলাইটটাই এসে পড়ে তাঁদের মুখেই। ক্য়াম্পেন থেকে কমেন্ট্রি, সব কিছু মিলিয়েই এ যেন নয়া ভারত। এই বিশ্বকাপে ক্রিকেটের থেকে ঢের বেশি মিশে জাতীয়তাবাদ। ক্রিকেটের যে সনাতন আবেগ তা আদতে বাণিজ্য ও রাজনীতি ঢুকে অনেকটাই নষ্ট করে গিয়েছে। মনে পড়ছে বোধহয়, কুস্তিগিরদের আন্দোলনের সময় তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে চিঠি দিয়েছিল বিশ্বকাপজয়ী টিম। যে চিঠির নেপথ্যে ছিলেন বিশ্বকাপজয়ী ক্যাপ্টেন কপিল দেব। সেখানে অবশ্য বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট রজার বিনিরও নাম ছিল। পরে অবশ্য সেই চিঠি থেকে নাম সরিয়ে নেন রজার বিনি। বিশ্বকাপ ২০২৩-র ম্যাচে কেন ডাক পেলেন না কপিল দেব, তা আঁচ করা কঠিন নয়। দেখতে পেলাম না ধোনিকেও। তার বদলে আমরা দেখতে পেলাম এক স্বঘোষিত ধর্মগুরুকে। সৌরভ গাঙ্গুলিকে আমরা মাঠে দেখলাম বটে, তবে তিনিও যেন কেমন ম্লান। আদতে হাতের পুতুল না হতে চেয়ে তো কম হেনস্থার মুখে তো পড়তে হয়নি তাঁকে।
সব মিলিয়ে ২০২৩ সালের আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ যেন অনেকখানিই আলাদা। এই ২২ গজের ময়দান যেন দেখল খেলার এক অন্য রূপ। কার্যত কোনও ক্রিকেটপ্রেমীরই বোধহয় তা কাম্য ছিল না কখনও।