মেসি না এমবাপে, শেষ হাসি কার? ফাইনালের আগে রক্তচাপ বাড়ছে ফুটবল বিশ্বের

FIFA World Cup 2022 : এখন অপেক্ষা আর মাত্র কয়েকটা দিনের। ১৮ ডিসেম্বর, লুসাইল স্টেডিয়ামে বসবে বিশ্বকাপ ফাইনালের আসর।

১৫ ডিসেম্বর কাতারের আল বায়েত স্টেডিয়ামে তখন রাতের উৎসব। লড়াই শেষে টানেল ধরে ড্রেসিং রুমের দিকে ফিরে যাচ্ছেন খেলোয়াড়রা। অন্যদিকে, গ্যালারি মেতে উঠেছে গানে, নাচে, আনন্দে। ২০২২ ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। মরক্কোকে ২-০ গোলে হারিয়ে মেসিদের বিপক্ষে জায়গা করে নিল ফ্রান্স। মরক্কোর প্রবল প্রতিরোধ, লড়াইকে কুর্নিশ জানানোর পর এখন অপেক্ষা আর কয়েকটা দিনের। ১৮ ডিসেম্বর, লুসাইল স্টেডিয়ামে বসবে বিশ্বকাপ ফাইনালের আসর।

২০ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া বিশ্বকাপ কাতারের মাটিতে বহু অঘটন, বিতর্কের সাক্ষী থেকেছে। দেখেছে ছোট ছোট দেশগুলোর বীরবিক্রমে লড়াই। দেখেছে মরক্কোর স্বপ্নের উত্থান। চোখের জলে নেইমার, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, লুকা মদরিচদের বিদায়। দেখেছে রেফারিং এবং অফসাইড নিয়ে বাক-বিতণ্ডা। সমস্ত কিছু পেরিয়ে ২০২২ সালের বিশ্বকাপ এসে দাঁড়িয়েছে তার চূড়ান্ত মুহূর্তে।

ফ্রান্স ফাইনালে যাওয়ার পরই শুরু হয়ে গিয়েছে তুল্যমূল্য আলোচনা। একদিকে লিওনেল মেসি, অন্যদিকে কিলিয়ান এমবাপ্পে। এছাড়াও রয়েছে ডি মারিয়া, জুলিয়ান আলভারেজ, ডে পলদের সঙ্গে জিরৌ, গ্রিয়াজমান, ডেম্বেলেদের লড়াই। লাতিন আমেরিকার বিপক্ষে ইউরোপের পাওয়ার হাউজ। কে জিতবে, সে তো সময়ই বলবে। কিন্তু মাঠে নামার আগেই লড়াইটা শুরু হয়ে গিয়েছে।

প্রথমে আসা যাক সদ্য ফাইনালে পৌঁছনো ফ্রান্সের দিকে। করিম বেঞ্জিমা, পল পোগবা, এনগোলো কান্তে এ বছর খেলতে না পারলেও খুব একটা প্রভাব পড়েনি এই দলে। একেই গত বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন, অন্যদিকে দলের আক্রমণ ভাগের ফুটবলারদের দুরন্ত ফর্ম, দিদিয়ের দেশঁ-র ফুটবল মস্তিস্ক – সব মিলিয়ে শুরু থেকেই ফেভারিট তকমা পেয়েছে ফ্রান্স। ২০১৮ বিশ্বকাপের বিশ্বজয়ী দলটির গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়রা রয়েছেন। সব মিলিয়ে গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচ থেকেই নিজেদের চিনিয়েছে ফরাসি ফৌজ।

কে নেই এই ফ্রান্সের দলে? গোলের নিচে হুগো লরিসের অভিজ্ঞ ও ভরসাযোগ্য হাত। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড এবং সেমি ফাইনালে মরক্কো – দু’টো ম্যাচেই অবিশ্বাস্য সব সেভ করেছেন। মরক্কোর সেই কালান্তক ব্যাক ভলি রুখে দিয়েছেন তিনি। রক্ষণে ভারানে অন্যতম ভরসা। তবে সবথেকে শক্তিশালী ফরাসি আক্রমণ ভাগ। উইং ধরে ওসমান ডেম্বেলে এবং কিলিয়ান এমবাপ্পে। তাঁদের মাঝে আতোঁয়া গ্রিয়াজমান, আর সামনে অলিভার জিরৌ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই টিমের সঙ্গে যদি সুস্থ বেঞ্জেমা, পোগবা, কান্তে থাকতেন, তাহলে কোথায় যেত!

কী হতো না হতো, এখন সেটা যাচাই করার সময় পেরিয়েছে। জিরৌ আর এমবাপ্পে যে নিজেদের সবরকম ভাবে মেলে ধরছেন, সেটা প্রতিটা ম্যাচেই দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে কিলিয়ান এমবাপ্পে। বয়স মাত্র ২৩ বছর, কিন্তু এর মধ্যেই সেরাদের তালিকায় নিজের নাম তুলে রেখেছেন। অবিশ্বাস্য গতি, গোল চেনার ক্ষমতা, বিপক্ষের বক্সের সামনে সুযোগ সন্ধানী মেজাজ – সব মিলিয়ে ফরাসি উড়ানের অন্যতম কারিগর তিনি। গোটা ফ্রান্স তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। সেইসঙ্গে রয়েছে গোল করা এবং করানোর ক্ষমতা। মেসিদের সঙ্গে মূল লড়াইটা যে এমবাপ্পেরই হতে চলেছে, সেটা স্পষ্ট করেছেন অনেকে।

পাশাপাশি আর্জেন্টিনাও নিজেদের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে হারের পর কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যায় লা আলবিসেলেস্তেরা। টানা ৩৬ টি ম্যাচে জয়ের ধারা ভেঙে যায়। তারপরই ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে যায় এবারের অন্যতম ফেভারিটরা। মেক্সিকো থেকে ক্রোয়েশিয়া – ম্যাচ জিতে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় মেসিরা। জীবনের শেষ বিশ্বকাপে নিজেকে নতুন করে চেনাচ্ছেন লিওনেল মেসি। তাঁর দুরন্ত ছন্দের পাশাপাশি ভরসা জোগাচ্ছেন জুলিয়ান আলভারেজ, ডি মারিয়া, ডে পল, ডিবালারা। রক্ষণে ওটামেন্ডি ভরসার স্তম্ভ হয়ে আছেন। সেইসঙ্গে রয়েছে এমি মার্তিনেজ। ২০২১-এর কোপা আমেরিকা জয়ের অন্যতম কারিগর তিনি। মারাদোনার অকাল মৃত্যুর আবহে এই পারফরমেন্স আর্জেন্টিনার ভক্তদের আশা দিচ্ছে। বিশেষ করে, ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে মেসি ও আলভারেজের অবিশ্বাস্য যুগলবন্দি চমকে দিয়েছে বিশ্বকে।

তবে এসবের বাইরেও একটি লড়াই ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। মেসি বনাম এমবাপ্পে। দু’জনেই বর্তমানে একই ক্লাবের হয়ে খেলেন – প্যারিস সাঁ জঁ। ক্লাবের আক্রমণ বিভাগের দুই স্তম্ভ এবার পরস্পরের বিপক্ষে। মেসি ঘোষণা করেই দিয়েছেন, ১৮ ডিসেম্বর লুসাইল স্টেডিয়ামের ফাইনালই হবে বিশ্বকাপে তাঁর শেষ ম্যাচ। বিশেষজ্ঞদের মতে, হয়তো আন্তর্জাতিক মঞ্চেও দেশের হয়ে মেসির শেষ ম্যাচ। জীবনে প্রচুর খেতাব, ট্রফি, রেকর্ড জিতেছেন। তৈরি করেছেন লিগ্যাসি, সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়দের তালিকায় শুরুর দিকেই থাকবেন তিনি। ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে গোল করে পেরিয়ে গিয়েছেন বাতিস্তুতাকে। এখন তিনি বিশ্বকাপের মঞ্চে আর্জেন্টিনার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা। বাকি কেবল বিশ্বকাপ। আর একটা ম্যাচ দূরে দাঁড়িয়ে তিনি। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে আপামর বিশ্ব।

এই বিশ্বকাপ যখন খেলছেন, তখন লিওনেল মেসি ৩৫ বছরের ‘বৃদ্ধ’। আগের দুর্বার গতি ফিকে হয়েছে কিছুটা। কিন্তু ঝাঁঝ কমেনি এতটুকুও। বিশেষজ্ঞদের মতে, কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে মেসির এমন চেহারা, এমন আগ্রাসন বোধহয় কেউ দেখেননি। এই মুহূর্তে এমবাপ্পের সঙ্গেই গোল্ডেন বুটের দৌড়ে। গোল্ডেন বলের দৌড়েও তিনি। গ্যালারিতে আর্জেন্টিনার পতাকায় মারাদোনার পাশে তাঁর মুখ। স্বপ্ন, কেবলই স্বপ্ন ছড়িয়ে রয়েছে লুসাইল স্টেডিয়াম জুড়ে। এখানেই বিশ্বকাপের অনেকগুলো ম্যাচ খেলল আর্জেন্টিনা। কাজেই ফাইনালও এই স্টেডিয়ামে হওয়ায় নতুন করে পরিচয় করতে হবে না।

অন্যদিকে রয়েছেন এমবাপ্পে। মেসি-রোনাল্ডো পরবর্তী যুগের সম্ভাব্য সেরা তারকা বলা হচ্ছে তাঁকে। ২০১৮ এবং ২০২২ – দু’টো বিশ্বকাপেই তিনি নিজের জাত চিনিয়েছেন। এরপর আরও কয়েকটি বিশ্বকাপে দেখা যাবে তাঁকে। কতগুলি রেকর্ড ভাঙতে চলেছেন এমবাপ্পে, তার হিসেব এখন থেকেই করতে শুরু করে দিয়েছেন ফুটবল বোদ্ধারা। কাতারের মাটিতেও ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম সেনা নায়ক তিনি। অবিশ্বাস্য গতি দিয়েই বিপক্ষকে ফালাফালা করে দিতে পারেন। ক্লাবের সতীর্থকে যে মাঠে ছেড়ে কথা বলবেন না, সেটা তাঁর হাবেভাবেই স্পষ্ট।

সঙ্গে রয়েছেন জিরৌয়ের মতো স্ট্রাইকার। ডানদিকের উইংয়ে ডেম্বেলে, মাঝে গ্রিয়াজমান – এমবাপ্পের সঙ্গী অনেকে। এঁদের ওপরই ভরসা রাখছেন বিশ্বজয়ী দেশঁ। আপাতত সবার নজর ১৮ ডিসেম্বরের দিকে। ফের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স, না মেসির স্বপ্নপূরণ – অপেক্ষা ফুটবল বিশ্বের।

More Articles