ভিনসেন্টের বিখ্যাত সব ছবির সেই গ্রাম, আজও যেন আস্ত ক্যানভাস
Vincent Van Gogh: জীবদ্দশায় আর্লের মানুষ ভিনসেন্টকে ভালোবাসেনি। বিচ্ছু ছেলের দল ওঁকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ছে।
"শুনেছি দক্ষিণ ফ্রান্সের আলো খুব অন্যরকম। উত্তরের চেয়ে একেবারেই আলাদা। ওই আলো, ওই রং আমি প্রত্যক্ষ করতে চাই। সেখানে সূর্য নাকি এতই উজ্জ্বল, হয়তো নতুনভাবে রং দেখা শিখতে পারব। ঠিক করেছি, এবার দক্ষিণে গিয়ে থাকব। নতুন উদ্যম আর কাজের অনুপ্রেরণার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে বলে আমার ধারণা। হয়তো সেখানেই আমার ছবি আঁকার নিজস্ব কোনও স্টাইল গড়ে তুলতে পারব, আরও সমৃদ্ধ করতে পারব আমার কাজ।"
১৮৮৮ সাল। ভাই থিওকে চিঠিতে এ কথা লিখেছেন ভিনসেন্ট। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীরা ভিনসেন্টকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। প্রায় ৫২টি চিঠিতে উল্লেখ পাওয়া যায় মার্সেইয়ের শিল্পী আদল্ফ মন্টিচেলি-র কথা। একটিতে ভিনসেন্ট লিখেছেন, "উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার এবং তুলি চালানোর যে বিশেষ দক্ষতা রয়েছে মার্সেই শিল্পীদের মধ্যে, তা সমসাময়িক চিত্রশিল্পীদের সংযত স্টাইলের তুলনায় বেশ আলাদা। আমি মন্টিচেলির কাজ নিয়ে খুবই আগ্রহী।" দক্ষিণের ল্যান্ডস্কেপ এবং তাকে ঘিরে থাকা অপূর্ব রং-আলোর টানে প্যারিস ছেড়ে ভিনসেন্ট চলে আসেন দক্ষিণে। গ্রামের নাম আর্ল।
"সমতলভূমি আর্ল। হালকা লাইলাক পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে লালমাটির দেশ। বেয়ে উঠেছে আঙুরলতা। পাহাড়ের মাথায় বরফের মতোই অতি উজ্জ্বল আকাশ, ঠিক যেমনটা দেখা যায় জাপানি ছবিতে।"
আর্ল থেকে থিওকে লেখা প্রথম চিঠিতে গ্রামের বর্ণনায় ভিনসেন্টের প্যালেটে তেলরঙের মিলমিশ। ৩০ র্যু কাভালেরি, আর্লের ঠিকানা থেকে চিঠি যায় থিও-র কাছে। দোতলা বাড়ি, ছোট ছাদ, একতলায় একটি বারান্দা, দেওয়ালের রং হলুদ। এই বাড়ি আমরা দেখেছি 'La maison jaune' (the yellow house) ছবিতে। এখন এই বাড়ির রং সাদা, সবুজ খড়খড়ির জানলা বদলে বসেছে কাচ। বারান্দাটা আছে, ছাদটাও আছে হয়তো। দেওয়ালের গায়ে লেখা আছে - 'ভিনসেন্ট এই বাড়িতে থাকতেন'। (ছবি-১, ২)
আরও পড়ুন- আদিম মানুষের ক্যালেন্ডার আবিষ্কার হলো যেভাবে…
এই বাড়িতে একটি স্টুডিও খোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন ভিনসেন্ট। শিল্পীদের কমিউনিটি হবে, একসঙ্গে থেকে সব ইমপ্রেশনিস্টরা আঁকবেন সকাল-বিকেল-সন্ধ্যার আলো। থিও-র পাঠানো টাকা দিয়ে বাড়িটিকে বাসযোগ্য করে তুলতে থাকেন ভিনসেন্ট, এই স্বপ্নের দিকে চেয়ে। সূর্যমুখীর আলোয় বাড়ি সেজে আর্লে আঁকা বিখ্যাত 'Sunflowers' ক্যানভাসগুলি। বন্ধু পল গগ্যাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার সাক্ষীবাহী এই সূর্যমুখী। হলুদ বাড়িতে ভিনসেন্টের সঙ্গে সময় কাটাতে আসেন গগ্যাঁ। ব্যক্তিগত মনোমালিন্য চরমে পৌঁছলে দু'মাস পর গগ্যাঁ প্যারিস ফিরে যান। ভিনসেন্টকে ভর্তি করা হয় আর্ল হাসপাতালে। পনেরো মাস এই বাড়িতে থেকে আর্লের পথ-মাঠ, জমি-জঙ্গল, নদী-অলিভ বাগান ঘুরে মোট ১৮৬টি ছবি আঁকেন ভিনসেন্ট।
আর্লের রাস্তা বরাবর এখন ভিনসেন্টের অমোঘ উপস্থিতি। পর্যটকদের হাত ধরে এখানে তাঁর ক্যানভাসগুলি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন ভিনসেন্ট। তাঁর প্রিয় গ্রামে সূর্যালোকে খেলা করে ভিনসেন্টের তুলির টেকনিক। শোনা যায়, তেলরঙে আঁকা হাওয়ার শনশন (ছবি-৩)।
১৮৮৮, ৩০ সেপ্টেম্বর। আঞ্চলিক কাগজ Le Chronique artistique et musical- এ ছাপা হয়, "ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী মঁসিয় ভিনসেন্ট নাকি সন্ধেবেলায় রাস্তার গ্যাসলম্ফর আলোয় আমাদের গ্রামের চৌমাথার কোনও ছবি এঁকেছে।" এমন নিস্পৃহ রিপোর্টিংয়ের নেপথ্য ধরা আছে ভিনসেন্টের চিঠিতে:
"আগেকার দিনে রাতের দৃশ্য আঁকা হতো দিনের বেলায় করা স্কেচের ওপর রং বুলিয়ে। কিন্তু আমার মনে হয় সরাসরি রাতের বেলায় আঁকা উচিত রাতের দৃশ্য। সঠিক আলোর অভাবে রঙের টোন হয়তো বোঝা যাবে না, হয়তো আমি নীলকে দেখব গভীর সবুজ, নীলচে-লাইলাককে ভাবব গোলাপি আভাযুক্ত লাইলাক। ওই কালো রঙের গায়ে ফ্যাকাশে সাদা আলো বুলিয়ে রাতের চিত্র আঁকার চিরাচরিত ধারা থেকে বেরোনোর এই একমাত্র উপায়। দেখতে হবে, কেমন সামান্য মোমবাতির আলো রাজকীয় হলুদ আর কমলা রং দেখি আমরা।"
'Café Terrace at Night', এই ছবিটির উল্লেখ ছিল সংবাদপত্রে। রাস্তা ধরে হাঁটলে আজও দেখা যায়, দিনের আলোতে ক্যাফের দেওয়ালের রং কেমন ধার করা হয়েছে ভিনসেন্টের তুলি থেকে। (ছবি-৪,৫)। Café Terrace at Night এখন নামকরা পানশালা। গ্রীষ্মে খোলা থাকে, বাকি সময় বন্ধ।
Alyscamps-এর গাছগুলি ভিনসেন্ট ছাড়া আর্ল শহরের মতোই মৃতপ্রায় মনে হয় (ছবি-৮, ৯)। হয়তো হেমন্তের আলোয় গাছগুলি ভিনসেন্টের ক্যানভাসের মতো হয়ে ওঠে— "মাটিতে যেন ঘন ঝরাপাতার কার্পেট পাতা হয়েছে, হলুদ এবং কমলা পাতার কার্পেট। কিছু পাতা এখনও ঝরছে, যেন তুষারকণা। আর গাছের ফাঁকে অলিগলিতে গাঢ় রঙের কিছু প্রেমিক-যুগলের অবয়ব।"
এখান থেকে একটু দূরে, পাড়ার মোড়টা একটু ঘুরে 'Entrance to the Public park' এবং 'Courtyard of the Hospital' একরকম রয়েছে কারণ পাবলিক প্রপার্টির কোনও রদবদল হয়নি (ছবি-৬,৭)। আর্লের এই হাসপাতালে ডিসেম্বর ১৮৮৮ থেকে মে ১৮৮৯-এর মধ্যে তিনবার ভর্তি করা হয় ভিনসেন্টকে।
শহরের হল্লা ছেড়ে 'Langlois Bridge with Washerwomen' প্রায় ছবির মতোই রয়েছে (ছবি-১০), যদিও এ পথে আজকাল বেশি কেউ আসে না। বেপথে ঘুরে এখানে পৌঁছতে আমাদের অনেক সময় লেগে যায় কারণ আর্লবাসীরা এর খবর জানে না। 'Old Mill' ছবির বাড়িটাও আর দেখা যায় না। অনেক ঘুরে ও-পাড়ার এক পথচারীর দেখা মেলায় জিজ্ঞেস করলাম, "গম ভাঙানোর একটা পুরনো কারখানা ছিল এখানে, ভিনসেন্ট যার ছবি এঁকেছিলেন, জানেন কোথায়?" বিব্রত লোকটি জানায়, এ তল্লাটে সেরকম কিছু নেই। ভিনসেন্টের ছবি দেখতে হলে শহরে যেতে হবে। পুরনো কলের ধ্বংসাবশেষ আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম, যদিও এ সম্পর্কে পাড়ার মানুষ চরম উদাসীন। 'Old Mill' ভেঙে অন্য বাড়ি উঠেছে এখন। মাঝের টাওয়ারটা দেখে চেনা যায় ভিনসেন্টের ছবি (ছবি- ১১, ১২)।
জীবদ্দশায় আর্লের মানুষ ভিনসেন্টকে ভালোবাসেনি। বিচ্ছু ছেলের দল ওঁকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ছে। পুলিশের কাছে গ্রামবাসীরা দরখাস্ত জমা করে, ভিনসেন্টকে গ্রাম থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক। তার উপস্থিতি গ্রামের লোকজনের জন্য বিপজ্জনক। সমাজ ও সকলের নিরাপত্তার খাতিরে সাঁ-রেমি-দ্য-প্রোবভঁস-এর মানসিক আবাসনে চলে যান ভিনসেন্ট। সেখানেও প্রায় ১৫০টির বেশি ছবি এঁকেছিলেন ভিনসেন্ট।
আরও পড়ুন- কেন এত জনপ্রিয় ফরাসি চুম্বন?
সাঁ-রেমির রাস্তায়, আর্লের রাস্তার মতোই, গোলাকৃতি কাঁসার ফলকে ভিনসেন্টের স্বাক্ষরযুক্ত দিকনির্দেশ ছড়িয়ে। সে পথ ধরে এগোলে দেখা যাবে, রাস্তার ধারে ধারে আছে ভিনসেন্টের ক্যানভাস। Avenue Vincent van Gogh-এর শুরুতে 'Almond Blossoms'-এর পাশে এখন লম্বা একটা বাড়ি, যার বাগানে কোনও কাঠবাদাম গাছ নেই। দু-পা হাঁটলেই যদিও দেখা যায়, আশেপাশে অনেকগুলি বাদাম গাছ। এর মধ্যে কোন গাছটি এঁকেছিলেন ভিনসেন্ট? (ছবি-১৩)।
একসময় এখানে রাস্তার ধারে নাকি সাইপ্রেস গাছের সারি ছিল, যেমন দেখা যায় ভিনসেন্টের আঁকায়। সেইসব ছবির ফলক লাগানো রয়েছে এখনও। যদিও দু-একটি সাইপ্রেস ছাড়া সবটাই স্মৃতি (ছবি- ১৪-১৮)। শুধু, পাহাড় আর অলিভ ক্ষেত, লাইলাক আর গাঢ় নীল পথঘাট, জলপাই রঙের রোদ্দুর, যা মানুষ বদলাতে পারেনি, তার সামনে ভিনসেন্টের ছবিগুলো রাখা আছে আয়না ধরার মতো (ছবি- ১৯-২১)।
Avenue Vincent van Gogh-এর অপর প্রান্তে সাঁ পল্ হাসপাতাল। দীর্ঘ একবছর এখানে চিকিৎসার পর দক্ষিণ ফ্রান্সকে বিদায় জানিয়ে ভিনসেন্ট ফিরে যান (ছবি-২২)।
ছবির মতো দু’টি গ্রাম আর্ল এবং সাঁ-রেমি। দলে দলে মানুষ এখানে আসে ভিনসেন্টকে খুঁজতে। আমাদের মতো কিছু মানুষ বারবার এই গ্রামে ফিরে যায়, ভিনসেন্ট যে পথে হেঁটেছিলেন সেই ধুলোয় নিঃশ্বাস নেবে বলে, যে আলো তিনি দেখেছিলেন তাতে গা ভেজানোর জন্য আর আকাশের ভেসে যাওয়া মেঘের চলনে ভিনসেন্টের অতুলনীয় তুলির টান খুঁজবে বলে। আর্ল এবং সাঁ-রেমি আক্ষরিক অর্থেই ছবির গ্রাম। ভিনসেন্টকে যারা আশ্রয়ও দিয়েছিল, নির্বাসনও। আজ সেখানে ভিনসেন্টকে বাঁচিয়ে রাখার সকরুণ প্রচেষ্টা। পুরো গ্রামটাই আস্ত জাদুঘর! ক্যানভাস থেকে ক্যানভাসে আমরা হেঁটে বেড়াই কুরোসাওয়ার স্বপ্নের মতো। আর আশেপাশে ক্রমশ বদলে যাওয়া জীবন্ত ক্যানভাসে প্রিয় দক্ষিণের সোনালি আলোর আকাশের ভুলত্রুটি যেন শুধরে দিচ্ছেন ভিনসেন্ট।