প্রায় ৭০ বছর পরিচয়হীন! কলকাতার বুকে একখণ্ড বার্মা কলোনিতে যেভাবে বাঁচেন উদ্বাস্তুরা
Burmese Colony Basirhat: বর্মায় ভারতীয়দের বসবাস দু’হাজার বছরেরও আগে থেকে৷ ব্রিটিশ আমলে বর্মায় বাঙালিদের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি৷
সাল ১৯৬৪। ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী তখন জওহরলাল নেহরু। বার্মা থেকে এদেশে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসেন এই বাংলায়। নিজের ভিটে ছেড়ে, স্মৃতি ছেড়ে কোনওরকমে পশ্চিমবাংলায় এসে মাথা গোঁজে ৪৪টি পরিবার। স্টিমারে, নৌকা করে বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে তারা এসে পৌঁছন বসিরহাটে। পরিচয় উদ্বাস্তু, শরণার্থী। শরণ দেয় পশ্চিমবাংলা। এই ৪৪ টি পরিবার বসিরহাট পৌরসভার যে ৭ নম্বর ওয়ার্ডে বসবাস শুরু করে সেই এলাকা তবে থেকেই বার্মা কলোনি হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে।
তবে বার্মাদেশ থেকে এলেও তারা আর বার্মিজ নন। তারা কি এদেশের? জানা নেই। স্থায়ী ঠিকানা নেই, মাথার উপর ছাদ নেই। কোন দেশের যে নাগরিক সঠিক পরিচয়পত্রও নেই। আর পরিচয়পত্র না থাকার কারণে সরকারি সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। রেঙ্গুনের স্মৃতি ফিকে হয়ে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু এদেশে পাকা জমি জোটেনি। সেই সময় প্রায় লাখ তিনেকেরও বেশি ভারতীয়কে বর্মা অর্থাৎ আজকের মায়ানমার ছেড়ে আসতে হয়েছিল৷ বর্মা সরকার সে দেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের বলেছিল , বর্মায় থাকতে হলে বর্মার নাগরিকত্ব নিতে হবে৷ ভারতীয়দের একটা বড় অংশই সে প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি৷ ইন্দিরা গান্ধি এবং বর্মার জুন্টা সরকারের প্রধান জেনারেল নে উইনের মধ্যে একটি চুক্তি হয়৷ সেই চুক্তির দরুণ সে দেশে থাকতে অনিচ্ছুক তিন লক্ষেরও বেশি ভারতীয় উদ্বাস্ত্তকে এদেশে আশ্রয় দেওয়া হয়৷ মূলত পশ্চিমবঙ্গেই আসেন তারা কারণ উদ্বাস্তুদের অধিকাংশই বাঙালি৷
আরও পড়ুন- গায়ে জাতীয় দলের জার্সি, মনে চিকিৎসার মন্ত্র, বিশ্বের বিস্ময় আফগান শরণার্থী নাদিয়া নাদিম
বর্মায় ভারতীয়দের বসবাস দু’হাজার বছরেরও আগে থেকে৷ ব্রিটিশ আমলে বর্মায় বাঙালিদের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি৷ বর্মা থেকে ভারতীয়দের ভারতে ফিরে আসা শুরুও হয় ব্রিটিশ আমলেই৷ ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন জাপানিরা বার্মা পৌঁছয় তখন থেকেই এদেশে চলে আসতে থাকেন ওদেশের ভারতীয়রা৷ ব্রিটিশ সরকারের কর্মচারী হিসেবে ভারতীয়দের ভূমিকা পছন্দ করত না সাধারণ বার্মিজরা৷ জাপানিরা বর্মা আসার পর সরকারি চাকরি নিয়ে ভারতীয়দের উপর বার্মিজদের অত্যাচার শুরু হয়৷ বহু ভারতীয়ের মৃত্যুও হয়৷ তখন বাধ্য হয়েই বহু ভারতীয় বার্মা ছেড়ে ভারতে চলে আসেন৷
কিন্তু বার্মা কলোনির বাসিন্দাদের শরণার্থী দশা ঘোচে না। বারবার প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েও, সরকার বদল হয়েও তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা হয়নি বলেই অভিযোগ ছিল। ২০২৪-এর লোকসভার ভোটের আগে বসিরহাট দক্ষিণের বিধায়ক সপ্তর্ষি বন্দোপাধ্যায় প্রচারে গেলে তাঁকে এই সমস্যার কথা জানান বার্মা কলোনির বাসিন্দারা। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের উদ্যোগে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা শাসকের দপ্তর ও পূর্ত দফতরের আধিকারিকরা এই ৪৪ টি পরিবারের সঠিক পরিচয়পত্র ও জমির পাট্টা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন এতদিনে। যদি সেই পরিচয় পত্র ও পাকাপাকিভাবে জমির পাট্টা পান এই উদ্বাস্তুরা, তাহলে প্রায় ৭০ বছর পর, বহু প্রজন্ম বাংলায় কাটিয়ে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার স্বপ্নপূরণ হতে দেখবেন প্রায় ২০০ মানুষ। ভুলবেন সেই কোনকালে আরেক দেশ ছেড়ে আসার ভীতি, অনিশ্চিততম রাত্রিগুলো ফুরোবে এবার।