বেছে বেছে মন্ত্রীদের তোপ, কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ মমতার?

Mamata Banerjee: এদিন বৈঠক থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সাফ হুঁশিয়ারি, ‘ রাজ্যের আইডেন্টিটি যেন নষ্ট না হয়।’ নাম না করেই ‘বাইরের লোক’ ইস্যুতে এদিন গর্জে ওঠেন মমতা।

লোকসভা ভোটে কার্যত বিজেপিকে ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছে তৃণমূল। তবে এই নিরঙ্কুশ জয়ের মধ্যেও কাঁটার মতো জেগে রয়েছে পুরসভাগুলি। লোকসভা ভোটের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে শহর কলকাতার একটা বড় অংশের মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে শাসক দল তৃণমূলের থেকে। কলকাতা উত্তর ও দক্ষিণে জিতলেও কলকাতা পুরসভার ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ছেচল্লিশটিতেই পিছিয়ে তৃণমূল। সেই সব কটি ওয়ার্ডই দখল করেছে এবার বিজেপি। এমনকী তৃণমূলের যথেষ্ট পরিচিত মেয়র পারিষদদের ওয়ার্ডেও জয় আসেনি। এই নিরঙ্কুশ জয়ের মধ্যেও সেই ব্যাপারটি গোড়া থেকেই বিঁধছে তৃণমূলকে। আর সে নিয়েই এবার পুরবৈঠকে কার্যত খড়্গহস্ত হলেন মমতা। এমনকী নিজেদের দলের মন্ত্রীদেরও বললেন না ছেড়ে কথা।

গত কয়েকদিন ধরেই প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে টুকরো টুকরো অসন্তোষের কথা শোনা গিয়েছিল। তবে সোমবার নবান্নের সভাঘরে পুরসভাগুলির সঙ্গে বৈঠকে রেগে অগ্নিশর্মা হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর রোষের মুখে পড়ে একাধিক পুরসভা। বিধাননগর, নিউটাউন, কলকাতা কর্পোরেশন সকলকেই এদিন মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নের মধ্যে পড়তে হয়েছে। প্রোমোটার রাজ, প্রশাসনের একাংশের কাটমানি, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের গা ছাড়া মনোভাব-সহ একাধিক ইস্যু তুলে এক হাত নিলেন রাজ্যের পুর-প্রতিনিধিদের। সবচেয়ে বেশি কড়া আক্রমণের মুখে পড়েন রাজ্যের দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু। নাম করেই রাজ্যের মন্ত্রী সুজিত বসুকে তীব্র ভর্ৎসনা করলেন দলনেত্রী। মমতার কথায়, "কারও কারও অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, থানার আইসি, জেলাশাসক, এসডিও হলে ইনকাম করা ৷ অনুগ্রহ করে আর এসব করবেন না ৷ এবার খুব চোখে লাগছে ৷ রাজারহাটে সল্টলেকে ইচ্ছামতো বাইরের লোক বসাচ্ছে সুজিত বসু ৷"

আরও পড়ুন: ৪৬টি ওয়ার্ডে পিছিয়ে! শহর কলকাতায় কেন কাজ করল না মমতা-ম্যাজিক?

বিধায়ক, মন্ত্রী আমলা থেকে শুরু করে পুলিশ এবং পুরসভা নিয়ে পর্যালোচনায় মুখ্যমন্ত্রীর রোষের মুখে সকলেই। একটা সময় তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এমনটাও বলতে শোনা গেল, "তাহলে কি ঝাঁটা হাতে এবার নামতে হবে আমাকে ?" পুরসভাগুলোকে নিয়ে আলোচনা উঠতেই এদিন পুকুর ভরাট, প্রমোটার রাজ, সরকারি জমি বেহাত হয়ে যাওয়া, ফুটপাত দখল একের পর এক অভিযোগ এসেছে মমতার মুখে। স্পষ্ট ভাষায় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, অনেক হয়েছে। কাজকর্মে আগামী দিনে কোনও অস্বচ্ছতাই বরদাস্ত করবেন না তিনি।

কার্যত এদিনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর তোপের একটা বড় অংশই গিয়েছে সুজিত বসুর ভাগ্যে। মুখ্যমন্ত্রীর একের পর এক অভিযোগের ঠেলায় খানিকটা হকচকিয়েও যান দমকলমন্ত্রী। তাঁকে বলতে শোনা যায়, "আমি এই বিষয়ে কিছুই জানি না।" সে সব কার্যত উপেক্ষা করেই মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, "সল্টলেক আমার বলতে লজ্জা লাগছে। রাজারহাটেও শুরু হয়েছে বেআইনি দখল। সল্টলেকেও ইচ্ছামতো সুজিত বসু লোক বসাচ্ছেন। কেন বাইরের লোক বসবে।” এরপরেই মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন, "কত টাকার বিনিময়ে সল্টলেকে জবরদখল হচ্ছে ? কেন কর্পোরেশন কাজ করছে না ? আমি কোনও অবহেলা বরদাস্ত করব না ৷ একটা চক্র কাজ করছে ৷ কোনওভাবেই এসব চলবে না ৷ সব ভেঙে দেব ৷" এরপরই একটি ছবি তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “ছবি দেখালে নিজেরাই লজ্জা পাবেন। এআরডি অফিসের সামনের রাস্তাও দখল হয়ে গিয়েছে। একটা করে ত্রিপল লাগাচ্ছেন বসে পড়ছেন। কেন? হোয়াই…হোয়াই…হোয়াই? কেন রাস্তা ঝাড় দেয় না। শুধু কি উপর দিকে তাকালে হবে? কলকাতা শহরের ভিডিয়ো করা ছিল কোন রাস্তা কতটা দখল রয়েছে। তা সত্ত্বেও একটা করে নতুন ওসি আসে। আর বসিয়ে দেয়। আমি বেরলেই দেখতে পাই। অথচ পুলিশের চোখে পড়ে না।”

সেক্টর ফাইভের ওয়েবেলের সামনে খাবার দোকানের রমরমা নিয়ে তাঁকে সরব হতে দেখা যায়। তিনি জানান, “ওয়েবল আমি নিজে চোখে দেখে এসেছি। কারোও কথা না শুনে। একটু শিফট করাতে হবে। ওইখানে অনেকে আসেন। ফুটপাতে কালো-কালো ত্রিপল দিয়ে ঘেরা। একটু দূরে গিয়ে খাবার খাবেন। আমি বেকার ছেলেদের চাকরি খাওয়ার পক্ষে নই। এভাবে রাস্তা আটকে খাবার দোকান না করে আলাদা করে ফুড জোন করা যেতে পারে ৷” এদিন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিধান নগরের মেয়র কৃষ্ণ চক্রবর্তীও। মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন, "বিধান নগরের সাফাইয়ের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না। বিভিন্ন জায়গায় ময়লা জমে আছে।"

শুধু সল্টলেক নয়, কলকাতার হাতিবাগান, গড়িয়া মার্কেট নিয়েও কড়া আক্রমণ করেছেন মমতা ৷ তাঁর কথায়, "গড়িয়াহাটে কলকাতা কর্পোরেশনের তরফ থেকে যে স্টলগুলো দেওয়া হয়েছিল তার পরেও দখলদারি বাড়ছে ৷ এক্ষেত্রে কালো প্লাস্টিক টাঙিয়ে আবার এলাকা সৌন্দর্য নষ্ট করা হচ্ছে ৷" বিভিন্ন পুরসভায় পানীয় জল ও রাস্তার আলোর যথেচ্ছ অপচয় নিয়েও সোমবার ক্ষোভপ্রকাশ করেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "জোকায় এখনও কাঁচা রাস্তা আছে ৷ কলকাতা কর্পোরেশনের অধীনে থাকা সত্ত্বেও কেন এমনটা হবে ৷ পুকুর ভরাট হলে সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে দিতে হবে ৷ যারই হোক, যত বড় অফিসার মন্ত্রীরই হোক না কেন বরদাস্ত করব না ৷ নবান্নের পাশেও বেআইনি বাড়ি হয়েছে ৷ রাস্তা ফুটপাথে জবরদখল বেড়েই চলেছে ৷ পুরসভা- পুলিশ সবাই চোখ বন্ধ করে আছে ৷ কেউ দেখছে না ৷" জল অপচয় রুখতে আধুনিক ব্যবস্থা করা যায় কি না, সেই পরামর্শও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক থেকে।

একইভাবে বিদ্যুতের অপচয় রুখতে বিকেল পাঁচটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত পুরসভা গুলিতে আলো জ্বলবে বলে সময়ও বেধে দিয়েছেন তিনি। এখানেই শেষ নয়, বর্ষা এলে বিভিন্ন জায়গায় শর্ট সার্কিটের সমস্যার কথা শোনা যায় ৷ এদিন তা নিয়েও রাজ্যের বিদ্যুৎ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর অরূপ বলার চেষ্টা করেছিলেন, এই বিষয়টি দেখে পুরসভাগুলিই। এক্ষেত্রে তাকেও এই ব্যবস্থা সঙ্গে যুক্ত হওয়ার নির্দেশ দেন মমতা। মোটের উপর রাজনীতির রং না দেখে পুলিশ আধিকারিক জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সকলকে এক লাইনে রেখে মূলত নাগরিক পরিষেবা উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন এক্ষেত্রে ভুল ভ্রান্তি থাকলে আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই তা শুধরে নেওয়ার জন্য সময় দিয়েছেন ৷

পুরসভার টেন্ডার ডাকা নিয়েও মমতার এদিন রণংদেহি মূর্তি দেখা গেল। ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী বললেন, 'কে খাচ্ছেন না জানি না, নিশ্চয় দিয়েই খাচ্ছেন’- টেন্ডার নিয়েও চলছে দুর্নীতি! খোদ মমতার মুখেই এমন অভিযোগ। বললেন, 'বালির এসডিও অমৃতা কী করছেন, কেন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। নিজেরা টেন্ডার দিচ্ছেন, কার থেকে কতটা খাচ্ছেন জানি না। কে খাচ্ছেন না জানি না। নিশ্চয় দিয়েই খাচ্ছেন। আমি এই কথাগুলো বলার জন্য মোটেই খুশি নেই, আমি দুঃখিত।' এরপরেই তিনি ঘোষণা করেন, এবার পুরসভার কোনও টেন্ডার স্থানীয় ভাবে ডাকা যাবে না। সব টেন্ডার সেন্ট্রালি হবে। সরকার তার তদারকি সরাসরি করবে।

এদিন বৈঠক থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সাফ হুঁশিয়ারি, ‘ রাজ্যের আইডেন্টিটি যেন নষ্ট না হয়।’ নাম না করেই ‘বাইরের লোক’ ইস্যুতে এদিন গর্জে ওঠেন মমতা। দিদি বলেন,'আমি একটা রাজ্যের রেভিনিউ পাই, তার উপর কেন্দ্র সরকার টাকা দেয় না। কোত্থেকে চালাব জানি না, ৩ বছর ধরে ফেস করছি… তারমধ্যে আরও ৫ টা রাজ্যের সব কিছু আমাকে টানতে হচ্ছে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারও সে পাচ্ছে, স্বাস্থ্যসাথীও সে পাচ্ছে, বিনা পয়সার রেশনও সে পাচ্ছে।' ক্ষোভের মাত্রা বাড়িয়ে মমতা বলেন,'আমার কাছে তো সেই ট্রেজারি নেই যে ৫ টা রাজ্যকে টানতে পারব।' ক্ষোভের সুর চড়া করে মমতা বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকার তো আমাদের হাতে নেই, তারা তো আমাদেরই টাকা দেয়না। আমি ৫ টা রাজ্যকে টানব কী করে? নিশ্চয়ই সে চিকিৎসা পাক, আমরা তাই, আমাদের রাজ্যের হাসপাতালে আসুক… পয়সা দিয়ে করবে।’ মমতা বলেন, ‘আমাদের ঘাড়ের ওপরে আমি দেখছি যত বোঝা, এরপর তো স্টেটটার আইডেন্টিটি নষ্ট হবে, বাংলায় কথা বলার লোক খুঁজে পাবেন না।’

আরও পড়ুন:খোদ মমতার বিরুদ্ধেই তোপ! তমলুকে হেরে হঠাৎ কেন ভোলবদল ‘তাজা নেতা’ দেবাংশুর?

রাজ্যের নিজস্ব পরিচিতি নিয়ে বারবার সরব হতে দেখা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে এদিন। 'হিন্দি ইংরেজি আজ সবাই জানেন, আমি কোনও ভাষাকে ছোট করছি না। সবাইকেই বড় করেই বলছি। মনে রাখবেন সব রাজ্যের একটা নিজস্ব আইডেন্টিটি রয়েছে। একটা সংস্কৃতি আছে, অন্য সংস্কৃতিকেও আমরা ভালোবাসি, সম্মান জানাই, কিন্তু বাংলার আইডেন্টিটিকে নষ্ট করার চক্রান্তে যাঁরা লিপ্ত, আমি তাঁদের সকলকে সাবধান করে দিয়ে বলছি, বাংলার আইডেন্টিটি অর্থের বিনিময়ে যেন নষ্ট না হয়। এটা আমার প্রথম আর শেষ সতর্কবার্তা।'

সব মিলিয়ে লোকসভা ভোটের রেজাল্টে কলকাতার পুরসভাগুলিতে যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে তৃণমূল, তা ঘিরে যে যথেষ্ট চিন্তিত মমতা, তা বোঝা গিয়েছে সেদিনের সভা থেকেই। লোকসভা ভোটে তৃণমূলের চমকপ্রদ ফলাফলের পিছনে রয়েছে আসলে গ্রামাঞ্চলগুলি, তা মেনেছেন অনেকেই। মমতার একাধিক জনমোহিনী প্রকল্প সেখানে মমতাকে অনেকটাই ব্রাউনি পয়েন্ট দিয়েছে তা অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু শহরাঞ্চল? সেখানে কেন তৃণমূলের থেকে মুখ ঘোরাচ্ছে মানুষ? কেন কাজ করছে না মমতা-ম্যাজিক? লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পর থেকেই বিষয়টি বিশ্লেষণ করা শুরু করেছিল ঘাসফুল শিবির। মানুষের ক্ষোভের একাধিক কারণ খুঁজে বের করে সেসব যে সমাধানের রাস্তা খুঁজতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী, তা নবান্নের বৈঠক থেকেই আসলে স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছেন মমতা। এমনকী এ নিয়ে ভবিষ্যতে কড়া সিদ্ধান্ত নিতেও যে পিছু হঠবেন না মমতা, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন সোমবার ওই বৈঠক থেকে।

More Articles