আসন্ন বিশ্বকাপে কাদের পায়ে নাচবে ফুটবল? যুদ্ধের আগুনে শেষ ফিলিস্তিনিদের ফুটবলের স্বপ্ন

Israel-Palestine conflict: সামনেই বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব। কিন্তু কাদের বাছবে দেশ, কাদের পায়ে নেচে উঠবে ফুটবল! কার্যত যুদ্ধের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ ফিলিস্তিনি ফুটবল টিম।

ময়দানে জালের মধ্যে বলটাকে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য যে লড়াই, স্কোরবোর্ডে উজ্জ্বল হয়ে ওঠার জন্য যে হাড্ডাহাড্ডি যুদ্ধ, সে যুদ্ধটা এই যুদ্ধের থেকে একেবারে আলাদা। সেই যুদ্ধেও সেয়ানে সেয়ানে টক্কর আছে, সমস্ত শক্তি লাগিয়ে বলের পিছনে ধাওয়া করা আছে, কিন্তু রক্তক্ষয় নেই, মরে যাওয়া নেই। যুদ্ধ শেষে বিরোধীদলের সেনাকে জড়িয়ে ধরা যায় সেখানে অবহেলে। করমর্দন করে শুভেচ্ছা জানানো যায়। আর ফুটবলের মাঠের সেই বন্ধুত্বপূর্ণ যুদ্ধটাকে একেবারে শেষ করতে উঠেপড়ে লেগেছে এই অন্য যুদ্ধটা। সামনেই বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব। যেখানে সেরা খেলোয়ারদের মহারণে পাঠানোর জন্য বেছে নেওয়ার কথা ছিল প্যালেস্টাইনের। কিন্তু কাদের বাছবে দেশ, কাদের পায়ে নেচে উঠবে ফুটবল! কার্যত যুদ্ধের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ ফিলিস্তিনি ফুটবল টিম।

গত তিন সপ্তাহ ধরে ইজরায়েলি আগ্রাসনে কার্যত ছাড়খার গাজা। ইতিমধ্যেই গাজায় মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৮ হাজার। মৃত্যুর শব্দ শুনতে পাচ্ছে গোটা গাজাই। এই ক'দিনে ৬ হাজারেরও বেশি রকেট হামলা হেনেছে ইজরায়েল গাজায়। এই সর্বগ্রাসী হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে গাজার শিশুদের। প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। সামগ্রীক ভাবে গাজা এবং প্যালেস্টাইন যেন পিছিয়ে গিয়েছে সভ্যতা থেকে কয়েক মাইল দূরে। ফুটবলের মতো অনেক কিছুই সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে প্রশ্নের মুখে।

আজ থেকে নয়, বারংবার ইজরায়েলি আগ্রাসনের মুখে পড়েছে প্যালেস্টাইনের ফুটবল দল। ২০০৮ সালে গাজা উপত্যকায় ইজরায়েলি বিমানহামলার মুখে পড়েন হাজেম আলরেখাবি নামে এক প্রতিভাবান ফুটবলার। হাজেম তখম সবে ১৯। কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে একটি বাসে উঠেছিলেন। মাথায় চক্কর কাটছিল ইজরায়েলের একটি F-16 যুদ্ধবিমান। সেই বিমান থেকেই নেমে এসেছিল ক্ষেপণাস্ত্র। ওই বাসে থাকা সমস্ত যাত্রীই মারা যান। দেহগুলিকে সাদা চাদরে মুড়িয়ে রেখে আসা হয়েছিল মর্গে। হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন পরিবারের লোকেরা। হাজেমও মারা গিয়েছেন বলেই ভেবেছিলেন সবাই। কিন্তু দেহ শনাক্ত করতে গিয়ে মা দেখেন ছেলের হাতটা যেন একটু নড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় চিকিৎসা। প্রাণে বেঁচে যান হাজেম। কিন্তু আর কোনওদিন মাঠে নামা হয়নি তাঁর। ফুটবলের স্বপ্ন শেষ হয়ে গিয়েছিল ওই বাসেই।

আরও পড়ুন: জলপাই ক্ষেতে ছিটকে উঠল কৃষকের রক্ত, আর কত বিলালের নিথর দেহ দেখে থামবে ইজরায়েল?

কিন্তু ছাই থেকে যেভাবে জেগে ওঠে ফিনিক্স, সেভাবেই যেন ফের জেগে উঠেছিলেন রাফার বাসিন্দা হাজেম। ২০১১ সালে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে চলে যান তিনি। সমস্ত প্রতিকূলতাকে দূরে সরিয়ে ফের মাঠে নামেন। তার পর থেকে অন্তত ৮টি ক্লাবের হয়ে খেলেছেন হাজেম। ২০০৬ সালে ইউইএইএ কাপে যে ভাবে নিজের দেশকে লাজারাসের মতো জাগিয়ে তুলে জয়ের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, ঠিক সে ভাবেই নিজের জীবনেও ম্যাজিক ঘটিয়ে ফেলেছিলেন তরুণ এই ফুটবলার।

গত গ্রীষ্মে নিজের শহরে ফেরেন হাজেম। নিজের ক্লাব শবাব রাফাহে এসে যোগ দেন। হাজেমের ভাই বছর ৩৮-র মহম্মদ খেলতেন সেখানে। ২০২৩-২৪ সেশনে ওই ক্লাব থেকে অবসর নেওয়ার কথা ছিল তার। আসন্ন বিশ্বকাপে মনোনীত হওয়ার, অংশ নেওয়ার স্বপ্ন ছিল ভিতরে ভিতরে খুব। কিন্তু সেই স্বপ্নে ফের বাধ সাধল ইজরায়েল। অক্টোবরের গোড়ায় ফের লেগে গেল যুদ্ধ।

As Palestine prepare for upcoming World Cup qualifiers, footballers are subjected to the wrath of Israeli violence

১১ অক্টোবর, গাজায় একের পর এক বোমা হানছে ইজরায়েল। ভয়াবহ শব্দ আর বারুদের গন্ধে কান পাতা দায়। হামাস নিধনের নেশায় সেই থেকে এন্তার নিরপরাধ গাজাবাসীকে মেরে চলেছে ইজরায়েল সরকার। সেদিনের হামলা নামল হাজেমের বাড়িতেও। ধ্বংসস্তূপের তলা থেকে উদ্ধারকারীরা যখন মহম্মদের দেহটা টেনে বের করছেন, তখনও তার শরীরে শাবার রাফাহ ক্লাবের জার্সি, পায়ে মোজা। হাজেম কোথায়, আদৌ বেঁচে আছেন, না ভাইয়ের পাশেই কোথাও ঘুমিয়ে পড়েছেন, জানে না কেউ। পর পর দু'বার লাজারাসের মতো বেঁচে উঠেছিলেন, ছাই থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন আগুনপাখির মতো! এবার বোধহয় আর পারলেন না আলরেখাবি-ব্রাদার। আর তাঁদের সঙ্গেই, তাঁদের মতো আরও অনেক ফিলিস্তিনি ফুটবলারের সঙ্গে ক্রমে অস্তে ঢলে পড়ছে ফিলিস্তিনি ফুটবল দল। ক্রমে নিভে আসছে বিশ্বকাপের মাঠে খেলার স্বপ্ন, কানে ক্রমে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে গ্যালারিভর্তি ফুটবলপ্রেমীদের চিৎকার। আর তার জায়গায় ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে বোমাগুলির শব্দ, নিঃশ্বাস চেপে ধরছে বারুদগন্ধী বাতাস।

১৯২৮ সালে পথচলা শুরু করে প্যালেস্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। পরের বছরই ফিফায় যোগ দেয় তারা। কিন্তু ক্রমে ইজরায়েলি আগ্রাসনের প্রভাবে ইহুদি সংগঠন হয়ে ওঠে সেটি। ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল নামে ভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর নাম বদলে যায় সংগঠনটির। প্যালেস্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন অচিরেই হয়ে ওঠে ইজরায়েল ফুটবল অ্য়াসোসিয়েশন। কিন্তু ফিলিস্তিনি ফুটবলাররা তখনও লড়েছিলেন নিজস্ব দলের জন্য। ফিলিস্তিনের নিজস্ব জাতীয় দল। ১৯৯৮ সাল নাগাদ ফের ছাই থেকে জেগে ওঠে প্যালেস্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। ফিফার সদস্যপদও পায় তারা। কিন্তু যতবার ফিলিস্তিনিরা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে, তাদের গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে ইজরায়েল। ফের সেই আগ্রাসন দেখছে প্যালেস্টাইন। তার মধ্যেও ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ফুটবলের মাঠে নিজেদের জাদু দেখিয়েছে তারা। পাঁচ-পাঁচটি ইজরায়েলি যুদ্ধ থেকে মাথা বাঁচিয়ে জাতীয় দল হিসেবে অংশ নিয়েছে তিনটি এশিয়ান কাপ প্রতিযোগীতায়।

কিন্তু গাজার কপাল থেকে যুদ্ধের অভিশম্পাত যেন সরার নয় কখনও। ২০২৬ বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব শুরু হওয়ার কথা ছিল নভেম্বর থেকেই। এর মধ্যে আবার ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এশিয়ান কাপও রয়েছে। ফলে গত কয়েকমাস ধরেই ফিলিস্তিনি ফুটবলে তুঙ্গে ছিল উত্তেজনা। কিন্তু সেসব কিছুই ছিল ৭ অক্টোবরের আগে পর্যন্ত। যেদিন হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল ইজরায়েল, সেদিন থেকেই সেই উত্তেজনায় জল পড়েছে। দেশে পড়েছে ইজরায়েলের বোম।

As Palestine prepare for upcoming World Cup qualifiers, footballers are subjected to the wrath of Israeli violence

বছর তিরিশের ফুটবলার মহম্মদ বালা। ফুটবলের কেরিয়ার গাজা ছেড়ে জর্ডনে পাড়ি দেন। সেখানেই জাতীয় দলে অভিষেক হয় তাঁক। ওমান ও মিশরের পাঁচটি ক্লাবের হয়ে খেলেছেন তিনি। শেষপর্যন্ত হাজেমের মতোই দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন বালা। ফিলিস্তিনি জাতীয় দলে এসে ঢুকবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু হল না তা শেষপর্যন্ত আর। গত ১০ অক্টোবর সোশ্যাল মিডিয়ায় বালা লেখেন, "সম্ভবত আর কিছুক্ষণ। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি ক্রমশ। টেলিকমিউনিকেশন, ইন্টারনেট ও ইলেকট্রিসিটি সংস্থাগুলো বিনষ্ট করে দিয়েছে ইজরায়েল বোমা ফেলে। ব্যাটারি ফুরিয়ে আসছে। ডিজেল নেই, নিভে আসছে জেনারেটরও। আমরা চুপচাপ মরে যাবো। গোটা পৃথিবীর থেকে দূরে, বন্ধুবান্ধবদের দৃষ্টির থেকে অনেক দূরে নীরবতার মধ্যে নিথর হয়ে যাবো আমরা।"

বালার বন্ধু ও ফুটবলার ২৮ বছরের ওয়াদি। ২০১৪-র যুদ্ধের স্মৃতি এখনও তাড়া করে ফেরে তাঁকে। এই যুদ্ধে কে কোথায় কেমন আছেন, জানেন না ওয়াদি। গাজায় যাদের সঙ্গে খেলেছেন একদিন, কিংবা বিপক্ষে খেলেছেন, তাঁদের অনেকেই আজ আর নেই। যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে প্রাণ। এই যুদ্ধের আবহে ফুটবলের লড়াই কি বেঁচে থাকা সম্ভব। কতজন ফুটবলার বেঁচেই বা আছেন বিশ্বকাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্যস বেঁচে থাকলেও কী অবস্থায় রয়েছেন, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন প্যালেস্টাইনে।

আরও পড়ুন:জয়ী না হওয়া অবধি যুদ্ধ চলবে! ৮,৩০০ মৃত্যুর পর কোন পথে এগোবে ইজরায়েল?

এমনিতেই এই যুদ্ধের আবহে গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও ইজরায়েলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে সমস্ত খেলার ইভেন্ট। ফিলিস্তিনি জাতীয় দলের ফুটবলাররাও চেষ্টা করেছিলেন অন্য দেশে পালানোর। কিন্তু যাবেন কী করে। সমস্ত রাস্তা যে বন্ধ। জর্ডনের ল্যান্ড ক্রসিং বন্ধ। ১৩ থকে ১৭ অক্টোবর মালয়েশিয়ায় টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়ার কথা ছিল প্যালেস্টাইনের। সেই টুর্নামেন্ট প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাতিল হয়েছে আরও অনেক ম্যাচ। এই পরিস্থিতিতে কীভাবে দল বাছাই হবে, এবং আদৌ তা দেশের মাটিতে হবে কিনা, সেই সদুত্তর নেই কারওর কাছেই। আসলে এখন এই সর্বগ্রাসী যুদ্ধটা থামুক কোনওমতে, সেটাই একমাত্র চাওয়া প্যালেস্টাইনবাসীর। নাহলে ফুটবল তো দূরের কথা, অনেক কিছুই বাঁচবে না আর দেশটায়।

 

More Articles