লাদাখ আর কিছু দিন, দায় কার?

Ladakh: অতিমারির আগে লাদাখে এত পর্যটকের আনাগোনা ছিল না। অতিমারি শেষ হওয়ার পর থেকে ভারতীয় পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

২০২৩ সালের মে মাসের সন্ধে। লে মার্কেটের কোণায় এক তিব্বতি রেস্তোরাঁয় ফ্রায়েড থেনথুক অর্ডার করেছি। এখানে বেশিরভাগ স্থানীয় রেস্তোরাঁয় চেয়ারে বসার ব্যবস্থা থাকে না। মাটিতে পাতা গদির উপরে বাবু হয়ে বসাই রীতি। সামনে থাকে একটা টি টেবিল। টেবিলের চারপাশে তিব্বতি ধাঁচে কলকা আঁকা। এমনই এক টি টেবিলকে মাঝে রেখে খাবারের অপেক্ষা করছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল মোহন, ব্র্যাডফোর্ড, ডেনিস, স্তেনজিং, আর সোনাম। সকলের সঙ্গেই আলাপ লে শহরে। মোহন, ব্র্যাডফোর্ড আর ডেনিস আমার মতোই পর্যটক। ব্যাকপ্যাকিংয়ের নেশায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। ফরাসি নাগরিক মোহনের জন্ম প্যারিসে হলেও মা, বাবা প্রবাসী ভারতীয়। বছর পঁচিশ বয়স হবে। ব্র্যাডফোর্ডের বাড়ি মার্কিন মুলুকের মিশিগান শহরে। বিগত বছর দশেক প্রত্যেক গ্রীষ্মেই লাদাখে ঘাঁটি গাড়ে সে। ডেনিস জার্মান নাগরিক হলেও ওঁর মা বাবা ছিলেন তুরস্কের উদ্বাস্তু। এদিকে স্তেনজিং আর সোনাম স্থানীয়। বন্ধুর দোকানে সন্ধেয় আড্ডা মারতে হাজির হয়েছে। স্তেনজিং লাদাখি হলেও সোনাম তিব্বতি উদ্বাস্তু।

স্তেনজিং জানায় লে শহরের উত্তরে শান্তি স্তূপের পাশেই একটা মাউন্টেন বাইকিং ট্র্যাক তৈরি হয়েছে। আমি সাইকেলে গোটা লাদাখ ঘোরার পরিকল্পনা করেছি শুনে আমাকে অবশ্যই এই মাউন্টেন বাইকিং ট্র্যাক দেখে আসার পরামর্শ দিল। আজকাল নাকি পর্যটকদের মধ্যে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস নিয়ে দারুণ উন্মাদনা। বিশেষ করে ভারতীয় পর্যটকরা রক্তে শিহরণ জাগানো অভিজ্ঞতা করতেই নাকি লাদাখে আসে। ততদিনে আমি লাদাখে পৌঁছেছি প্রায় সপ্তাহ তিনেক হবে। লে শহরের আশেপাশে সাইকেলে ঘুরে দেখলেও কোনও গিরিপথ টপকানোর সুযোগ হয়নি তখনও। খারদুংলা, চাংলার মতো গিরিপথগুলো মে মাসের শেষ সপ্তাহেও বরফে ঢাকা থাকে। তবে তিন সপ্তাহে আমি লে শহরে পর্যটকের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে দেখেছি। তাদের মধ্যে চার জন তখন সেই টেবিলেই বসে। আমিও এঁদেরই একজন। ব্র্যাডফোর্ড জানাল করোনা অতিমারির আগে লাদাখে এত পর্যটকের আনাগোনা ছিল না। অতিমারি শেষ হওয়ার পর থেকে ভারতীয় পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

আরও পড়ুন- অল ইজ নট ওয়েল ইন লাদাখ! ১৮০০০ ফুট উচ্চতায়, -৪০ ডিগ্রিতে কেন অনশনে বসছেন ওয়াংচুক?

ব্র্যাডের কথায় ঘাড় নেড়ে সমর্থন জানিয়ে সোনামও জানিয়েছিল প্রত্যেক বছর প্রায় পাঁচ লক্ষ পর্যটক লাদাখে আসেন। পর্যটকদের এই ভিড় সামলাতে লে শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো হোটেল ও গেস্ট হাউজ তৈরি হচ্ছে। যার প্রভাব সরাসরি পড়ছে পরিবেশের উপরে। সেমো মৈত্রেয় গুম্ফা থেকে উত্তর দিকে তাকালে এখন আর সবুজ দেখা যায় না। বছর তিনেক আগেও এই অবস্থা ছিল না। শুধু নির্মাণের সমস্যা নয়, রয়েছে জলের সমস্যাও। জুন, জুলাই ও অগাস্টে লাখ খানেক পর্যটকের জন্য জলের ব্যবস্থা করতে হয় হোটেলগুলোকে। সোনাম বলেছিল, ভুলে গেলে চলবে না যে লাদাখ আসলে একটা মরুভূমি। এখানে বৃষ্টি প্রায় হয় না বললেই চলে। সেখানে অত্যধিক জলের ব্যবহার অদূর ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সেদিন সোনমের গলায় যে আশঙ্কার কথা শুনেছিলাম তা এত তাড়াতাড়ি বাস্তবে পরিণত হবে তা ভাবতে পারিনি। জুলাইয়ে হড়পা বান এল শহরে। যেখানে সন্ধে হলেই ঝাঁপ বন্ধ হতো সেই সব রেস্তোরাঁ তখন রাত দশটার সময়ও পর্যটকদের ভিড়ে গমগম করছে। হঠাৎ লে মার্কেটের সব দোকানে জল ঢুকতে শুরু করল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক কোমর জল ভরে গেল সর্বত্র। পর্যটকদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। স্থানীয় দোকানিরাও বুঝে উঠতে পারছেন না ব্যাপারটা। ঘণ্টাখানেক পরে জল নেমে গেলেও জলের সঙ্গে আসা মাটি ও কাদা থেকে গেল দোকানগুলোর ভিতরেই। পরদিন সকালে বন্ধুর তিব্বতি রেস্তোরাঁয় কাদা পরিষ্কার করতে দেখেছিলাম সোনামকে। বন্ধুর বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে এসেছিল। আমাকে দেখে এক গাল হেসে জানাল, ‘আই টোল্ড ইউ দ্যাট ইভিনিং, নেচার ইস প্ল্যানিং রিভেঞ্জ।’

কাট টু নুব্রা ভ্যালি। জুনের প্রথম সপ্তাহেও এখানে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে। ডিসকিট, হুন্ডার ছাড়িয়ে আমি এগিয়ে চলেছি ভারতের শেষ গ্রাম থাংয়ের দিকে। কিছুটা এগিয়েই ছোট্ট গ্রাম স্কুরু। শিয়ক নদীর পাশে এই গ্রামে শ' খানেক লোকের বসবাস। স্থানীয় এক লামার আমন্ত্রণে সেখানে কয়েক দিন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। গ্রামের প্রায় সব বাড়ি প্রধান রাস্তার পাশে। রাস্তাটা নদী থেকে প্রায় শ' দুয়েক মিটার উপরে। স্কুরু গ্রামের উত্তর পশ্চিমে উপত্যকা ক্রমশ সরু হতে থাকে। সেই দিক থেকেই সকালে হাওয়া শুরু হয়। দিন যত বাড়তে থাকে ততই বাড়ে হাওয়ার গতি। দুপুরে তা ঝড়ের আকার নেয়। একবার এই ঝড় শুরু হলে আর ঘরের বাইরে যাওয়া সম্ভব হয় না। ধুলো আর বালিতে ঢেকে যায় গোটা এলাকা। আঁধার নামে চারপাশে। যতক্ষণ না ঝড় থামছে ততক্ষণ ধরে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে থাকতে হয়। একদিন দুপুরে আমাকে নদীর পাড়ে নিয়ে গেলেন লামাজি। বললেন, আগে গ্রামের সকলেই নদীর পাড়ে বসবাস করত। কিন্তু বছর পনেরো আগে সবাই রাস্তার পাশে বাড়ি বানাতে শুরু করল। তখন এত ঝড় হতো না। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে ঝড়ের বেগ অনেকটা বেড়েছে। রাস্তার পাশে গাছপালা নেই। ফাঁকা উপত্যকার মধ্যে দিয়ে হাওয়ার বেগ আরও বেড়ে যায়। তাই অনেকেই আবার নদীর পাশে এসে বাড়ি বানানোর কথা ভাবছেন গ্রামের অনেকেই। এখানে কয়েকটা উইলো আর পপলার গাছ রয়েছে। তাই হাওয়ার বেগ কিছুটা কমে যায়। নদীর পাশে বসে লামাজির কথা শুনতে শুনতে দূরে উপত্যকার উপরে দানবের মতো বিশাল আকারের ধুলোর কুণ্ডলী দেখতে পেয়েছিলাম। লামাজি জানান, আবার ঝড় আসছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে হবে। দু'জনেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করি সেদিন। সেদিন প্রথম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০,০০০ মিটার উচ্চতায় মরু ঝড়ের তাণ্ডব দেখেছিলাম।

আরও পড়ুন- মাইনাস ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে টানা অনশন! যে দাবিতে লাদাখে সরব বাস্তবের ‘ব়্যাঞ্চো’

এর পরে সপ্তাহখানেক প্রতিদিনই এই ঝড় দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। একদিন দুপুরে ফাঁকা রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছি। রোদ ঝলমল আবহাওয়া। হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে শুরু হল তুমুল ঝড়। এদিকে রাস্তায় আমি একা। হাওয়া সাইকেল সহ আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে মনে হচ্ছে। সেদিন সময় মতো একটা পিক আপ ট্রাক ভগবানের মতো আমার সামনে হাজির না হলে এই লেখার সুযোগ পেতাম কিনা জানি না। এখনও সেই অভিজ্ঞতার কথা মনে করলে হাড় হিম হয়ে যায়।

লাদাখে কয়েক মাস স্থানীয়দের সঙ্গে কাটিয়ে বুঝেছিলাম, প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকার কারণে এখানে প্রকৃতির প্রতি দরদ অনেক বেশি। কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে কংক্রিটের জঙ্গলে বসে সেই দরদ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। পর্যটনের নামে প্রকৃতির ভারসাম্য বিসর্জন দিতে রাজি নন লাদাখের আমজনতা। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব যে সব এলাকায় সবথেকে বেশি তাদের মধ্যে অন্যতম ভারতের এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। দেশের সবথেকে দুর্গম এই অঞ্চলে ইতিমধ্যেই হুঙ্কার দিতে শুরু করেছে প্রকৃতি। এই হুঙ্কার অগ্রাহ্য করলে পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে। আর সেটা সবথেকে ভালো জানেন স্থানীয়রাই।

More Articles