বাংলা সিনেমায় 'দলিত' স্বর! যে অভাব পূরণ করল অর্ণ-অনির্বাণ-সোহিনীর অথৈ
Athhoi Movie Review: এই ছবির দৃশ্যভাষায় পরতে পরতে যে যৌনলালসার ইঙ্গিত, যে কেড়ে খাওয়ার 'খিদে' বর্তমান, তা বাঙালি দর্শকের কতটা হজম হবে সে নিয়েও সন্দেহ থেকেই যায়।
'তবে হয়তো মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে। অন্ধকার আছি, অন্ধকার থাকবো, বা অন্ধকার হবো। আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।'
-জরাসন্ধ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়
মুর 'ওথেলো' এবং তার সঙ্গী সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলির ঠিকুজি-কুলুজি খুঁজে বের করলে, সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকের বিশ্বকে সহজেই আঁকতে পারা যায়। সেই প্রচেষ্টায় অবতীর্ণ হলে আমরা দেখতে পাব যে, শেক্সপিয়রের প্রাথমিক আধুনিকতার কল্প-অবয়বটি একটি বিশেষ সময়ের নৃতাত্ত্বিক অবধারণাগুলিকে, বিভিন্ন ধর্মতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের টানাপড়েনকে সঙ্গে নিয়ে এই সময়েও খুবই জীবন্ত। অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সোহিনী সরকার, অর্পণ ঘোষাল অভিনীত 'অথৈ'-ও এই সময়ের প্রায় ওই 'দর্পণ'সুলভ এক নির্মিতি, যেখানে ইয়াগোর বহিরঙ্গে দামী জিন্স, অসম মাপের সানগ্লাস চেপেছে বটে কিন্তু এখনও সে পালন করে চলেছে সকল মানব-বাসনার পচনের মূলে থাকা আদি, অকৃত্রিম 'ইগো'র চরিত্র। ওথেলো যদি শেক্সপিয়রের ভেবেচিন্তে লেখা বর্ণবাদ-বিষয়ক নাটক নাও হয়ে থাকে, ইতিহাস কিন্তু তাকে তেমনই এক নাটকে রূপান্তরিত করেছে। যে কারণেই হয়তো, কাল্পনিক ভিনশুরা গ্রামে উপস্থাপিত অথৈ কুমার লোধার জীবনের বয়ান, জাতপাতের চিহ্নবিহীন বলে দাবি করে আসা পশ্চিমবঙ্গের ভদ্রবিত্ত জনতার চোখে খানিক দোলাচল ডেকে আনবে।
এই ছবির প্রচার চলাকালীন, জনৈক ইউটিউবার অনির্বাণ-অর্ণদের এ প্রশ্নও করেছিলেন, কেন বাংলার পরিপ্রেক্ষিতে তারা ছবির উপজীব্য হিসাবে 'কাস্ট'-কে তুলে আনছেন। অথচ সুদূর অতীতেও নয়, এ বঙ্গের সাম্প্রতিক অতীতেই রয়েছে চুনী কোটালের প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা, আমলাশোলে অনাহারে আদিবাসী মৃত্যুর মতো ঘটনা। কাঞ্চা ইলিয়া শেফার্ডের মতো সমাজতাত্ত্বিকরাও একদা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, বাঙালি ভদ্রলোকের রাজনৈতিক মানচিত্রে 'দলিত' চেতনার অভাব বিষয়ে। অশোক মিত্রের দীর্ঘদিনের অনুশোচনা ছিল, যে রাজ্য 'ধর্মনিরপেক্ষতা' এবং 'বিভেদপন্থা' বিরোধের ধ্বজাধারী, সেখানে কখনও বাবু জগজীবন রাম, বুটা সিংয়ের মতো রাজনৈতিক চরিত্রের জন্ম হলো না। দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে নমঃশূদ্র নেতৃত্বের এ বাংলার রাজনীতি থেকে বিলোপ এবং তিন দশকের বেশি সময়ের বামপন্থী শাসনের পরেও এ রাজ্য কোনও 'দলিত' মুখ্যমন্ত্রীর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না, আক্ষেপ করেছিলেন সমাজতাত্ত্বিক আশিস নন্দী।
আরও পড়ুন- অ্যানিমাল: এমন জান্তব সিনেমা কি শুধুই বিনোদন? কাদের জন্য?
বাংলার ভাগ্যাকাশে তেমন কোনও রাজনৈতিক বোধোদয় না ঘটলেও, সংস্কৃতির মানচিত্রে 'অথৈ' সম্ভবত সেই অভাব পূরণ করল। যে রাজ্যের উঁচুতলার মানুষ এখনও 'কোটার ডাক্তার' বলে সংরক্ষণপ্রাপ্তদের চেম্বারে যেতে বাধ সাধেন, সেখানে এই ছবি নিজেই একটি বিরল ঘটনা। মনে রাখতে হবে, লোধারা এখন কেন্দ্রীয় সরকারের তফশিলভুক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি হিসাবে গণ্য হলেও, স্বাধীনতালাভের আগে তাঁরা ঔপনিবেশিক আইনের আওতায় 'ক্রিমিনাল ট্রাইব' হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৫২ সালে সেই আইন প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের অপরাধপ্রবণ উপজাতি বলা হতো এবং রাষ্ট্রীয়-সামাজিক উভয়রকমের অত্যাচার-বঞ্চনার শিকার তারা হয়েছেন। অবশ্য, অনাথ অথৈ কুমার লোধার অনগ্র চ্যাটার্জির (গোগো) 'ভালো' মানুষ ব্রাহ্মণ পিতার কাছে আশ্রয়গ্রহণের আখ্যানে যদি সুপ্ত 'ব্রাহ্মণ্যবাদ' কেউ খুঁজে পান এবং সমালোচনা করেন, তাও গ্রহণীয় হওয়া উচিত। আর্টিকেল-১৫ ছবিতে আয়ুষ্মান খুরানার চরিত্রের 'ব্রাহ্মণ' পরিচিতির জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন ছবির পরিচালক, আম্বেদকরের 'জাতি নির্মূলন' প্রবন্ধের ভূমিকা লিখে দলিত তাত্ত্বিকদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছেন অরুন্ধতী রায়। তাঁদের মতে, অরুন্ধতীরা তাঁদের মতো পেটে খিদের আগুন নিয়ে জন্মাননি। তবুও, যে সংবেদনশীলতা থেকে এই ছবি নির্মিত, তাতে এমন সমালোচনা এলেও নির্মাতারা মাথা পেতে নেবেন এবং বঙ্গসংস্কৃতির জনপরিসরে বর্ণব্যবস্থা, জাতিবিদ্বেষ, সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা এগুলিও আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবে।
সৌমিক হালদারের অনবদ্য ক্যামেরার কাজে, দর্শককুল যখন নদীতীরে শীর্ণ, ভুখা অথৈকে দেখতে থাকি, দেখি তাঁর ঠাকুমাকে ডাইনি অভিযোগে জ্যান্ত পোড়ানো চলছে, তখন কি মনে হয় না ইচ্ছাকৃতভাবেই গাঁয়ের পুরুতের হাত, বিস্তীর্ণ আকাশ, কাঠে ঝোলানো পুড়তে থাকা একটি দেহের মিলিত মিজ-অন-সিন আসলে মনে করিয়ে দিচ্ছে যিশুর শেষযাত্রাকে। সমাজের সামগ্রিক দৈন্যতা, ক্ষমতার উচ্চমন্য দাপটের ফলে যে প্রাচীন ক্রুশবিদ্ধতার 'পাপ' ঘটেছিল, তাই যেন ফিরে এসেছে আবার। ন্যাশনাল ক্রাইম রের্কড ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সালেও সারা ভারতে ঘটেছিল ডাইনি অভিযোগে মহিলাদের খুন করার প্রায় ১৫৬টি ঘটনা। পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশে এবং তথাকথিত আধুনিকতার প্রলেপ তৈরির ক্ষেত্রে ডাইনি শিকার হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির মধ্যে একটি। ভদ্রলোকেদের (এমনকী কৌমসমাজের ভিতরের উচ্চবর্গীয়দের) এবং রাষ্ট্রের এই লাগাতার নিপীড়নের দ্বারা, ঔপনিবেশিকতা ও আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের আক্রমণের বিরুদ্ধে ইওরোপে এবং ইওরোপের উপনিবেশগুলিতে কৃষকদের প্রতিরোধকে দুর্বল করা হয়, এমন এক সময়ে যখন ভূমি হারান মহিলারা, তাদের সম্পত্তি কুক্ষিগত হয় এবং প্রতিটি সামাজিক দিকের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সম্প্রসারণের সম্মিলিত প্রভাবে শিল্পবিপ্লবের আগেই কৃষক-ঐক্য ভেঙে যায়। তছনছ হয়ে যায় গ্রামের সামাজিক জীবন। 'জাদুকরি' তত্ত্বের প্রভাবে, নারী ও পুরুষের মধ্যে বিভাজন আরও গভীর হয়, পুরুষদেরকে নারীর ক্ষমতাকে ভয় করতে শেখানো শুরু হয়, শুরু হয় কৃষিসভ্যতার ভিত্তি নারীকে দলন করে কলকারখানা নির্ভর পুঁজিবাদের রথযাত্রা। তাই একদা, নারীবাদীদের স্লোগান ছিল 'আমরা ওই পুড়ে যাওয়া ডাইনিদেরই বন্ধু, বোন'। শেক্সপিয়রের আখ্যানেও পাগানসভ্যতার শেষ অবশেষ, এই ভবিষ্যতদ্রষ্টা 'ডাইনি'রা ফিরে এসেছেন বারবার।
দিয়ামনা (ডেসডিমোনা), মিলি, পিঙ্কিরা এই ছবিতে অনিবার্য পুরুষতন্ত্রের অঙ্গুলিহেলনে চলা পুতুলের মতো ক্রিয়াশীল থাকেন। আসলে, পুরুষতন্ত্র যে বহুস্তরীয়, একমুখী নয় তা বোঝা যায়, যখন অথৈর মতো চিরকাল বর্ণব্যবস্থার কটাক্ষ, নির্মম বাক্যবাণে আঘাত পেয়ে আসা মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে 'গোগো'রূপী পৌরুষের বেতাল, সেও তখন হয়ে উঠতে চায় লোকাল 'ক্যাসিও' মুকুলের হন্তারক, যে নাকি তাঁর ডেসডিমোনার সঙ্গে অবৈধ প্রণয়ে আবদ্ধ হয়েছে। বারংবার, গোগো আহ্বান জানায়, অথৈর জান্তব সত্তাকে দেহ ছেড়ে বেরিয়ে আসার। যেন এই আখ্যান, পৌরুষের মদমত্তায় আবদ্ধ 'অ্যানিম্যাল'-কে সকলের সামনে উন্মোচিত করতে চায়। যাতে, ক্রমশ পুরুষ শেখে এই পাশবিকতা নয়,সন্দিগ্ধতা নয়, সহানুভূতি ও প্রেমই তাকে জীবিত রাখবে। অনুরাগ কাশ্যপ তাঁর ব্ল্যাক ফ্রাইডে ছবিটি শুরু করেছিলেন মহাত্মা গান্ধির উদ্ধৃতি দিয়ে। অথচ, সারা সিনেমায় ছিল, মুম্বই শহরের তলপেট, মস্তানদের দাপাদাপি, বন্দুক, প্রতিহিংসা। এই হিংসার ক্রমাগত দৃশ্যায়ন একসময় হিংসাকে ঘৃণা করতে শেখায়। মহৎ শিল্পে, হিংসা এই কার্যকারিতা নিয়েই থেকেছে এতকাল। অথৈও সেই নেতির নেতিকরণের ব্যতিক্রম নয়। যদিও, এই ছবির দৃশ্যভাষায় পরতে পরতে যে যৌনলালসার ইঙ্গিত, যে কেড়ে খাওয়ার 'খিদে' বর্তমান, তা বাঙালি দর্শকের কতটা হজম হবে সে নিয়েও সন্দেহ থেকেই যায়।
বারবারা লেওয়ালস্কি তাঁর মিল্টন জীবনীতে 'প্যারাডাইস লস্ট' প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এই কাব্যের নায়ক-নায়িকা আদপে একটি গৃহস্থ জুটি, তাঁদের দাম্পত্যদৃশ্যের অবস্থান একটি চারণভূমিতে এবং তাঁদের প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ হলো, সামাজিক রীতিনীতির, বাধাবিপত্তির, দীর্ঘ আনুগত্যের অধীনে থাকা চেষ্টা থেকে নিজেদের মুক্ত করা, তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্ক এবং তাঁদের চারণক্ষেত্রকে মনুষ্যপৃথিবীর মঙ্গলকামনার 'নিউক্লিয়াসে' পরিণত করা। সমাজ পরিবর্তনের, বদলের কেন্দ্রে নিজেদের গার্হস্থ্যকে স্থাপন করা। এই প্রচেষ্টা আমরা অথৈ, দিয়ামনার চরিত্রায়নেও দেখি। মহাকবি মিল্টনের রচনাকালের অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় পরে, শেক্সপিয়র লিখেছিলেন ওথেলোতে ঐতিহ্যবাহী ট্র্যাজিক নায়কের জীবন। অথৈ-র শেষ দৃশ্যে, অর্থাৎ ওথেলো যেখানে ডেসডিমোনাকে হত্যায় উদ্যত সেই দৃশ্যটি কিন্তু গৃহছাড়া, তার স্থান হয়েছে বিস্তৃত চরাচরের মাঝে। বিবাহের মধুমাস যখন ফিকে হয়ে গিয়েছে, যখন উদগ্র বাসনা বিছানাকে করে ফেলেছে কণ্টকশয্যা, তখনই আমরা শুনি, রাফায় বোমাবর্ষণের শব্দ, প্যালেস্তাইনের শিশুমৃত্যুর লাইভ কমেন্টারি, তৃতীয় বিশ্বের ভুখা শিশু, আর মার্কিনদেশের শিশুর অতিস্থূলতার প্রতি-তুলনামূলক সংবাদ পরিবেশন, আন্তর্জাতিকতা তখন স্থানীয় সংবাদ হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন-পাল্টে যাওয়া জীবনজগৎ বাস্তবতায় কেন মৃণালকে খুঁজেছেন অঞ্জন?
নির্বিকার আমরা টের পাই, যে বিষাদ গার্হস্থ্যে, সেই বিষাদ চরাচরজুড়ে মানুষের হাহাকারে রূপান্তরিত হয়েছে। দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত মৈমনসিংহ গীতিকায় (১৯৫৮) কঙ্ক ও লীলার যে আখ্যান রয়েছে, তাতে আমরা খানিক উল্টো চিত্রও দেখি। সেখানে চণ্ডালের ঘরে পালিত হচ্ছে ব্রাহ্মণসন্তান, 'মুরারিরে বাপ বলি শিশু মনে জানে॥ কৌশল্যারে ডাকে কঙ্ক জননী বলিয়া জনকজননী পুন পাইল ফিরিয়া॥ ব্রাহ্মণকুমার হৈল চণ্ডালের পুত।' এবং বড় হলে তাঁর শিক্ষার পথ রোধ করছেন বামুনেরা 'এই কঙ্ক ব্রাহ্মণ-তনয়। জ্ঞান মানে নাহি রয়, চণ্ডালের অন্ন খায়, ধরে নিতে নাহিক সংশয়॥ এতেক শুনিয়া নন্দু আর যত গোড়াহিন্দু কয় সবে মাথা নাড়াইয়া। “আমরা সম্মত নহি, আরও শুন সবে কহি লহ কঙ্কে মোদেরে ছাড়িয়া॥' উপনিবেশের আগমনের পরবর্তী এই 'রোলরিভার্সালের' কাহিনিও অথৈ-র মূল আখ্যানের ভিতরে অন্তর্ঘাত চালায়। উচ্চবর্ণীয় আশ্রয়দাতার পুত্রের কপট ঘৃণা এবং উচ্চবর্ণীয় প্রেমিকার আশ্রয় দুই-ই অথৈর জীবনের পাথেয়। আবার সমস্যাও বটে। তাই, কঙ্ক-লীলার প্রেমালাপ এখন ইতিহাস, আর্কিটাইপ, অথৈ-দিয়ামনা সম্পর্কের চোরাস্রোতে সন্দিগ্ধতার ধিকিধিকি আগুন আজকের বর্তমান, করুণাঘন 'ইভেন্ট'। তাই, রবীন্দ্রনাথের এক বর্ণবাদী অবিনির্মাণ ঘটে, যখন সে অথৈর কাছে প্রেম জাহির করে 'তা সে যতই কালো হোক' উদ্ধৃত করে। এতদিন অবধি, যে 'কালো হরিণ' তকমা জুড়ে ছিল সাঁওতাল রমণীর গায়ে, তা ধেয়ে এল দলিত পুরুষদেহের ধারাবিবরণীতে। তাল রূপকড়া, রাগ বেহাগে বাঁধা পূজা পর্যায়ের রবীন্দ্রগান 'জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে' যখন ভেসে আসে, জন্মক্রূর গোগোর গলায়, অথবা শেষদৃশ্যের আগে দিয়ামনার বিলাপে আবার পুনরাবৃত্ত হয় এই গান, তখন রবীন্দ্রনাথ কতটা পৌত্তলিকতা-বিরোধী ব্রহ্ম-উপাসক থাকেন, বোঝা যায় না। বরং, তিনি হয়ে উঠেন এক সমর্পিত প্রাণ বৈষ্ণব, যুগলভজনাই যার শৈল্পিক অভিব্যক্তি। যার মূল 'ট্রোপ' অথবা 'টোটেম' হলো অভিসার, অনাগত কৃষ্ণকায় সেই পুরুষের জন্য অনন্ত অপেক্ষা।
'গোগো' আসলে আমাদের প্রত্যেকের মনোজগতের 'অপর'জন, তাই সে আমাদের অপ্রাপ্তি, আমাদের অন্তঃসারশূন্যতা, আমাদের কলহমুখর সংসার, আমাদের রোবোটিক অফিস-রুটিন এইসবের গ্লানি ও দুঃখ উগরে দেওয়ার পাত্র খোঁজে। কখনও সেই হিংস্র অভিব্যক্তির শিকার হন কোনও মুসলমান মানুষ, তাঁকে পিটিয়েই তখন ধর্মের আরাম। কখনও সেটা ক্রিকেট ম্যাচের পাকিস্তান, আমাদের দেশপ্রেমের শেষ-ঠিকানা। কখনও সেটা কোনও বিশেষ ব্যক্তিবর্গ, যারা সামগ্রিক সমাজের চোখে নিজের মতামতের কারণে অপাংক্তেয়। আগে লোকমুখে, ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে চোরকে পেটানোর গল্প ঘুরত অনেক, ধূসর স্মৃতি ঘাটলে এখনও খোঁজ পাওয়া যায়, ইতিহাস বইয়ের পাতায় আমাদের পূর্বজদের আদিম শিকারের দৃশ্য। এহেন মনোবৃত্তি, আজ স্থান পেয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ডে, কমেন্টের লাগাতার বন্যায়, মানুষের প্রতিটি ক্রুদ্ধ আঙুলে আজ রাগী ইমোজির দাগ। ওই যে প্রবাদে রয়েছে, 'স্বভাব যায় না মলে'- যায় তো নাই, বরং অভাবের সূত্রপাত হয়। যৌথজীবনের যূথবদ্ধ প্রতিরোধের অভাব, একে অপরের হাত ধরে পাশে দাঁড়ানোর অভাব, কারও কান্নায় নিজের কাঁধকে দেবদূতের ডানার মতো মেলে ধরার অভাব। আমাদের প্রাণের ঠাকুর, বঙ্গসমাজে ঠাকুরঘরের কুলুঙ্গিতে সবথেকে উপরে যার স্থান, সেই রবি ঠাকুরের 'মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ' বয়ানকে অথৈ' প্রশ্ন করে। রবীন্দ্রনাথ দাঙ্গা দেখেছেন, দেশভাগ দেখেননি, দেখেননি আণবিক অস্ত্রের ঢক্কানিনাদ। দেখলে কি বলতেন এই একই কথা, নাকি পরবর্তী প্রজন্মের, যাঁদের সঙ্গে তাঁর তেমন 'বনল' না, সেই 'কল্লোল' প্রজন্ম অথবা মানিক-জীবননান্দের মতো খুঁজতেন ভুখা মানুষের মুখ, ত্রস্ত মানুষের শহুরে দিনরাত্রি। রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও ফেসবুক করতেও আসেননি। ভাগ্যিস।