ফেসবুক অ্যাকাউন্টই বলে দেয় কেমন মানুষ ছিলেন অভিষেক

পরিবার নিয়ে ঘুরতে ভালোবাসতেন। মেয়ের সঙ্গে খেলছেন, ক্রিসমাস কাটাচ্ছেন হৈ হৈ করে। দেখে চেনার উপায় নেই তিনি এককালীন স্টার অভিষেক চট্টোপাধ্যায়

পিছনে পাহাড়। একটা ডাকবাংলোর সামনে এক চিলতে বারান্দা। টি-টেবিল, চেয়ার এলোমেলো। স্ত্রীকে কোমরে জড়িয়ে হালকা ভর দিয়ে রয়েছেন অভিষেক। গায়ে সাদা গেঞ্জির ওপর কালো জ্যাকেট, জিন্স। হাতে ব্যাগ। তখন দুজনেরই অল্প বয়স। রঙিন দিন। পাহাড়ি ব্যালকনির সেই দাম্পত্য মনে করছিলেন অভিষেক। খুব বেশিদিন না। এই তো, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি। স্ত্রীকে ভ্যালেনটাইনস্‌ ডের শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন। তাতে ষোল হাজার রিয়্যাকশন। সোশ্যাল মিডিয়ার জমানায় নিজের পেজে অভিষেকের অনুগামীর সংখ্যাটা নেহাত কম না। প্রায় ৫ লক্ষ ৭৫ হাজার। এই ছবিতে নস্টালজিক হয়ে পড়া যাবতীয় ভক্তদের কেউই তখনও জানেন না, মাত্র মাস দেড়েকের মাথায় এ ছবি কেবল স্মারক হয়ে থেকে যাবে। সমস্ত ছবিই স্মারক, তবে ছবির মানুষটি বেঁচে থাকতে তা জীবন্ত স্মৃতিও। কিন্তু সেই স্মৃতির যোগসূত্র ছিন্ন হলে, ছবির মানুষটি ‘নেই’ হয়ে গেলে স্মারক একাকীত্বে ভোগে। গত বুধবার রাতে মারা গিয়েছেন অভিষেক চট্টোপাধ্যায়। ফেসবুক পেজটি তাঁর অমলিন রয়ে গিয়েছে।

ভার্চুয়াল জগত আবিষ্কারের ঠিক বেঠিকের হিসেব না হয় অন্য দিনের জন্য তোলা থাক। তবে সেখানে জীবন বাস্তব জীবনের চেয়ে দীর্ঘতর, অন্তত কয়েকটি দিনের জন্য হলেও, এ কথা সবাই স্বীকার করবেন। আমাদের বাস্তবটা ঠিক যতটা পোড়া মাজা, বঞ্চনায় একঘেয়ে, সেখান থেকে ক্ষণিক হলেও রঙিন একটা প্রতিশ্রুতি দিতে ভার্চুয়াল জগত সক্ষম। স্বপ্নপূরণের ব্যাপার স্যাপার। তাই ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামে ছবি, ভিডিওর মাধ্যমে পোস্ট করা নানা বাস্তব জীবনের মুহূর্ত বাস্তব বিচ্ছিন্ন ভাবে এক স্বতন্ত্র ভার্চুয়াল জীবন স্রোত তৈরি করে। তা থেকে মানুষটা সম্বন্ধে খানিকটা যেমন ধারণা করা যায়, আবার খানিকটা নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলাও যায়, উপস্থাপন করা যায়। ঠিক গান নয়, যেন গানের একটা রেশ। মিউজিক থেকে ফিল্টার, এফেক্ট–নানা সিনেমাটিক উপায়ে সাজানো এক যাপন। কেমন ছিলেন সেই ভার্চুয়ালের অভিষেক? আসুন, দেখে নিই এক ঝলক।

অভিষেকের শেষ আপলোড করা ছবিটি পিকনিকের। দিন পাঁচেক আগে ছবিটি পোস্ট করেন অভিনেতা। পরনে ট্রাউজার্স। প্যান্ডেলের মধ্যে টেবিল সাজানো। তারই একটির সামনে বসে ‘সুপ্রভাত’ জানাচ্ছেন সবাইকে। এছাড়া রয়েছে দোলের ছবি। মেয়ে পিচকারি হাতে প্রচুর রঙ মেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে–এমনটাই দেখা যাচ্ছে। কোনও পোস্টে মেয়ের চুল সযত্নে আঁচড়িয়ে দিচ্ছেন এক পিতা। আবার কোনও পোস্টে স্বামী স্ত্রী সাঁইবাবার মূর্তি ছুঁইয়ে প্রণাম করছেন। এ ধরনের ছোটবড় নানা পারিবারিক, ব্যক্তিগত হাসিকান্নার মুহূর্ত উঠে আসছে টাইমলাইনে। মেয়ের প্রতি স্নেহ উপচে পড়ছে সমস্ত পেজ জুড়েই। পারিবারিক প্রশান্তি ফুটছে। প্রায়শই শিবপূজা, সাঁই প্রণাম, সরস্বতীপূজা ইত্যাদি নানা ধর্মীয় পরিমণ্ডলে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। এবং আধ্যাত্মিক পথে হাঁটতে ভালোবাসতেন বোঝাই যায়। কখনও নিজে সিন্নিভোগ তৈরি করে দিচ্ছেন ঠাকুরের। আবার কোথাও স্ত্রী মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাহুবন্ধনে ছবি তুলছেন। পরিবারকে তাঁর জীবনে আশীর্বাদ বলে আখ্যা দিচ্ছেন।

কখনও পাহাড়ে, কখনও সমুদ্রে, কখনও সুন্দর রিসর্টে বেড়াতে যাওয়ার ছবি পেজে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থান। পরিবার নিয়ে ঘুরতে ভালোবাসতেন। মেয়ের সঙ্গে খেলছেন, ক্রিসমাস কাটাচ্ছেন হৈ হৈ করে। দেখে চেনার উপায় নেই তিনি এককালীন স্টার অভিষেক চট্টোপাধ্যায়। খুবই অনাড়ম্বর জীবন ছিল তাঁর। তবে একঘেয়ে নয়। সবার সঙ্গে ফূর্তি করে জীবন কাটাতে পছন্দ করতেন। আর ভালোবাসতেন অনুগামীদের কাছে অতীত তুলে ধরতে। কিছু মুহূর্ত, ফটো–সেই কম বয়সের। সেই ক্ষণিক স্টারডমের। সব মিলিয়ে সম্পূর্ণ পারিবারিক একজন মানুষ।

তবে সেটুকুই নয়। এর পাশাপাশি পেজে নিজের কাজের প্রোমোশনও করতেন তিনি। তবে কচ্চিৎ কদাচিৎ। মূলত তাঁকে দেখা যেত শ্যুটের বিভিন্ন মুহূর্তে।

স্ক্রিপ্ট দেখছেন। কখনও খড়-কুটোর সেট। কখনও মোহরের সেট। সিরিয়ালের বাকি লোকজনও রয়েছেন আশেপাশে। কখনও পোজ দিচ্ছেন, কখনও ক্যান্ডিড। কখনও ‘স্লিপারসেল’ বলে একটি ওয়েব সিরিজের প্রোমো ভিডিও করতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। তবে একদম ঘরোয়া সজ্জায়। কোনও বিশেষ ‘বিজ্ঞাপিত বিজ্ঞাপিত’ গন্ধ নেই। একজন সাধারণ মানুষ যেন তাঁর কাজ সম্বন্ধে আর পাঁচটা মানুষকে জানাচ্ছেন। শেষের কয়েকটি ভিডিও পোস্টে তাঁকে দেখা যাচ্ছে মোহরের ক্রিউয়ের সঙ্গে নাচ করতে, তুমুল আনন্দ করে পিকনিক করতে। 

কখনও মাইক হাতে নিয়ে গাইছেন সেই জনপ্রিয় গান–”দরজা খুইল্যা”। তাতে হাততালি পড়ছে মুহুর্মুহু। ‘গীত সঙ্গীত’ অভিষেকের কেরিয়ারের অন্যতম হিট ছবি। সেই ছবিরই আরেকটি গান অন্যদের অনুরোধে গাইতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে, “যখন রাত্রি নিঝুম’। বোঝা যাচ্ছে সহ-অভিনেতারাও তাঁর পরিবারেরই অংশ। তাই নিজের অতীত যাপন আবার। নিজের খ্যাতি অকালে হারানোর যে দগদগে ঘা অভিষেকের মনে ছিল, তা যে মৃত্যুর দিন কতক আগেও তাজা বোঝা যায় এই অতীতচারণের প্রবণতায়। সেই সোনালি দিন বারবার সংজ্ঞানে নির্জ্ঞানে যেন ফিরে ফিরে আসছে তাঁর সমস্ত পেজ জুড়ে। আর সমস্ত পেজটাই পারিবারিক পোস্টে ভরা। কোথাও ব্যক্তিজীবন আর কর্মজীবন একাকার হয়ে যায় তাঁর এই ভার্চুয়াল নির্মাণে। আমাদের চোখ নেই। আমরা দেখতে শিখিনি। কত মানুষ কত রকম ভাবে নিজের জীবনকে নির্মাণ করছেন ফেসবুকে। তার রঙিন, রঙচঙে দিকটাই আমাদের চোখ টানে বেশি। খুব বেশি হলে হয়তো বিনয়টুকু। “এত বড় একজন অভিনেতা কত সাধারণভাবে বাঁচছেন দেখ!” হয়তো বলে থাকি অন্যকে। কিন্তু যেমন নির্মাণই হোক, বিষাদ, একাকীত্বের জখম, রক্ত আটকানো যায় না। একটু ভালো করে খেয়াল করলে সমস্ত মানুষেরই একের পর এক পোস্টে এক একটা বিশেষ প্যাটার্ন দেখা। অবধারিত অমোঘ এক ছন্দ। সেই ছন্দের ভাঁজ টুকু দিয়ে একাকীত্ব চুঁইয়ে আসে। রোজ, হরদম। আমরাই পড়তে পারি না।

More Articles