বিশ্বকাপ খেলার মাশুল, আড়াই হাজার সিগারেট 'খেতে' বাধ্য হল শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ ক্রিকেট দল

Bangladesh vs Sri Lanka’s Cricket World Cup match in New Delhi: আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহলের কাছে প্রশ্ন রয়েই গেল, এমন একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কতটা ঠিক বিশ্বকাপের এমন একটা ম্যাচের আয়োজন!

দিলওয়ালার শহর দিল্লি! কিন্তু সেই দিলওয়ালা শহরে খেলতে এসে যে অদৃশ্য ৩৩টি সিগারেটের বিষধোঁয়া যে ফুসফুসে ভরতে হবে তা কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলেন বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারেরা? এমনিতেই ক্রিকেটারদের অনেক ধরনের বিধিনিষেধের মধ্যে থাকতে হয়। আর সেখানে ধূমপানের তো প্রশ্নই নেই। কিন্তু রাজধানীতে খেলতে আসার অন্যতম শর্তই হল সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়া বুকের হাপরে টেনে নেওয়া! হ্যাঁ, এমন ঘটনা বিশ্বাস করা কঠিন তো বটেই! কিন্তু দিনের পর দিন ধরে দিল্লি এমনই এক বিষাক্তকূপে পরিণত হয়েছে, যেখানে একটা ম্যাচ খেলতে আসা সিগারেট খাওয়ায় হাফ সেঞ্চুরি হাঁকানোর শামিল।

গত কয়েকবছর ধরেই অসুস্থ রাজধানী। বিষাক্ত বাতাসে ভরেছে তার ফুসফুস। বাতাসের গুণগত মানের সূচক নেমে গিয়েছে বিপদসীমার নিচে। শীত আসতে এখনও দেরি। এরই মধ্যে দিল্লির আকাশ বাতাস ভরে রেখেছে ঘন ধোঁয়াশার আস্তরণে। ভরদুপুরেই ঘনাচ্ছে সন্ধের অন্ধকার। দূষণ আটকাতে কোমর বেঁধেছে সরকার। বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে স্কুল। লকডাউনের সময়ের মতোই নাকি ক্লাস হবে অনলাইনে। কমিয়ে দেওয়া হয়েছে অফিসের হাজিরাও। আরও একগুচ্ছ বিধিনিষেধ আরোপ হয়েছে দিল্লিতে। করোনার স্মৃতি ফিরিয়ে মুখে ইতিমধ্যেই চেপেছে মাস্ক। কাশি, শ্বাসকষ্টের মতো অনেক কিছুই সঙ্গী এখন দিল্লিবাসীর।

আরও পড়ুন: লকডাউনের স্মৃতি উস্কে বন্ধ স্কুল-কলেজ-অফিস! কোন পথে বাগে আসবে রাজধানীর মাত্রাতিরিক্ত দূষণ?

গত কয়েকদিন দিল্লির সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে দূষণ, বাতাসের গুণগত মানের সূচকের মতো শব্দগুলি। খবরের পাতা থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, দিল্লির মানেই দূষণের খবর। এই সবের মধ্যেই বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার মধ্যে গ্রুপ পর্যায়ের বিশ্বকাপ ম্যাচ ছিল গত সোমবার, যার ভেন্যু হিসেবে ঠিক করা হয়েছিল দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়াম তথা অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামকে। কিন্তু সেই ম্যাচ আদৌ দিল্লিতে সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে বেশ দোলাচলে ছিলেন কর্তৃপক্ষ। দিল্লিতে দাঁড়িয়ে এখন কয়েক মিটার দূরের জিনিস দেখাই অসম্ভব। সেখানে শূন্য দৃশ্যমানতা নিয়ে বোলারের বল দেখতে পাবেন কী করে ব্যাটার!

রবিবার দুপুরের দিকে একটু রোদ উঠেছিল দিল্লিতে। আশার আলো দেখতে পান আয়োজকেরা। ঠিক হয় সোমবার ম্যাচ শুরুর আগে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শেষ মুহূর্তে বাতিলও হয়ে যেতে পারে ম্যাচটি। সেক্ষেত্রে অবশ্য দুটি দলই এক এক করে পয়েন্ট পেয়ে যেত। কিন্তু শেষপর্যন্ত ম্যাচ হল দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে। কাকতালীয় ভাবে সেই দিনই দিল্লি জুড়ে আংশিক লকডাউন ঘোষণা করল কেন্দ্র সরকার। গত বুধবার থেকেই পাঁচশো-ছশোর আশেপাশে ঘোরাফেরা করেছে বাতাসের গুণগত মানের সূচক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্কেলে যা অতি বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করা হয়। বর্ষা কাটতে না কাটতেই প্রতিবছর দিল্লির বুকের হাপরে ভরে উঠতে থাকে দূষিত বাতাস। দিল্লি সংলগ্ন পঞ্জাব এলাকায় প্রচুর পরিমাণে ফসলের নাড়া পোড়ানো থেকে শুরু হয় সেই দূষণের। তার সঙ্গে যানবাহনের ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া এসব মিশতে মিশতে বাতাসের একিউআই নেমে যায় বিপদসীমার নিচে। যার ফলে দিল্লির দখল নেয় বিষাক্ত ধোঁয়াশা। দৃশ্যমানতা কমে যায় শূন্য়ের নিচে। মানুষের নিঃশ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

Bangladesh played with Sri Lanka amid ‘very unhealthy’ pollution in New Delhi

পরালি অর্থাৎ ফসলের গোড়া উপড়ানোর আধুনিক যেসব পদ্ধতি রয়েছে, তাতে দূষণের ঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে তা বেশ খরচসাপেক্ষ। তাই কৃষকেরা সনাতন পদ্ধতিই ব্যবহার করে চলে এখনও। শরৎ শেষ হতে না হতেই ঢালাও পরালি জ্বালানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় পঞ্জাব এলাকায়। রাস্তা ঢাকে সাদা ধোঁয়ায়, যা ভয়াবহ বিষাক্ত বললেও কম বলা হয়। শুধুমাত্র এ কারণেই এ বছর বিশ্বকাপে পঞ্জাবের মোহালি স্টেডিয়ামে কোনও ম্যাচ আয়োজম করা হয়নি। অথচ ভারতের সেরা স্টেডিয়াম হিসেবে যথেষ্ট নামডাক আছে সেটির। আর এ যে নাড়া জ্বালানোর সমস্যা, তার ক থেকে চন্দ্রবিন্দু, সবটাই জানে ও বোঝে প্রশাসন। অতঃপর পরালি জ্বালাবেন না- এইটুকু বলেই থেমে যায় প্রশাসন। ওই সব চাষীদের জন্য কম খরচে ফসলের গোড়া নিকেশের বিকল্প পথ খুঁজে না দেওয়া পর্যন্ত এই অবস্থাটা বদলাবে বলে মনে হয় না। কমবে না পরিবেশ দূষণও।

সোমবার বিশ্বকাপের ৩৮তম ম্যাচ ছিল শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশের দ্বৈরথ। বহু অনিশ্চয়তা নিয়েই শেষপর্যন্ত দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়াম তথা অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামেই শুরু হল খেলা। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহলের কাছে প্রশ্ন রয়েই গেল, এমন একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কতটা ঠিক এমন একটা ম্যাচের আয়োজন? সোমবার খেলতে গিয়ে দূষণের যে প্রভাব ক্রিকেটারদের শরীরে পড়ল, তার জন্য যে ভোগান্তি হচ্ছে খেলোয়াড়দের, তা আদৌ কাম্য কিনা, উঠেছে সেই প্রশ্নও। বহু ক্রিকেটারই সেই অস্বস্তির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন প্রকাশ্যে।

Bangladesh played with Sri Lanka amid ‘very unhealthy’ pollution in New Delhi

সম্প্রতি দিল্লির কাছে গুরুগ্রামের মেদান্তা হাসাপাতালের এক কার্ডিওলজিস্ট অরবিন্দ কুমার জানান, এই মুহূর্তে দিল্লির বাতাসে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া মানে রোজ অন্তত ২৫-৩০টি করে সিগারেট সেবন করা। একই ক্ষতি দু'ক্ষেত্রেই। আর এ কথা তিনি বলেছেন রাজধানীয় ধোঁয়াশা ও একিউআইয়ের পরিসংখ্যান বিচার করে। আর সেই প্রভাব কি পড়ল না এ দেশে বিশ্বকাপ খেলতে আসা প্রতিবেশী রাজ্যের খেলোয়াড়দের উপরে।

আরও পড়ুন:দূষণে নাভিশ্বাস, রাজধানী দিল্লি পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হবে?

সাধারণত ম্য়াচের দিন তিনেক আগেই ভেন্যুতে এসে পৌঁছন ক্রিকেটারেরা। আর সেই হিসেবে সোমবার ম্যাচ পর্যন্ত প্রায় পাঁচদিন দিল্লিতে কাটিয়েছেন তাঁরা। ওই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দিল্লির বাতাসে বর্তমানে একদিন নিঃশ্বাস নেওয়া যদি ২৮টি সিগারেট খাওয়ার শামিল হয়, তাহলে প্রথম এগারোর ক্রিকেটারেরা সবাই মিলে প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি সিগারেট খেয়ে ফেললেন একটা ম্যাচ খেলতে এসে। কারণ ইডেনে ম্যাচ খেলে টিম বাংলাদেশ দিল্লিতে পৌঁছয় গত বুধবার নাগাদ। হ্যাঁ, শুনতে মজার হলেও, পরিস্থিতিটা কিন্তু ভয়ঙ্কর। মুম্বইয়ে ম্যাচ খেলে শ্রীলঙ্কা দিল্লি পৌঁছয় শুক্রবার। সেই হিসেবে পিছিয়ে নেই তাঁরাও। হাজারখানেক সিগারেটে বিষাক্ত বাতাস তারা বুক ভরে নিয়ে সিগারেট না ছুঁয়েই।

ফলে সব মিলিয়ে দুদলের ২২ জন ক্রিকেটার যেভাবে আড়াই হাজার সিগারেটের সমান বিষপান করলেন অনিচ্ছাকৃত ভাবে, তার দায় কে নেবে? উঠে গিয়েছে প্রশ্ন। সত্যিই আন্তর্জাতিক দলের ভারতের মাটিতে খেলতে এসে এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়াটা দেশের পক্ষে লজ্জার নয়। ভয়াবহ এই দূষণ ঠেকাতে কী পদক্ষেপ করবে কেন্দ্র সরকার? গ্রেডেট রেসপন্স অ্যাকশন প্ল্যান কি কাজ দেবে আদৌ। জনজীবন স্থগিত করে দিয়ে কি আদৌ ফিরবে দিল্লির দিলে প্রাণবায়ু, সে উত্তরটা বোধহয় নেই তাবড় পরিবেশবিদদের কাছেও।

More Articles