গরিবের উপর করের বোঝা! ভ্যাট বাড়ানোর পথই কেন বেছে নিল ইউনূস সরকার?
Bangladesh Vat-Tax: ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। এই বিপুল ঋণের পাশাপাশিই আইএমএফ-এর কাছ থেকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার আরও এক বিলিয়ন ডলার সাহায্য চেয়েছে।
বাংলাদেশ নতুন করে তৈরি হচ্ছে। অগাস্ট অভ্যুত্থানের পর টালমাটাল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নতুন করে দেশের প্রশাসন ও অর্থনীতিকে সাজানোর প্রয়াস করছে। তবে সেই প্রয়াসের অংশ হিসেবেই বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে নতুন করে সংকটও দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশে শতাধিক পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর বা (ভ্যাট) বাড়ানোর পাশাপাশি ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এই ঘটনায় বাংলাদেশ নতুন করে উত্তাল। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়ে কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি। তবে সেদেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজস্ব আদায় অত্যন্ত কমে গেছে বাংলাদেশে। রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে এবং আইএমএফ-এর কাছ থেকে অতিরিক্ত এক বিলিয়ন ডলার পাওয়ার জন্যই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর আদায়ের জন্য এই পথ বেছে নিয়েছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। এই বিপুল ঋণের পাশাপাশিই আইএমএফ-এর কাছ থেকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার আরও এক বিলিয়ন ডলার সাহায্য চেয়েছে। এবার এই বিপুল পরিমাণ টাকা ফেরত দেওয়া হবে কীভাবে? বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আইএমএফ-এর সঙ্গে আলোচনার সময় বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দরকষাকষি করতে পারেননি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে তাই ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়াতেই হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারকে।
আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী সরকারকে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ সরকার তা পারেনি। তাই এবার ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোকেই পথ বলে মনে করছেন সেদেশের কর্মকর্তারা। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা বলছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের উপর তেমন প্রভাব পড়বে না। জরুরি পণ্যের শুল্ক কমিয়ে শূন্য করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন- ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় প্রাক্তন বিএনপি নেতার মুক্তি! কোন বার্তা দিচ্ছে বাংলাদেশ?
কী কী পণ্যে বাড়ছে শুল্ক ও কর?
শতাধিক পণ্য ও পরিষেবায় শুল্ক বেড়েছে। মূলত আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রেই ভ্যাট, সম্পূরক ও আবগারি শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। ভ্যাট বাড়ানোর কারণে মোবাইল ফোনের ডেটা, ইন্টারনেট ব্যবহার, জামা কাপড়, রেস্তোরাঁর খাবার, ওষুধ, মিষ্টি, ফলের রস ও এলপি গ্যাস সহ অনেক খাতেই খরচ বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের সংবাদ সংস্থা প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রি জানাচ্ছে, সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে পণ্যের মূল্য বাড়বে। যার ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও কমবে।
তবে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে কিছু ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়ানোর পরেই আবার শুল্ক কমিয়েও দেয় সরকার। মোবাইলে সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে টেলিফোন পরিষেবায় (টক টাইম, ইন্টারনেট ব্যবহার ইত্যাদি) সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছিল। এই সম্পূরক শুল্ক হার আবার আগের মতোই করা হয়েছে। ইন্টারনেট সংস্থার উপরও আরোপিত ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে।
রেস্তোরাঁর খাবারের বিলের উপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল নতুন অধ্যাদেশে। এখন বাড়তি ভ্যাট হার প্রত্যাহার করা হয়েছে।
পোশাকের ক্ষেত্রেও ভ্যাট কমানো হয়েছে। নিজস্ব ব্র্যান্ডের পোশাক ছাড়া অন্যান্য পোশাক বিক্রির ক্ষেত্রে ভ্যাট হার করা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। ৯ জানুয়ারি এই ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল। বাড়তি সেই হার প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। তবে ব্র্যান্ডের পোশাকের ক্ষেত্রে ভ্যাট হয়েছে ১০ শতাংশ। ৯ জানুয়ারির আগে তা ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ।
মিষ্টির দোকানেরও ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ৯ জানুয়ারির আগে মিষ্টির দোকানে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট ছিল। ফলে মিষ্টির দোকানে ভ্যাট হার বাড়ল ২.৫ শতাংশ।
এছাড়া নন-এসি হোটেলের ভ্যাটের হার ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। মোটর গাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপের ভ্যাট ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাটের হার ৩ শতাংশ করা হয়েছিল। এখন বাড়তি ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশ ২০২৪: আওয়ামী যুগকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে তাকাবার সময়
জানা গেছে, আইএমএফ-এর শর্ত ছিল চলতি বছর ০.৫ শতাংশ হারে জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে, যা সরকার করতে পারেনি। গত বছর জুলাই-অগাস্ট জুড়ে আন্দোলন চলায় বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। এই সময়কালে রাজস্ব আদায়ও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি হিসেবে চলতি অর্থবর্ষের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এক শতাংশ কমেছে। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১ লাখ ১ হাজার ২৮১ কোটি টাকা আদায় করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অন্তত ৩১ হাজার কোটি টাকা কম! আইএমএফ-এর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যে ঋণচুক্তি করেছে তাতে ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে জিডিপি অনুপাতে কর সংগ্রহ ০.৭ শতাংশ পয়েন্ট বাড়াতে হবে।
সরকার আগের ঋণের পাশাপাশি অতিরিক্ত আরও এক বিলিয়ন ডলার চাইছে। যার ফলে আইএমএফ-ও চাপ বাড়াচ্ছে। তাই ভ্যাট বাড়িয়ে কোষাগার ভরতে চাইছে বাংলাদেশ। সেদেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার প্রত্যক্ষ কর বাড়ালে এবং কর ফাঁকি আটকাতে পারলেই সাধারণ মানুষের উপর চাপ পড়ত না। করযোগ্য হয়েও যারা করের আওতার বাইরে আছেন তাঁদের করের আওতায় নিয়ে এলেই সরকারের রাজস্বের পরিমাণ বাড়ত। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একাধিক বাড়ি বা গাড়ির ক্ষেত্রে করের পুনর্বিন্যাস করা যেতে পারত। সম্পদের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে করের পরিমাণ নির্ধারণ করা যেত। দুর্নীতিগ্রস্তদের যে সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে বা অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে সেগুলিও ব্যবহার করা যেত। তাতে বৈষম্য কমত, দুর্নীতি দমনও হতো। লুটপাটকারীদের শাস্তিও দেওয়া যেত এবং মুদ্রাস্ফীতিতে কোনও বাড়তি চাপ পড়ত না। কিন্তু সেই কাজে উদ্যোগী না হয়ে সরকার 'সহজ পথ' বেছে নিয়েছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।