কয়েক লক্ষ মানুষের টিফিন মানে আজও বাপুজী, ৫০ ছুঁইছুঁই বেকারির যাত্রাপথকে সেলাম
স্কুলের টিফিন বক্স খুলতেই ভিতরে বসে আছে এক টুকরো চৌকো কেক। দেখেই একগাল হাসি ছোট্ট শিশুটির মুখে। আশি বা নব্বইয়ের দশকে বেড়ে ওঠা ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সকাল সন্ধ্যের টিফিন মানেই ছিল চৌকাকার এই বাপুজী কেক। তবে কেকের থেকেও বোধহয় বেশি লোভনীয় ছিল ওর ভিতরে থাকা ছোট্ট মিষ্টি ফলটি,যাকে আমরা মোরব্বা বলি। ৫০ ছুঁই ছুঁই এই কেক আজও বাঙালির প্রিয়, নব্বইয়ে বেড়ে ওঠা বাঙালি যুবক যুবতীদের নস্টালজিয়া. এক অন্য ভালো লাগা।
তেরোর দশকে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে প্রথম কেক শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সেসময়ের কেক ছিল এখনের থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। তখন মূলত পাউরুটিকে কেক বলা হত। আজ যাকে আমরা কেক বলে চিনি তার যাত্রা শুরু ১৭ দশকের ইউরোপে।তখন ডিমের সাদা অংশ, চিনি ও সুগন্ধি দিয়ে তৈরি হতো কেক। পরে ১৮৪০ সালে বেকিং পাউডার আবিষ্কার হলে কেক প্রস্তুত সহজ হয়ে যায়। ব্রিটিশদের হাত ধরেই মুলত বাংলা তথা ভারতে কেকের আবির্ভাব। ইতিহাস বলছে, ১৮৩০ সাল নাগাদ ডেভিড উইলসন নামে এক সাহেব শহরে প্রথম কেক তৈরি করেছিলেন। তিনি ১৮৪০ সালে ধর্মতলায় অকল্যান্ড হোটেল খুলেছিলেন।কিছুদিন পরেই নিউমার্কেট এলাকায় নাহুমস তৈরি হয়।
আরও একজনের নাম না বললেই নয়।তিনি হলেন মনোতোষ বড়ুয়া। দেশ ভাগের অনেক আগেই চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছিলেন মনোতোষ বড়ুয়া। তিনি ‘বড়ুয়া বেকারি’ নামে একটি কেকের ব্যবসা শুরু করেন। এই কেকের স্বাদ লেগে গেল কলকাতার মুখে। ফ্রুট কেক, পাম কেক বললেই যে কেউ বলে দিত বড়ুয়া বেকারি। খুব অল্প সময় পরেই বন্ধ হয়ে যায় সেই বেকারি। কিন্তু কলকাতাবাসী ভোলেনি সেই কেকের স্বাদ। এই শূন্যস্থান পূরণ করেছে বাপুজী কেক।
বাপুজী কেকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৩ সালে জানা পরিবারের হাত ধরে। কয়েক বছর বেকারির কাজে হাত পাকানোর পর অলোকেশ জানা এই ব্যবসা শুরু করেন। বাপুজী কেক হিসাবে এই সংস্থাকে সবাই চিনলেও খাতায় কলমে এর রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল 'নিউ হওড়া বেকারি প্রাইভেট লিমিটেড' নামে। প্রথম উৎপাদন কেন্দ্র ছিল হাওড়ার পল্লবপুকুর এলাকায়। পরবর্তী সময়ে ব্যবসায় লাভের অঙ্ক বাড়তে থাকলে কলকাতার লেকটাউন এবং হুগলির শ্রীরামপুরেও কারখানা চালু হয়।
বাপুজী মূলত বিশেষ এক ধরনের ফ্রুট কেক।তবে আরও বিভিন্ন ফলের স্বাদের কেক তৈরি করে এই সংস্থা। শুরুর সময় এর বাজার মূল্য ছিল ৬০ পয়সা। মূল্যবৃদ্ধির বাজারে আজ সেই দাম এসে ঠেকেছে ৬ টাকায়। কম দামে এত সুস্বাদু এই কেক মন ভুলিয়েছিল সকল গ্রাহকদের। তাই আজও দোকানে গিয়ে মানুষ তেলতেলে কাগজে মোড়া বাপুজী কেকের খোঁজ করতে ভোলেন না।
সংস্থার চাহিদা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেলে ভিন্ন স্বাদের কেকের পাশাপশি বিস্কুট, পাউরুটিও প্রস্তুত করতে শুরু করেন তাঁরা। তবে বাপুজী কেকের জনপ্রিয়তার সাথে পাল্লা দিতে পারেনি কোম্পানির অন্য কোনো পণ্যই। অবাক করার মত হলেও সত্যি, কোনও প্রচার বা বিজ্ঞাপন ছাড়াই পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছিল বাপুজী কেকের নাম। একটি ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করা প্রয়োজন এই পরিপ্রেক্ষিতে।
২০১৬ সালে নোটবন্দির সময়ে কিছু দিনের জন্য বাজারে বিক্রি বন্ধ ছিল এই কেকের। আর তাতেই খবরের শিরোনামে চলে আসে বাপুজী কেক। শহরের প্রতিটি বড় সংবাদপত্রেই ছাপা হয় এই খবর। ক্রমে দুর্যোগ কাটলে শুরু হয় নতুন লড়াই। কেক প্রস্তুতির ক্ষেত্রেও নিজস্বতা বজায় রেখেছে এই সংস্থা। কেক তৈরি করতে মেশিনের ব্যবহার হলেও বেশিরভাগ জিনিসই নিজে হাতে করেন প্রস্তুতকারকরা। অলোকেশবাবুর মৃত্যুর পর এখন কোম্পানির দ্বায়িত্বে রয়েছেন তাঁর দুই ছেলে অমিতাভ জানা এবং অনিমেষ জানা। তাঁদের মতে, 'আজও প্রতিদিন ৫০ হাজার বাপুজী কেক বিক্রি হয়'। বড় শপিং মলের বদলে পাড়ার ছোট মুদির দোকান, বাস টারমিনাস, ছোট কিয়স্ক বা স্কুলের সামনে ভ্যানকে টার্গেট করেই আজও বাজারে টিকে রয়েছে এই কেক। কেক প্রস্তুতের জন্য ব্যবহার করা কাঁচামালের গুণগত মান বজায় রাখতে পৃথক ইন্সপেক্টর রয়েছে এই সংস্থার। লড়াইটা কর্পোরেটের সঙ্গে, কিন্তু ভুখা ভারতে আস্থা আছে বাপুজীর। ঠিক যেমনটা আম আদমি রাস্তাঘাটে খিদে পেলেই একটা বাপুজী কেকের সন্ধান করে। পারস্পরিক নির্ভরতার এ এক অনুপম কাব্য। বাপুজীর ব্র্যান্ড ইমেজ এতই ভালো যে নাম সামান্য অদল বদল করে চেহারা প্রায় হুবহু এক রেখে বহু ছোট সংস্থাই বাজার ধরার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বলাই বাহুল্য বাপুজীর সঙ্গে তারা যুদ্ধে পেরে ওঠেনি।
ব্ল্যাক ফরেস্ট, ব্লু বেরির যুগেও বহু বাঙালির টিফিন কেক বাপুজী। প্লাস্টিকে মোড়া প্যাকেটের বদলে কাগজে মোড়া এই কেক, ফলে পরিবেশবান্ধবও বটে। একবিংশ শতাব্দীতে মাল্টিন্যাশানাল ব্র্যান্ডগুলির দাদাগিরিতে প্রবল লড়াইয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই সংস্থা, তবে বাপুজীর স্রষ্টারা জানেন- সংখ্যাগরিষ্ঠ আজও বাপুজীকে ভরসা মানে।