সর্বজয়া নয়, বাংলা ছবির ইতিহাসে গর্ভধারণ ছাড়াই 'মা' হয়ে উঠেছিল এই চরিত্র
Titash Ekti Nadir Naam: ব্যতিক্রম বাসন্তী। বাসন্তীর মাতৃত্বের জন্য কোনও গর্ভধারণের প্রয়োজনই পড়েনি।
"আমি পুরুষ ধরুম!"
এই সংলাপে এসে থমকাতে হয়। কী বলছে মেয়েটা? হ্যাঁ, তার ভরা-যৌবন শরীর আছে, আদুর গায়ে এক পাল্লা কাপড়, সরুবেণী-করা একমাথা চুল আর ছলাকলার দরকার পড়লে সেই বিদ্যাকে সে ডাকতে পারে, এই লাইনের আগেই আমরা দেখেছি কীভাবে বাগানে ছেলেটিকে সে প্রায় বশ করল; কিন্তু বাসন্তী তো সেই চরিত্রের মেয়ে নয়। আসলে এই সংলাপে, এই উক্তিতেই আমরা অনুধাবন করি বাসন্তী প্রকৃতপক্ষে আর কোনও মেয়েই নয়, সে ঠিক এখন থেকে মা। পরিপূর্ণ মা।
অদ্বৈত মল্লবর্মন 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে যেভাবে বাসন্তীকে গড়েছেন, ঋত্বিক চলচ্চিত্রে আরও উঁচুতারে বেঁধে দিয়েছেন তাকে। কিশোর অন্য কাউকে বিয়ে করে পাগল হয়েছে, সুবল মারা গেছে বৌভাতের পরদিন জলে ডুবে। ছোটবেলায় তিতাসের জলে সব মেয়েরা মিলে ভালো বরের কামনায় চুয়ারি ভাসালেও বাসন্তী সকল বান্ধবীদের মধ্যে হয়ে পড়েছে একমাত্র বিধবা। মুংলি আর লবচন্দ্রের বউয়ের ওই শাখা-সিঁদুর-গয়না আর পান খেয়ে লাল হওয়া ঠোঁটের ভেজা উপস্থিতির মধ্যে বাসন্তী যেন ঊষর মরুভূমি এক! শুকনো। কিন্তু অনন্ত আর অনন্তের মা যখন তিতাসের ঘাটে এসে ভেড়ে এই বাসন্তীই এক আঁজলা শীতলবারিতে পরিণত হয় হঠাৎ। কেন? মাতৃত্বের টান ও আকাঙ্খায়। অনন্তের জন্য সে সবকিছু করতে পারে সেই প্রথম দিন থেকে। নিজের বাড়ির রান্নাঘর থেকে চাল, আনাজ এমনকী নিজের মায়ের পুরনো কাপড় চুরি করতে পারে, রাত জেগে পিঠে বানাতে পারে, গ্রামসভায় গলা ফাটাতে পারে এবং শেষাবধি বাবাকে হুমকি পর্যন্ত দিতে পারে যৌবন উড়িয়ে, পুরুষ ধরে বাপ-মায়ের মুখে চুনকালি মাখানোর। কারণ, সে 'মা'। একটি সন্তানও গর্ভে ধারণ না করেও বাসন্তী একজন মা। সন্তানের জন্য তার পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব।
আরও পড়ুন- সত্যজিৎ, ঋত্বিক নন; মধ্যবিত্ত সমাজকে থাপ্পড় কষিয়েছিলেন মৃণাল সেনই!
তার তুলনায় অনন্তের মা হয়তো দেবীস্বরূপ ভগবতী বা কিশোরের প্রেমে পাগল প্রেমিকা কিন্তু বাসন্তী প্রকৃতই মা। অনন্তকে পেলে তার আর কিচ্ছু, কাউকে লাগে না। ছবির শেষদিকে এমনকী নিজের মাকেও নৃশংসভাবে মারতে পিছপা হয় না বাসন্তী কেবল এই অনন্তের জন্য। তার সমস্ত ভালোবাসার, আদরের, আবেগের নিমিত্ত শুধুমাত্র অনন্ত যাকে সে গর্ভেও ধরেনি। আর ঋত্বিক সেই মুহূর্তগুলো অনবদ্য রচনাও করেন এই চলচ্চিত্রে- বিলের মধ্যে অশৌচের কাপড় পরা অনন্তকে ভাতসরা ভাসাতে নিয়ে যাচ্ছে বাসন্তী আবহে চলছে ধীরাজউদ্দিন ফকিরের ব্যথাতুর কণ্ঠ কিংবা এই অনন্তই যখন বাসন্তীকে পাত্তা দিচ্ছে না আর, উল্টে খাওয়া-দাওয়া সারছে লবচন্দ্রের বউয়ের কাছে সে সময় বাসন্তীর মুখে যে ঈর্ষার অভিব্যক্তি, সেগুলো সিনেমাশিল্পের চিরকালীন সম্পদ!
বাংলা সিনেমার ইতিহাসে বাসন্তীর মতো 'মা' নেই। 'মা' বিষয়টা ভারতীয় মনস্তত্ত্বে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাষ্ট্র ও সমাজ নারীর উপর মা হওয়ার, হতে পারার একটা বাড়তি চাপ সারাক্ষণই দিয়ে রাখে। তার নারীত্বের সম্পূর্ণ সফলতা কেবলমাত্র মা হতে পারার মধ্যে। সে না চাইলেও তাকে মা হতেই হবে। এই মানসিকতা ভারতীয় সিনেমাতেও অতএব ছাপ রেখেছে। কিন্তু বাসন্তী 'তিতাস একটি নদীর নাম'-এ মা-ই হতে চেয়েছে। আখের বনে, আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো আর তিতাসের জলে অপলক তাকিয়ে থাকা বাসন্তী যেন সিনেমার প্রথমদিকে খানিক অসম্পূর্ণ। সে অনিশ্চয়তার নাবিক। অনন্তের প্রবেশ পর্যন্ত সে এরকমই। বাসন্তীর মা যখন মুংলিকে আক্ষেপের সুরে বলে,
"তরা তো একলগেই বড় অইসিলি রে, মুংলি! তর কত সুহের ভরা সংসার। তর সোয়ামি কত সোহাগ করে তরে। আর ওই পোড়াকপালিডার অ্যামন দশা ওইল ক্যান, রে?"
মুংলি তখন খোলসা করে এবং ওই একটা সংলাপেই আমরা ধরতে পারি 'তিতাস একটি নদীর নাম' ছবিতে বাসন্তী চরিত্রের ওঠা-পড়াটা ঠিক কোন জায়গায়। মুংলি বলে, "মাসি! তুমি জানো না। অর বুহের ভিতরডা একটা ছাওয়ালের লিগা কেমুন জ্বইলা পুইড়া খাক হোয়া যাইতাসে!" ছবির এক্কেবারে শেষে যখন তিতাসের চর শুকনো মরুভূমি হয়ে গেছে, জল নেই কোথাও, গ্রামের লোক একে একে সব পালিয়ে গেছে জীবিকার খোঁজে, মহিলারা কেউ দেহপসারিনী হয়ে গেছে শহরে গিয়ে, কেউ আবার পথে পথে ভিক্ষাবৃত্তি করে সেই সময়েও রয়ে গেছে শুধু বাসন্তী। শত প্রলোভন সত্ত্বেও সে পালায়নি। হয়তো ভেবেছে একদিন অনন্ত ফিরে আসবে। ছবি সমাপ্তির আগের মুহূর্তে মাথা ঘুরে বাসন্তী লুটিয়ে পড়ছে যখন, সামনে দেখতে পাচ্ছে খালি গায়ের একটা বাচ্চা ছেলে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে ধান ক্ষেতের ভেতর থেকে দৌড়ে আসছে। কে ও? অনন্ত? কিন্তু সে তো থামল না। অন্য পথে চলে গেল। বাসন্তীর আকুতিভরা দু'টি চোখ আর জোড়হাত স্থির হয়ে রইল ফ্রিজ-শটে।
আরও পড়ুন- সর্বজয়া নয়, আসলে ইন্দির ঠাকরুনেরই সন্তান দুর্গা…
'পথের পাঁচালি'-র সর্বজয়া প্রাথমিকভাবে স্ত্রী। সে বাচ্চাদের দেখাশোনা করে ঠিকই কিন্তু তার যাত্রা আসলে স্বামীর জন্য এক স্ত্রীয়ের অপেক্ষা। 'মহাপৃথিবী'-র অপর্ণা সেনের চরিত্র টিপিক্যাল পরিবারে বউদির চরিত্র। এমনকী এই ঋত্বিক ঘটকেরই নীতা ('মেঘে ঢাকা তারা'), সে মায়ের মতো হলেও আসলে দিদি, পরিবারের নেত্রী। আবার বাংলা বাণিজ্যিক ছবিতে অঞ্জন চৌধুরীর ছোটবউ জাতীয় সিরিজে আমরা অন্যরকম মায়ের চরিত্র পেয়েছি যেখানে সংসারে অশান্তি লাগানোই যার ব্রত এবং সেটা গল্পেরও গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। ব্যতিক্রম বাসন্তী। বাসন্তীর মাতৃত্বের জন্য কোনও গর্ভধারণের প্রয়োজনই পড়েনি।
'মাদার্স ডে' প্রতি বছর আসে, যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেখা যায় কত শত মানুষ নিজের মায়ের সঙ্গে এই দিন উদযাপন করে, ছবি দেয়। সেই আবহেই 'তিতাস একটি নদীর নাম' বার বার দেখি। তবু ধারণা বদলায় না। বাংলা ছবির ইতিহাসে সত্যিই বাসন্তীর মতো 'মা' নেই! এই ছবিতে বাসন্তীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শ্রদ্ধেয়া রোজি আফসারি সামাদ।