অকথ্য গালাগালি, স্টিলের বুট দিয়ে লাথি! ইজরায়েলি জেলের বিভীষিকা তাড়া করছে ফিলিস্তিনি বন্দিদের

Palestinian Prisoners in Israel Jail : ১৯৬৭ সাল থেকে ইজরায়েলের দখলে এই এলাকা। ৭ অক্টোবর থেকে ইজরায়েল এই এলাকায় ৩,২৯০ জনকে গ্রেফতার করেছে।

ইজরায়েলি জেলে আট মাস ধরে বন্দি। কোন অভিযোগে? নেই অভিযোগ, নেই কোনও আইনি প্রক্রিয়াও। নির্বিচারে ধরে আনা এবং আটক করে রাখা হাজার হাজার ফিলিস্তিনির মধ্যে বছর ১৮-র মহম্মদ সালহাব তামিমিও একজন। হামাস ও ইজরায়েলের বন্দি বিনিময় চুক্তির অংশ হিসাবে অবশেষে পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন তামিমি। তবে ফেরার মুহূর্তেও কানে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ইজরায়েলি হুমকি। বাড়ি ফিরে যদি পরিবার বা বন্ধুরা সামান্য উদযাপনটুকুও করে, ফের হাজতে ঢোকানো হবে তাঁকে! মহম্মদ সালহাব তামিমি বাড়ি ফিরেছেন ঠিকই, কিন্তু অনিশ্চয়তা পিছু ছাড়েনি।

গত আট মাসে এমন অনেক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে গেছেন তামিমি, ৭ অক্টোবর আল-আকসা ফ্লাড অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকেই অত্যাচার-যন্ত্রণার মাত্রা বেড়েছে। ইজরায়েলি সামরিক চেকপয়েন্ট এবং তাদের বাড়ির পাশে বেআইনি বাড়িগুলো থেকে সতর্ক থেকে সন্তানের বাড়ি ফিরে আসার আনন্দকে তাই নীরবেই পার করে দিয়েছেন তামিমির বাবা, মা, কাকা। তবু, আনন্দ তো বাঁধ মানে না। মা ফাতিমা এবং বাবা মুর্শিদের মুখের হাসি থামাতে পারেনি কোনও ইজরায়েলি হুমকি। ছোট ছেলেকে ফিরে পেয়ে স্বস্তিতে তারা।

আরও পড়ুন- কেন নির্বিচারে ফিলিস্তিনি শিশুদের জেল? কত বন্দি রয়েছে ইজরায়েলের কারাগারে?

তামিমি ছিলেন ফিলিস্তিনি বন্দিদের চতুর্থ ব্যাচের সদস্য। গত মঙ্গলবার রাতে রামাল্লাহর কাছে ওফার জেল থেকে মুক্তি পায় সকলে। সোমবার, ২৭ নভেম্বর সকাল ৭ টায় রিমন জেলের একজন প্রহরী মহম্মদ তামিমিকে জানান ওফার জেলে স্থানান্তরিত করা হবে তাঁকে। কেন সরানো হচ্ছে সে সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি তাঁকে। জামাকাপড় সমস্ত খুলে ফেলে, জেলের ধূসর রঙের সোয়েটস্যুট পরে সমস্ত জিনিসপত্র সংগ্রহ করে রাখতে বলা হয়। তামিমি জানান, “আমি প্লাস্টিকের একটি খামে আমার জামাকাপড় রাখি। তারপর জেলের দরজার কাছে যাই। ওরা আমার হাত পিছমোড়া করে বেঁধে, আমার মাথা নিচু করে রেখেছিল। ইজরায়েলি এক অফিসার তখন আমাকে জোরে লাথি মারে। বুটের মধ্যে স্টিল ছিল। মনে হচ্ছিল আমার পা যেন পিষে দিয়েছে, প্রবল যন্ত্রণা।"

জেলের উঠোনে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় তামিমিকে। তখন তাঁর কাছ থেকে জামাকাপড় কেড়ে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেন ওই অফিসার। অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করতে করতে টেনে টেনে বের করে আনেন মহম্মদ তামিমিকে। বন্দিদের জন্য তৈরি 'বোস্তা' নামের একটি গাড়িতে তোলা হয় তাঁকে। গাড়ির কালো জানালা এবং ধাতব আসন আর শক্ত গরাদ। সেখানেই বন্দিদের শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।

বোস্তা করে এই অন্য জেলে যাওয়াতে ১২ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় লাগতে পারে। কিন্তু মাঝে কোনও বিশ্রাম নেই, থামা নেই, খাবার নেই, শৌচালয় ব্যবহারের অনুমতিও নেই। মধ্যরাত অবধি কিছু না খাইয়ে, জলটুকু খেতে না দিয়ে গাড়ির মধ্যে রেখে দেওয়া হয় তামিমিকে। তাঁর বাবা এবং কাকা ওফারের জেলের বাইরে দাঁড়িয়ে তখন অপেক্ষা করছেন সন্তানের। অবশেষে মঙ্গলবার বিকেলে মুক্তি! ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের দক্ষিণে হেব্রনে নিজের বাড়ি ফিরেছেন তামিমি।

তামিমি জানাচ্ছেন, ৭ অক্টোবরের পর জেলের পরিস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। হামাস গাজা থেকে দক্ষিণ ইজরায়েলে ভয়াবহ আক্রমণ শুরু করে। ওই হামলাতে প্রায় ১,৪০০ মানুষের প্রাণ যায়। এই ঘটনার বদলা নিতেই যুদ্ধ শুরু করে ইজরায়েল। ফিলিস্তিনি বন্দিদের উপরেও অত্যাচার চরম বেড়ে যায়। বেশ কয়েকটি জেলে বন্দিরাই জানাচ্ছেন, মারধরের পরিমাণ বেড়ে যায় অভাবনীয়ভাবে। চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয় না, আইনজীবী এবং পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় না। বিদ্যুৎ, জল এবং স্বাস্থ্যবিধির ন্যূনতম পরিষেবাও বন্ধ করে দেওয়া হয় ফিলিস্তিনি বন্দিদের জন্য।

আরও পড়ুন- জমিদখল থেকে লুঠতরাজ! ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে যে তাণ্ডব চালাচ্ছে ইজরায়েলি দখলদারেরা

৭ অক্টোবর থেকে ইজরায়েলি হেফাজতে কমপক্ষে ছয়জন ফিলিস্তিনি বন্দি মারা গেছেন। হামাসের হামলার পর গাজা উপত্যকায় ইজরায়েলের নিরলস বোমাবর্ষণ চলে টানা ৪৮ দিন। ৬,০০০ এরও বেশি শিশু সহ ১৫,০০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনি মারা যান।

যুদ্ধের ৪৯তম দিনে, মিশর এবং কাতারের মধ্যস্থতায় চারদিনের 'মানবিক যুদ্ধবিরতি' শুরু হয়। হামাস এবং ইজরায়েল জানায় তারা বন্দিদের মুক্তি দেবে। হামাস ৭ অক্টোবর ইজরায়েল থেকে অপহরণ করে বন্দি করে নিয়ে আসা মানুষদের মুক্তি দেবে। পাশাপাশি ইজরায়েলকেও তিনগুণ ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে। বন্দি বিনিময় অব্যাহত থাকায় চারদিনের যুদ্ধবিরতি দুই দিন আরও বাড়ানো হয়েছিল। ইজরায়েল প্রায় ১৫০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে। তবে এই বন্দি বিনিময় চলাকালীনই ইজরায়েল অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং পূর্ব জেরুজালেম থেকে আরও ১৩৩ জনকে গ্রেফতার করেছে। ১৯৬৭ সাল থেকে ইজরায়েলের দখলে এই এলাকা। ৭ অক্টোবর থেকে ইজরায়েল এই এলাকায় ৩,২৯০ জনকে গ্রেফতার করেছে।

মহম্মদ তামিমি বলছেন ইজরায়েলের জেলে ঠাসা ফিলিস্তিনি মানুষ। ১০ জন বন্দিকে একটি সেলে রাখা হয়েছে যেখানে মাত্র ছয়টি বিছানা। ঘুমোতে হলে মেঝেতে কম্বল বা কিছু বিছিয়ে দিতে হতো। যে পরিমাণ খাবার দেওয়া হতো তাও অপর্যাপ্ত। বহির্বিশ্বের যে কোনও খবর থেকে বিচ্ছিন্ন এই বন্দিরা কোনও দিনই আর নিজের আগের জীবন ফিরে পাবেন কিনা জানতেন না। চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনও পরিষেবা নেই, কাপড় ধোয়ারও অনুমতি নেই! মহম্মদ তামিমি নিজের সেলের ভিতর থেকে নামাজ পড়তে চাইতেন জোরে, যাতে বাকিরা শুনতে পায়, কিন্তু তাও নিষিদ্ধ ছিল। হামাস ইজরায়েলের এই যুদ্ধবন্দি বিনিময় চুক্তি তাই ফিলিস্তিনি বন্দিদের জীবনে আশার চরম এক রেখা।

More Articles