প্রশ্নের মুখে ভবিষ্যৎ! ভারতীয়-সহ ৭০ হাজার বিদেশি পড়ুয়াকে কেন নির্বাসন দিচ্ছে কানাডা?

Canada: সম্প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর তরফে ঘোষণা করা হয়েছে, কানাডা এবার সেদেশে অবস্থিত স্বল্প আয়ের অস্থায়ী বিদেশি কর্মীর সংখ্যা কাটছাঁট করতে চলেছে।

কিছু দিন আগেই খলিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর খুনের ঘটনায় ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কিনারায় পৌঁছেছিল কানাডার। দু'দেশের তরফেই ভিসা-নীতিতে একগুচ্ছ বদল আনা হয়। মাস দুয়েক আগেই হরদীপ খুনের বর্ষপূর্তিতে নীরবতা পালন হয়েছে কানাডার পার্লামেন্টে। জাস্টিন ট্রুডো সরকারের নেতৃত্বে এই শোকপালন যে নতুন করে ভারতের সঙ্গে সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, সেই সম্ভাবনা ছিল। তবে তেমন কিছু হয়নি। বরং কোনও রকম উচ্চবাচ্য ছাড়াই হঠাৎ করে সে দেশে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা কমানোর কথা ঘোষণা করছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।

অভিবাসন নীতিতে আমূল পরিবর্তন আনার কারণে প্রায় ৭০ হাজার বিদেশি পড়ুয়া সে দেশে বিপাকে পড়তে চলেছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর সেই সব পড়ুয়াদের মধ্যে রয়েছেন একটি বড় অংশের ভারতীয় পড়ুয়া। আজ থেকে নয়, দীর্ঘদিন ধরেই ভারত থেকে অসংখ্য পড়ুয়া প্রতিবছর কানাডা যান পড়াশোনা বা চাকরির প্রয়োজনে। সেই সব অভিবাসী ভারতীয়দের ওয়ার্ক পারমিট বা ভিসা চলতি বছরেই শেষ হয়ে যাবে। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে তাঁদের কানাডায় বসবাস। এই পরিস্থিতিতে ভিসা এবং ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছেন অজস্র অভিবাসী।

আরও পড়ুন: ফের ভারতে আসতে পারবেন কানাডার মানুষ, কাদের কাদের ভিসা দিচ্ছে নয়াদিল্লি?

সম্প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর তরফে ঘোষণা করা হয়েছে, কানাডা এবার সেদেশে অবস্থিত স্বল্প আয়ের অস্থায়ী বিদেশি কর্মীর সংখ্যা কাটছাঁট করতে চলেছে। এমনকী সেদেশে স্থায়ী বসবাসকারীর সংখ্যা নিয়েও তাঁর সরকার ভাবছে বলে জানানো হয়েছে। যার ফলে কানাডা জুড়ে প্রায় ৭০ হাজার বিদেশি ছাত্রের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। তাঁদের যে কোনও সময় নির্বাসিত করা হতে পারে কানাডা থেকে, এমন আশঙ্কাতেও ভুগছেন অনেকে। ইতিমধ্যেই অভিবাসন নীতির কড়াকড়ির বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন অসংখ্য মানুষ। নতুন প্রাদেশিক নীতি কানাডায় স্থায়ী ভাবে বসবাসকারী অভিবাসী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সংখ্যা ২৫ শতাংশ কমিয়েছে। যার জন্য ইতিমধ্যেই কানাডা থেকে ফিরে আসতে বাধ্য় হয়েছে বহু ভারতীয় পড়ুয়া। ট্রুডো সরকারের নতুন নীতি কার্যকর হতে চলেছে আগামী ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ থেকে। যা ছাত্র পারমিটের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে অন্তত ৩৫ শতাংশ। যার ফলে পড়াশোনা মাঝপথেই থামিয়ে দিতে বাধ্য় হবেন একটা বড় অংশের অভিবাসী পড়ুয়া। সেই খবর ছড়াতেই হইচই পড়ে গিয়েছে কানাডা জুড়ে। মঙ্গলবার প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্য়ান্ডে আইনসভার বাইরে প্রতিবাদ দেখায় এক দল পড়ুয়া। অন্টারিও, ম্যানিটোবা এবং ব্রিটিশ কলোম্বিয়াতেও চলছে বিক্ষোভ।

সামনেই কানাডায় নির্বাচন। এদিকে সংখ্যালঘু জাস্টিন ট্রুডোর সরকারের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমছে কানাডায়। সেই ভোটের ক্ষেত্রে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে ট্রুডো সরকারের অভিবাসন নীতি। সে দেশের পাকা বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের মানুষ মনে করেন, কানাডা অতিরিক্ত সংখ্যক অভিবাসীকে জায়গা দিচ্ছে দেশে। যার ফলে সেখানকার বাসিন্দারা বেকারত্বের মতো সমস্য়ায় ভুগছে। আর সেই ইস্যুতে বেশ চাপে পড়েছে ট্রুডো সরকার। এই পরিস্থিতিতে দোষ গিয়ে ট্রুডো সরকারেরই ঘাড়ে। প্রায় প্রতিবছর রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসী আসছে কানাডায়। যার ফলে দিন দিন সেখানে তীব্র হচ্ছে কানাডায় আবাসন সংকট। স্থানীয় মানুষ যথাযথ কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ। ফলে এমন এক সময়ে গদি বাঁচাতে বিদেশি পড়ুয়াদের প্রবেশে বিধিনিষেধের পথেই হাঁটছে ট্রুডো সরকার। অতিরিক্ত আন্তর্জাতিক পড়ুয়াদের চাপ থেকে বাঁচতে ব্যাপর রদবদল আনা হয়েছে অভিবাসন নীতিতে।

মাসকয়েক আগে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের প্রবেশের উপর দু'বছরের জন্য একটি ক্যাপ বা বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়েছিল সে দেশে। কানাডা প্রশাসন জানিয়ে দেয়, বেশ কিছু স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের কাজের অনুমতিপত্র বা ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া বন্ধ রাখা হবে। এর ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা অনুমোদনের হার প্রায় ৩৫ শতাংশ কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে ট্রুডোর দেশে রেকর্ড সংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। সরকারি হিসাবে অনুযায়ী, এক দশক আগে কানাডায় বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২ লক্ষ ১৪ হাজারের মতো। অন্য জায়গার তুলনায় কানাডায় কাজের অনুমতি পাওয়া তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই সহজ ছিল আন্তর্জাতিক পড়ুয়াদের কাছে। ফলে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে ঢল নামত ছাত্রছাত্রীদের। ২০২৪ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী,২০২২ সালে সক্রিয় ভিসা-সহ কানাডায় বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৮ লক্ষেরও বেশি। অথচ ২০১২ সালে সেই সংখ্যা ছিল মাত্র ২ লক্ষ ৭৫ হাজার জন। অর্থাৎ, এক দশকে ৫ লক্ষেরও বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী কানাডায় প্রবেশ করেছে উচ্চশিক্ষার জন্য।

যার ফলে সাম্প্রতিক কালে বেকারত্ব নিয়ে বেশ কিছু উদ্বেগ সে দেশে তৈরি হচ্ছে বলে বহু মিডিয়া রিপোর্টে জানা যাচ্ছে। এরপরই সোমবার কানাডার সরকার দেশের কর্মশক্তির ওপর জোর দেওয়ার বিষয়ে বড় পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছে। সরকার আরও ইঙ্গিত দিয়েছে যে ব্যবসাগুলি যাতে তরুণ, নবীন এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি-সহ গার্হস্থ্য শ্রমশক্তিকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করে তা নিশ্চিত করার জন্য অতিরিক্ত পদক্ষেপও চালু করা হবে। জাস্টিন ট্রুডো জানিয়েছেন,'কানাডা এমন একটি জায়গা যেখানে অভিবাসনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক মানসিকতা রাখা হয়'। তিনি একই সঙ্গে বলেছেন,'কানাডায় আসা প্রত্যেকের সাফল্যের পথ নিশ্চিত' করতে চাইছে কানাডা। কানাডার অভিবাসন, উদ্বাস্তু ও নাগরিকত্ব বিষয়ক মন্ত্রী মার্ক মিলার জানিয়েছেন, 'শুধুমাত্র জনমতের চাপে উপর উপর পরিবর্তন নয়, অভিবাসন নীতি নিয়ে বাস্তবেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে চায় কানাডা। মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে ট্রুডো বলেছেন, ‘আমরা স্বাস্থ্যসেবা, নির্মাণ এবং খাদ্য নিরাপত্তার মতো নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্র ছাড়া কানাডায় স্বল্প বেতনের,অস্থায়ী বিদেশী কর্মীর সংখ্যা কমানোর জন্য নিয়মগুলি কড়া করছি এবং যোগ্যতাও সীমাবদ্ধ করা হচ্ছে।’ গত কয়েক বছরে হু হু করে কানাডায় বেড়েছে অভিবাসীদের সংখ্যা। এই সংখ্যা নামানোর জন্য কানাডার ওপর বেশ চাপ বাড়ছিল। তিন বছরে কানাডার মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ কমানোর চেষ্টায় ছিল ট্রুডো সরকার। এপ্রিলে এই সংখ্যা ছিল ৬.৮ শতাংশ। ব্যাঙ্ক অফ কানাডার হিসাব বলছে, এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

আরও পড়ুন: কানাডার হিন্দু ভারতীয়দের হুমকি, কে এই গুরপতওয়ান্ত সিং পুন্নুন?

তবে কানাডার এই অভিবাসন নীতি নিয়ে নয়া সিদ্ধান্তের প্রভাব কি ফের পড়তে চলেছে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে? নাকি ভারতকে চাপে রাখতেই আরও বেশি করে অভিবাসনী নীতিতে কড়াকড়ি আনতে চাইছে কানাডা? নিজ্জর মামলার কথা যে ট্রুডো সরকার ভোলেনি, তা তো পার্লামেন্টে শোকসভা পালন করেই বুঝিয়ে দিয়েছে তারা। নীতির কড়াকড়িতে যে সব ভারতীয় অভিবাসী পড়ুয়া মাঝপথেই নির্বাসিত হবেন কানাডা, তাঁদের জন্য কী ব্যবস্থা করার কথা ভাবছে ভারত? আদৌ কি ভাবছে। আপাতত কানাডায় পঠনপাঠনকারী অজস্র ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের সামনে এ এক বিরাট প্রশ্ন।

 

More Articles