সকলে নন, কেউ কেউ ‘আদর্শ’ শিক্ষক

Ideal Teacher: এই শিক্ষক দিবসে আমরা এমন একজন শিক্ষককে খুঁজে পেয়েছি, যিনি তাঁর ছাত্রীদের কাছে ‘অনুপ্রেরণা’ হিসেবে উঠে এসেছেন। এই অসময়ে, এই অবেলায় আমরা ঠিক যেমন শিক্ষককে খোঁজার চেষ্টা করি, তিনি যেন ঠিক তাই।

আমরা অন্যরকম একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি। যার একদিকে ঘৃণা ও বিদ্বেষের চাষ হচ্ছে, হিংসা ও দুর্নীতির ঝুড়ি ঝুড়ি ঘটনা। অন্যদিকে, কোথাও কোথাও একটু আশার আলোও যেন দেখা যাচ্ছে। যখন দেখা যায়, আমাদেরই রাজ্যে এক চিকিৎসকের মৃত্যু ও ধর্ষণে অভিযুক্ত একজন চিকিৎসক এবং শিক্ষককে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা গ্রেফতার করছে, যখন শিক্ষক বলতে আমাদের চোখের সামনে উত্তরপ্রদেশের মুজাফফরনগরের এক স্কুলের ঘটনার কথা ভেসে ওঠে; তখন কোথাও যেন একটু হলেও আশার আলো দেখায় হাওড়ার তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনের প্রধান শিক্ষিকার কথা। এবারের শিক্ষক দিবস তাই সত্যিই অন্যরকম। এই শিক্ষক দিবসে আমরা এমন একজন শিক্ষককে খুঁজে পেয়েছি, যিনি তাঁর ছাত্রীদের কাছে ‘অনুপ্রেরণা’ হিসেবে উঠে এসেছেন। এই অসময়ে, এই অবেলায় আমরা ঠিক যেমন শিক্ষককে খোঁজার চেষ্টা করি, তিনি যেন ঠিক তাই। যেমনটা হওয়ার কথা ছিল আসলে সকলের, যতটা ঋজু হওয়া হয়ে ওঠেনি অনেকের, ঠিক যেমন হলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কুর্নিশ আদায় করে নেন শিক্ষক, তিনি যেন ঠিক তেমনই। যিনি জানেন, তাঁর ছাত্রদের কী করে সম্মান করতে হয়, কীভাবে তাঁদের থেকে পরিবর্তে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হয়। তুর্কির প্রথম রাষ্ট্রপতির মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক বলেছিলেন, ‘ভালো শিক্ষক অনেকটা মোমবাতির মতো, নিজে জ্বলে শেষ হয়ে গিয়েও, অন্য অনেককে আলো প্রদর্শন করেন’। হাওড়ার তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা যেন সেই আলোর দিশা।

আলোর নীচেই অবশ্য অন্ধকার থাকে। তাই এর বিপরীতে মনে পড়ে বছর খানেক আগের মুজফফরনগরের একটি ভাইরাল হওয়া ভিডিওর কথা। যেখানে দেখা গিয়েছিল, শিক্ষিকার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বছর সাত-আটেকের এক পড়ুয়া। ঘটনাচক্রে সে ধর্মে মুসলমান। শ্রেণিকক্ষে দাঁড়িয়ে সেই শিক্ষিকা অন্য হিন্দু ছাত্রদের নির্দেশ করছেন ওই মুসলমান ছাত্রটিকে চড় মারার। এবং এক এক করে তারা শিক্ষিকার সেই নির্দেশ মেনে চড় কষিয়ে দিচ্ছে সহপাঠীর গালে। শোনা যাচ্ছে সেই শিক্ষিকার চিৎকার। তিনি বলছেন— মুসলমানদের মারাই উচিত, আরও জোরে মারা উচিত। এই ভিডিও দেখে চমকে উঠেছিল গোটা দেশ। এক শ্রেণিকক্ষ ভর্তি শিশুর মনে যে ঘৃণার বিষ ঢোকানো হয়েছে সচেতন ভাবে, তা কি আদৌ কোনও শিক্ষকের আচরণ? কী শিখবে এই শিক্ষকের কাছে পড়ুয়ারা, আগামীর ভবিষ্যতেরা? প্রশ্ন ওঠেই। তারা কি এই ক্লাসরুম থেকে আদৌ কখনও শিক্ষককে সম্মান করতে শিখবে, না অন্য ধর্মের সহপাঠীকে ঘেন্না করার পাঠ রোপিত হবে অন্দরে? এই দিন দেখার জন্য কি এত ঘটা করে শিক্ষক দিবস পালন করে দেশ? এই শিক্ষকদের কি আদর্শ শিক্ষক বলা চলে? দেশের প্রধানমন্ত্রী কি এই শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইছেন পরের প্রজন্মকে? এই শিক্ষার কথাই কি বলেছিলেন দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি তথা শিক্ষাবিদ ডঃ সর্বোপল্লি রাধাকৃষ্ণাণ, যাঁকে মনে রেখে প্রতি বছর শিক্ষক দিবস পালন করা হয় সারা দেশে?

আরও পড়ুন: অস্পৃশ্যদের মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ সাবিত্রীবাই

যুগ যুগ ধরে এমন অনেক শিক্ষক পেয়েছে দেশ, যাঁরা শুধুমাত্র পড়ুয়াদের সাধারণ শিক্ষাটুকুই দান করেননি, দেশটাকেও শিক্ষিত করার চেষ্টা করে গিয়েছেন তাঁরা। আমাদের দেশ এমন বহু শিক্ষকদের পেয়েছে, যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। চাণক্য থেকে শুরু করে গৌতম বুদ্ধের কথাও বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয়। কী করেই বা আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা ভুলতে পারি, কী করেই বা তাঁর শিক্ষাদানের অভিনব প্রক্রিয়ার কথা ভোলা যায়? বিদ্যাসাগর বা আরও বহু মানুষের কথাও না বললেই নয়। কার্যত যে সময় সারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাই প্রায় উঠে যাওয়ার মুখে, যখন বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির মানে বহু মানুষের কাছেই এখন শুধুমাত্র 'হোয়াটসঅ্যাপ', তখন দেশের এইসব শিক্ষাবিদদের কথা মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি। এই প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া বা সাবিত্রীবাই ফুলেদের মতো নারী শিক্ষাবিদদের কখা অবশ্যই আলাদা করে উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা আছে। মুসলমান সমাজে যেমন বেগম রোকেয়ার অবদান অনস্বীকার্য, তেমনি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্যতম শিক্ষক হিসেবে সাবিত্রীবাই ফুলেকে মান্যতা দেওয়া হয়। আধুনিক সময়ের দিকে তাকালে যখন দেখা যায়, উত্তরপ্রদেশের এক শিক্ষিকা তাঁর ছাত্রদের বিদ্বেষের পাঠ দেন, তখন ফের মনে পড়ে সাবিত্রীবাই ফুলেদের। ব্রাহ্মণ্যবাদ বারংবার চেয়েছে, সমাজে তাঁদের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাক। আর তার জন্য সমাজের হাওয়ায় মিশে থাকুক বিদ্বেষ-বিষ। তাই মুখে আম্বেদকরকে শ্রদ্ধা জানালেও, তাঁর মতাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীতে কাজ করে চলে আজকের শাসকদল। শিক্ষক দিবসে দেশের প্রধানমন্ত্রী যতই মাথা নত করে দেশের শিক্ষকদের সম্মান প্রদর্শন করুন না কেন, আদপে তিনিও চান না সমাজে নারী বা দলিতেরা সমান শিক্ষায় শিক্ষিত হোন। কারণ তিনি ভালোই জানেন, প্রকৃত শিক্ষা প্রশ্ন করতে শেখায়। আর সেই প্রশ্নকে বড় ভয় শাসকের।

সাবিত্রীবাই সেই সময়ে ভয় পাননি বলেই, নিজের চেষ্টায় তিনি নিজেকে শিক্ষিত করে তুলতে পেরেছিলেন। বেগম রোকেয়া সেদিন মুসলমান সমাজের প্রশ্নের তোয়াক্কা করেননি বলেই, নিজে পড়াশুনা করেছিলেন এবং মুসলমান সমাজের মহিলাদের শিক্ষার কথা সামনে এনেছিলেন। পরের প্রজন্মকে অঙ্ক, বিজ্ঞান বা ভাষা শেখানোর থেকেও কি কোনও অংশে কম প্রয়োজনীয় এই সব মানুষগুলোর সম্পর্কে জানানো। তাঁরা কী বলতে চেয়েছিলেন, কোন শিক্ষা সেদিন দিয়ে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা আগামী প্রজন্মের কাছে, তা জানবে না আজকের ছেলেমেয়েরা? একবার ভাবুন তো, মুজফফরনগরের ওই স্কুলের সেদিনের ছাত্রেরা কোনওদিন যদি শিক্ষক হয়ে ওঠে, তাহলে কী পরিণতি হতে চলেছে সমাজের।

মুজফফরনগরের সেই শিক্ষকের কী হবে? আদৌ তিনি শাস্তি পাবেন কি না, এ দেশে সবই অনিশ্চিত। কিন্তু তিনি যে শিক্ষায় তাঁর ছাত্রদের শিক্ষিত করতে চাইছেন, তা আর যাই হোক ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা নয়। নাজি জার্মানির প্রিন্সিপালের চিঠির সঙ্গে আজকের উত্তরপ্রদেশের ওই শিক্ষকের আচরণের হয়তো অনেক মিল দেখা যাচ্ছে, আর সেটাই ভয়ের কারণ। এই শিক্ষার ফল কিন্তু আগামিদিনে মারাত্মক হতে পারে। হয়তো কৃষক নেতারা গিয়ে দুই ধর্মের ছেলেদের আলিঙ্গন করিয়ে বিষয়টা মিটিয়ে নিলেন সামনাসামনি, কিন্তু দুটি শিশু কি আর পাশাপাশি বসতে পারবে ঐ স্কুলে? পারবে কি একসঙ্গে টিফিন ভাগ করে খেতে? স্কুল তো শুধু পড়াশোনা করার জায়গা নয়, একসঙ্গে বড় হয়ে ওঠারও জায়গা। কিন্তু তা যদি আজকের শিক্ষকেরা নিজেরাই ভুলে যান, তাহলে কীসের শিক্ষক দিবস, কীসের জন্য পড়াশোনা? শাসক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যদি এই ঘটনার নিন্দা না করা হয়, যদি ওই শিক্ষককে শাস্তি না দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের চারপাশে যে শিক্ষকেরা জেনে অথবা না-জেনে এই বিদ্বেষবিষ ছাত্রদের মনে ঢোকাচ্ছেন, তাঁরাও সচেতন হবেন না। কিন্তু সরকারের কি সেই সদিচ্ছা আছে? আজকে হয়তো এই খবরটা সামনে এসেছে, কিন্তু কত যে এই ধরনের ঘটনা আছে, তা কি আমরা জানি? এ দেশে সংখ্যালঘু ছাত্ররা কি আদৌ সেই জায়গা পাচ্ছে স্কুলে, তাদের মানসিক গঠন ঠিকঠাক হচ্ছে তো? এসব খবর কি এই শিক্ষকেরা রাখেন? তাঁদের কাজ তো শুধু পড়ানো নয়, তাঁদের দায়িত্ব প্রতিটি ছাত্রকে মানুষ করে তোলা। সেই দায়িত্ব কি সত্যিই পালন করছেন তাঁরা!

আরও পড়ুন: জোর দিতেন গবেষণায়, বাংলা পড়ারও সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন বাংলার বাঘ

হিটলারের নাজি জার্মানির এক স্কুলের প্রিন্সিপালের লেখা একটি চিঠি পাওয়া যায়, সেখানে তিনি নাজি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফেরার কিসসা বর্ণনা করেছেন। সেই ক্যাম্পে তাঁকে যা যা দেখতে হয়েছিল, তা শিউরে ওঠার মতো। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ারেরাই ঐ গ্যাস চেম্বারগুলো বানিয়েছিলেন, যার মধ্যে লক্ষ লক্ষ ইহুদিদের ঢুকিয়ে মারা হয়েছিল। শিক্ষিত নার্সেরা কীভাবে বাচ্চাদের হত্যা করেছে, তা তিনি সচক্ষে দেখেছেন। কীভাবে শিক্ষিত মানুষজন তাঁদেরই সহনাগরিকদের গুলি করে হত্যা করে, তা-ও তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। আর এসব দেখাশোনার পর শিক্ষা শব্দটা নিয়েই তিনি সন্দিহান। তিনি বলেছেন, অঙ্ক, ইতিহাস, ভুগোল, বিজ্ঞান সব শেখা যাবে, কিন্তু তার আগে প্রয়োজন ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা পাওয়া, কার্যত ভালো মানুষ তৈরি করার শিক্ষা দেওয়াটা বেশি জরুরি।

কিন্তু সবটাই কি অন্ধকার, নিরাশায় ভরা? না বোধহয়। মুজফফরনগরের শিক্ষক বা আরজিকরের অধ্যক্ষের উল্টোদিকে আমরা নিশ্চিত ভাবেই এগিয়ে রাখব হাওড়ার তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে , আশা রাখব, আরও কিছু মানুষের মতো মানুষ তিনি তৈরি করবেন। যারা জীবনের চলার পথে কীভাবে মেরুদন্ডকে সোজা রাখতে হয়, তা শিখে আমাদেরও শেখাবে, জীবনের পাঠ দেবে। ঠিককে ঠিক, ভুলকে ভুল বলতে শিখে আমাদেরও শেখাবে যাঁরা, নিজেরাই হয়ে উঠবে এক একেক জন জ্বলন্ত আলোর শিখা।  
  

More Articles