মিছিলে হাঁটছে মেয়ে! প্রহরীর মতো রাত জাগে পিতার হৃদয় একা

RG Kar Rape Protest: আশার কথা, কলকাতা এখন বৃদ্ধদের অভিভাবকত্বে নেই। নতুনরা দখল নিতে চাইছে দিন-রাতের। ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করছে দুপুরে খেয়েছিস বাপ?

তখনও এই শহরে এসেছি কি? বড়ো হয়েছি যে-শহরে, সেখানে আবহাওয়া ছিল বেশ চরমভাবাপন্ন। রাজনৈতিক হালচালও ছিল তথৈবচ। কথায় কথায় লাশ পড়ত। ছোটো ছেলেরাও নিজেদের মধ্যে ঝটাপটি করতে করতে অক্লেশে বলতাম— লাশ ফেলে দেব। সেসময়েই নাগরিক কবিয়াল গান বাঁধলেন তাঁর ছোট্ট এক সহনাগরিকাকে নিয়ে। খেলতে খেলতে যার গলায় কলমের খাপ আটকে গিয়েছিল। ‘তার বাবা আর মা তাকে নিয়ে [কলকাতা] শহরের এ-হাসপাতাল ও-হাসপাতাল করতে করতে’ একরত্তি মেয়েটিকেই খুইয়ে বসলেন। ভগবানের গিটারে আলো ঝলসে উঠল। আমাদের লজ্জা, কষ্ট, যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে উঠল যখন ওই অপার্থিব ব্যারিটোন গেয়ে উঠল ‘কোঁত করে গেলো মেয়ে শ্বাসকষ্টের ঠেলা/এখানে জীবন মানেই মৃত্যুযন্ত্রণা গিলে ফেলা’। যন্ত্রণা গিলে ফেলার অনুষঙ্গে সে-গানে মেকি গণতন্ত্রও প্রশ্নের মুখে পড়েছিল। ষোলো-সতেরো বছর বয়সে এই গান শোনার পর থেকেই গণতন্ত্র নিয়ে আমার মনে হাজারও প্রশ্ন। এদিকে গণতন্ত্রের পাল্টা মডেল হিসেবে যা যা জানা আছে তা যে আরও ভয়াবহ। জেনেছিলাম লেনিন রাশিয়ায় বসন্তের হিল্লোল বইয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই রাশিয়ায় গুলাগের উপস্থিতির কথা আমাকে কেউ বলে দেয়নি পঁচিশ বছর বয়স হবার আগে। গণতন্ত্রেও ক্ষমতাবিন্যাস এমনই নিষ্ঠুর করে তোলে শাসককে, যে সংখ্যার জোরে সব কিছু বুঝিয়ে দেওয়া যায় এমন একটা ধারণা কায়েম হয় মনে।

সে যাই হোক, তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। ভগবান বৃদ্ধ হয়েছেন। যে-মন্দিরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, সে-পথ আমার অচেনা। কিন্তু আজ হঠাৎ তাঁকে মনে পড়ল। আমি ‘দেড়শো মাইল’ উজিয়ে যাইনি তাঁর কাছে। কিন্তু আমার নব্বইয়ের দশক হাত ধরে টান দিল, স্মৃতি উস্কে দিল সুর। অনেক অনেক দিন মিইয়ে থাকার পর বাঙালি ফের রুখে দাঁড়িয়েছে। আমার মেয়ে রাত দখলের মিছিলে গেল। জীবনে প্রথম মিছিলে হাঁটল। তার মধ্য-চল্লিশের মা-ও হেঁটে এল অর্ধেক রাত। আমি একা বসে রাত জাগি। অর্ক রাত জাগে। আমরা কথা বলি। কাঁদি। কিন্তু মেয়েকে বারণ তো করতে পারি না আমি। সেই কুড়ি-বাইশ বছর আগে পড়েছিলাম জয় গোস্বামী লিখছেন ‘যদি বাধা নাই দিই, তত্ত্ব করি, কী হল কার দোষে/ যদি না আটকাই, আজও না-ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি/আমার সমস্ত শিল্প আজ থেকে গণহত্যাকারী!’ ‘আনন্দবাজার’ সকালে ব্যানার হেডলাইন করল ‘আজ জেগেছে এই জনতা’। জনতা জেগেছে। কিন্তু কোথায় গেল বাঙালির বিদ্রোহী শিল্পের অহংকার ! যে-গানের লাইন ভেঙে হেডলাইন হচ্ছে, আজ সেই গান কোথায় ?

আরও পড়ুন: এই উদাসীন আন্দোলনের রঙ্গমঞ্চে ইলা মিত্রকে খুব প্রয়োজন আজ
 

সারাদিনের অনেকটা সময় অটোয় বসে কাটে আমার। যখন খুব ক্লান্ত লাগে তখন হোয়াটসঅ্যাপের ডিপি-তে প্রিয়জনদের মুখের ছবি দেখি। গত কয়েকদিন দেখছি আমার মেয়ের ডিপি কালো। তার বন্ধু থাকে কর্নাটকে, তার ডিপি কালো। আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক রঙ্গনদার ডিপি কালো। আমার ছাত্রীর ডিপি কালো। এত কালো মেখেছি ডান হাতের বুড়ো আঙুলে যে টালিগঞ্জে নেমে গণশৌচাগারে হাত ধুয়ে আসি ‘Out, damned spot’.

মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে কলকাতায় জিলো পন্টিকার্ভোর সিনেমা দেখছি বাইপাসে, কাদাপাড়ায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে মনে পড়ে যাচ্ছে। জীবনানন্দের বুনো হাঁসেদের মনে পড়ছে যারা শিকারির গুলি এড়িয়ে উড়ে গেছে দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতরে। ‘আর সে-নাছোড় ভগবান’ অলোকরঞ্জনের কবিতার মতো ফিরে আসে। আমি তাকে এড়াতে পারি না। ‘বিরোধীকে বলতে দাও’। বিরোধী বলবে কবে ? আমি তোমার মতের বিরোধিতা করছি মানেই তোমার শত্রু নই। কিন্তু সমাজমাধ্যমের সুবিধা নিয়ে যারা মেয়েটির মৃত মুখের ছবিও ছড়িয়ে দিল, এই অসামাজিকতাও আমি চাই না। যেমন চাই না চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মতো, মেয়েদের রাতের কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার মধ্যযুগীয় চিন্তা। মাঝরাতে কলকাতার আকাশে যে চাঁদ দেখেনি, সে কী জানে পৃথিবীর সৌন্দর্য। চিক-পর্দার আড়ালে ফিরে যাব না কি আমরা ? কাদম্বিনী, অবলা বসু, প্রীতিলতা, কল্পনা দত্তের বাংলায় ? শঙ্খ ঘোষের কবিতাটা কি মনে পড়বে না আমাদের—

‘মাঝে মাঝে শুধু খসে পড়ে মাথা
কিছু-বা পুরোনো কিছু-বা তরুণ
হাঁক দিয়ে বলে কন্‌ডাক্‌টর :
পিছনের দিকে এগিয়ে চলুন।’

কলকাতার এমন চেহারা দেখিনি কখনও। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কলের কলকাতা’য় পড়েছি শহরটার মধ্যে একটা পাগলামি আছে। এই ভালো তো, তারপরেই খেপে ওঠে। আজও কলকাতায় হাজার মানুষ রাস্তায়। রাজনীতির বৃহৎ ইশারা দেখতে আজ মন চাইছে না। ভাবতেও ইচ্ছে করছে না অন্য দেশের গণ-আন্দোলনের প্রভাব। প্রভাব কোন আন্দোলনে থাকে না! নকশালবাড়িতে ছিল না ? পারিতে? সঙ্কটটা হল সার্ত্র কলকাতায় প্যামফ্লেট বিলি করছেন না। শঙ্খবাবু বেঁচে নেই, সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শিল্পীর ঋজু কণ্ঠস্বরও নেই। সবাইকে ডাকার, রাস্তায় নামানোর কেউ নেই। অথচ সেই পঞ্চাশের দশকের মতোই আজও ‘দূর্বাতে তার রক্ত লেগে/ সহস্র সঙ্গী/ জাগে ধক্‌ ধক্‌, যজ্ঞে ঢালে/ সহস্র মণ ঘি’।

The RG Kar incident provoked the anxiety and pain of all the fathers of the country by Srikumar Mukhopadhyay Robibarer Royak

রাতে সবাই শুয়ে পড়লে আমি একা ঝিম মেরে বসে থাকি। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই চোখ চলে যায় আমার সদ্য কলেজপড়ুয়া মেয়েটির দিকে। সে আজও আলাদা ঘরে শুতে শেখেনি। মায়ের পাশে তার নিশ্চিন্ত ঘুম। ‘প্রহরীর মতো’ তার গালের পাশে ভালোবাসা রাত জাগবে কি? 

আমি এখনও কোনো মিছিলে যাইনি। কোথায় যেন বাধো-বাধো ঠেকছে। আমার অক্ষর দিয়ে সাজানো দুনিয়া থেকে অনেক দূরে মিছিলের চলাচল। আমি জানি অলীক চিন্তা করছি। কিন্তু মূর্খের জগতে বাস করছি না। কারা যেন বলছে অরাজনৈতিক মিছিল। অরাজনৈতিক? ফুঃ! শাসকের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার চাওয়াও যদি রাজনীতি না হয় তবে কাকে বলে রাজনীতি? পতাকা যারা বানায়, তারা দল দেখে না। বড়োবাজারের দোকানে ডাঁই হয়ে পড়ে থাকে ডান-বাম-রামের পতাকা। আগে স্থির হোক কাকে বলে রাজনীতি। বুঝতে পারছি মাঝবয়সের ক্রাইসিস আমাকে পেছন থেকে টানছে। কিন্তু আমি নিজের মুদ্রাদোষে একা হয়ে পড়ে আছি। কিন্তু নিজেকে বোঝাতে পারিনি এখনও। বয়সের জড়তাও একটা ব্যাপার। 

আশার কথা কলকাতা এখন বৃদ্ধদের অভিভাবকত্বে নেই। নতুনরা দখল নিতে চাইছে দিন-রাতের। ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করছে দুপুরে খেয়েছিস বাপ? মেয়েদের হাওয়ায় ওড়া চুলে বিলি কেটে দিয়ে রাতে ঘুম পাড়াতে ইচ্ছে করছে। 

The RG Kar incident provoked the anxiety and pain of all the fathers of the country by Srikumar Mukhopadhyay Robibarer Royak

আমার সবচেয়ে কমবয়সি বন্ধু পৃথ্বী ছুটছে কলকাতার রাস্তায়-রাস্তায়। ঠাট্টা করে তাকে হাড্ডি খিজির বলে ডাকছি! ঠাট্টা? হাড্ডি খিজির কি সত্যিই ভর করেনি তাকে? সে বড়ো অভিমানী। আমি জানি। ভালোবাসার কাঙাল। তার হাতে ধুলোমাটি সোনা হয়। ২২ বছর বয়সে যখন তার প্রথম কবিতার বই বেরোল, তাতে সে লিখেছিল ‘এমনকী মায়ের শাড়িও শেষ পর্যন্ত বালাপোশ হয়ে যায়/ আমাদের ওম দেবে বলে।’ সেই ছেলেকেই দেখলাম মিছিলে গলা ফাটাচ্ছে সল্টলেক স্টেডিয়ামের রাস্তায়।

দিল্লিতে পা ভেঙে ঘরবন্দি হয়ে বসে আছেন কবি অরণি বসু। বহুদিন শহরছাড়া। তাঁরও আমার মতো দশা। শহরটাকে চিনতে অসুবিধে হচ্ছে। ১১ তারিখ সন্ধেবেলা কবিতা লিখে পাঠালেন—

‘আমাদের ভীরু ঘৃণা, রাগ মোমবাতিতেই শেষ/ যাদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেওয়ার কথা/ আমাদের খর্বকায় রাগ সে পর্যন্ত পৌঁছোয় না।’

আরও পড়ুন:দ্রৌপদী থেকে নির্ভয়া, ‘সবক’ শেখাতেই ধর্ষণ আজও
 

আরেক বন্ধু আমার রোজ এঁকে চলেছে ডিজিটাল পোস্টার। তার অসামান্য ক্যালিগ্রাফি আর অপূর্ব সেন্স অফ হিউমার নিয়ে। সবাই তাকে গদ্যলেখক বলে। আমার কাছে সে কবি, কবিই। তার দেখার চোখ আমাদের থেকে আলাদা। দুঃখ পেলে ওর মুখে মেঘ খেলা করে। তার ‘বিয়োগ শেখার স্কুল’ আমার খুব পছন্দের কবিতার বই। আর এই সেদিন লোকের ফোনে ফোনে ঘুরল কলকাতায় ফুটবল ম্যাচ বাতিল নিয়ে তার বানানো পোস্টার। 

—এই আমার দুনিয়া। তবে ঘরে বইপত্রে বাস করেন বহু মানুষ। যখন উত্তর খুঁজি, তাঁরা কেউ কেউ হাত বাড়িয়ে দেন। পিঠে হাত রাখেন। এই সঙ্কটেও হয়তো পাবো কোনও আলোর রেখা। 

তোমার কথা বলতে পারলাম না মেয়ে। তোমাকে যারা মেরেছে তারাও যে আমার মতো। পুরুষ।  

More Articles