শেখার অনেক বাকি আমাদেরও

Lesson Against Patriarchy: পুরুষ শিখছে, তার অস্তিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর এই গুরুত্ব অর্জন করতে খুব একটা বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। এটা তার পুরুষজন্মের অর্জন, অধিকার।

পুরুষ: দেখে শেখো, ঠেকে শেখো

পুরুষ কী শেখেনি, পুরুষকে কী শিখতে হবে, পুরুষের কোথায় গাফিলতি-কোথায় শিখতে না চাওয়া, কী ভাবে সক্রিয় হয় পুরুষতন্ত্র বা পেট্রিয়ার্কি, কী ভাবে আমরা আওরাই রেপ রেটরিক?

১। “পড়াশোনা ছাড়া আমার বাবুকে কিচ্ছু করতে দেওয়া হয়নি”

বাবু খেলার মাঠ থেকে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে বাড়ি ঢুকেই বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকে। আত্মীস্বজন আসলে সে কথা বলে না, লৌকিকতা করার জন্য বাবুকে কেউ জোর করে না। বাবু পড়ছে। তার একমাত্র লক্ষ্য চাকরি পাওয়া। টুথব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে বাবুর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় রোজ সকালে। বাবুর জামাকাপড় সবসময় কেচে ইস্ত্রি হয়ে প্রস্তুত থাকে। কোন জাদুমন্ত্রে এসব হয়ে যায়, তা নিয়ে বাবু মাথা ঘামায় না। হাতের কাছে জলের বোতল রাখা থাকে, বোতল খালি হলে বাবু ঘর থেকে "মা জল দাও" বলে হাঁক পাড়ে। পাশ থেকে দিদি যদি বলে, "নিজে নিয়ে আয়" — অশীতিপর ঠাকুমা কাঁপা হাতে জল নিয়ে এসে বলেন, “ছেলেরা নিজে জল গড়িয়ে খায় না”। বাড়িতে বাবুর কোনও দায়িত্ব নেই। বাবুকে ভালো রাখার দায়িত্ব বাকিদের। বাবু শিখছে, এ দুনিয়া তাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। সে অন্যের কথা ভাবে না, এমনকী নিজের কথাও ভাবে না। তার জীবন খুব সহজে চলে,আর বাবু শিখছে, যে সবকিছুই তাঁর জন্য সুলভ, সহজ। এই বাবুরা একদিন বড় হয়। নতুন শহরে কাজের প্রয়োজনে একা থাকতে গিয়ে, কী রাঁধবে কী খাবে কী পরবে— ভাবতে গিয়ে বাবু বিপদে পড়ে।

২। “মায়ের উপর যা করার করে নাও, বউ কিন্তু সহ্য করবে না”

এই সাবধানবাণী কোনও স্বাভাবিক ভবিষ্যতের প্রস্তুতি নয়, বরং এক অকারণ প্রতিযোগিতার সূচনা। মা এবং বউ, পুরুষের জীবনে দুই ভিন্ন সম্পর্কের নারী, তাঁদের আচরণও ভিন্ন হবে এমনটাই স্বাভাবিক। অথচ পুরুষকে বারবার এই তুলনা মনে করিয়ে শিখিয়ে দেওয়া হয় মা-বউ প্রতিপক্ষ। শেখানো হয়, মা ছেলের জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে করবে। যেসব মা করবে না, তারা বাজে মা। বউকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, মা যেভাবে ছেলের খেয়াল রেখেছে বউকেও তা-ই করতে হবে। কিন্তু বউ করবে না, এটাই বউদের ত্রুটি, তাই বউ হারালে বউ পাওয়া যায়, মা হারালে মা পাওয়া যায় না— গোত্রের সংলাপ সিনেমায় জনপ্রিয় হয়। শেখানো হয়,পুরুষদের দেখাশোনা করে সুখে রাখাই মেয়েদের একমাত্র কাজ। বদলে পুরুষ নারীকে দেবে আশ্রয়, নিরাপত্তা।

এভাবেই গড়ে দেওয়া হয় পাওয়ার স্ট্রাকচারের একটি স্তম্ভ।

আরও পড়ুন: দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অপেক্ষায় প্রহর গুণছি

৩। “ছেলে পছন্দ করে না বলে শাড়ি ছাড়া অন্য কোনো পোশাক পরি না”

ছেলের বয়স মাত্র তিন। মা সালোয়ার কামিজ পরেছে দেখে সেই ছেলে মাকে চিনতে পারেনি। শাড়ি পরা মাকে দেখে অভ্যস্ত বাচ্চা মাকে অন্য পোশাকে দেখে বলেছে 'মা তুমি শাড়ি পরবে'। নিজের পরিবেশে সামান্য হেরফের হলেই শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। কিন্তু শিশুমন যত তাড়াতাড়ি বিচলিত হতে সক্ষম, ততো সহজে মানিয়ে নিতেও শেখে, যদি শেখার সুযোগ দেওয়া হয়। মা সেই শিশুর দাবি মেনে শাড়ি ছাড়া কিছু পরলেন না আজীবন। বালকটিকে শেখানো হল না মন খোলা রাখতে হয়। আপাত অপছন্দের বিষয়কে অন্য দৃষ্টিতে নতুন করেও দেখা যেতে পারে। কিংবা অপছন্দ সত্ত্বেও অন্যের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হয়। এসব পুরুষটিকে শেখানো হচ্ছে না। এর ফলে আরও অনেকগুলি 'খতরনাক' ধারণা শিশুপুত্রের মনে অলক্ষ্যে তৈরি হচ্ছে - শাড়ি মানে ভালো, কারণ মা পরে। যারা শাড়ি ছাড়া অন্য পোশাক পরে তারা মায়ের মতো ভালো নয়। আজকে শাড়ি, কালকে কথা বলার ধরন, পরশু অন্য কিছু অপছন্দ হলে, সকলে একবাক্যে শিশুপুত্রের মনের মতো কাজটি করতে বাধ্য। পাওয়ার স্ট্রাকচার আরও শক্তিশালি হয়ে ওঠে। পুরুষটি শিখছে যে তার মন্তব্যই শেষ কথা। 'জো বোল দিয়া, বাস বোল দিয়া' শুধু করণ 'জোহারের সিনেমার ডায়লগ নয়, শিশুমনের মনে গেঁথে দেওয়া অমোঘ বিশ্বাস।

The patriarchal concept rooted deeply in our society need to be uprooted by Sreejata Robibarer Royak

৪। “আপনার লেখা পড়লে তো বোঝা যায় না মেয়েছেলের লেখা, কোথাও 'আমায় বাঁচাও আমায় বাঁচাও' আর্তি নেই”

যে পাওয়ার স্ট্রাকচারটা তৈরি হচ্ছিল, তার ক্লাইম্যাক্স এই উক্তিতে। পুরুষের ভূমিকা এখানে স্পষ্ট, সে রক্ষাকর্তা, এবং তাকে রক্ষা করার সুযোগ দিতে হবে নারীকে। যে কারণে এক পুরুষ পাঠক মেয়েদের লেখায় খুঁজছে আর্তি। যার লেখায় পাচ্ছে না, তার আইডেন্টিটি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে। কারণ, অসহায় নারীর যদি পুরুষ রক্ষাকবচের প্রয়োজন না হয়, তাহলে পুরুষটির আইডেন্টিটি ক্রাইসিস হতে বাধ্য। আত্মনির্ভরশীল নারীর ইমেজ মেনে নিতে শিখছে না পুরুষ। সমাজ তাকে শেখাতে পারছে না। এর ফলে সে শুধু নারীর স্বভাব সম্পর্কে একমাত্রিক ধারণা তৈরি করছে না, পুরুষ কেমন হবে তারও একটা সরলরৈখিক ধারণা তৈরি করছে। নিজের নিরাপত্তাহীনতা সম্পর্কে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারছে না, আবেগ প্রকাশ করতে পারছে না, এগুলি নারীর লক্ষণ, অর্থাৎ আর্তের লক্ষণ। পুরুষালী নয়, এগুলি দুর্বলতার পরিচয়। এই ধারণার ভার নিয়ে চলতে শিখছে পুরুষ।

আরও অজস্র কথোপকথন থেকে উদ্ধৃতি তুলে হাজারও ব্যাখ্যা করা যায়। দেখা যাবে উদাহরণের রকমফেরে সামগ্রিক উপসংহারগুলি একই থাকছে। শহর, গ্রাম, দেশ বদলে যেতে পারে, ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ বদলাতে পারে, কিন্তু পুরুষ কী শিখছে,এবং একই সঙ্গে কী শিখছে না বা শিখতে চাইছে না, সেগুলি মোটামুটি একই।

১. পুরুষ শিখছে, তার অস্তিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর এই গুরুত্ব অর্জন করতে খুব একটা বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। এটা তার পুরুষজন্মের অর্জন। অধিকার।

২. এক্ষেত্রে, গুরুত্ব আর ক্ষমতা সমার্থক। পুরুষ শিখছে, তার ক্ষমতা আছে এবং সেই ক্ষমতা সে নারীর উপর খাটাতে পারে, কারণ নারী দুর্বল। নারী পুরুষের কাছে আশ্রয় চায়।

The patriarchal concept rooted deeply in our society need to be uprooted by Sreejata Robibarer Royak

৩. স্বভাব, আচরণ, পোশাক ইত্যাদি মিলিয়ে লিঙ্গভিত্তিক একরৈখিক একটা ধারণা নিয়ে চলতে শিখছে পুরুষ। মনুষ্য চরিত্রের বহুমুখী বৈশিষ্ট্যগুলিকে দেখতে শিখছে না, দেখলেও তাকে স্বীকার করতে শিখছে না।

৪. এই বৈচিত্র্যের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকছে বলে, পুরুষ তার সহজাত সহানুভূতিশীল মনটিকে হারিয়ে ফেলছে। অন্যের প্রতি তার সহানুভূতি থাকছে না। বিশেষ করে নারীর প্রতি সহানুভূতি থাকছে না, কারণ নারী এই পাওয়ার স্ট্রাকচারে দুর্বলপক্ষ।

৫. আদর্শ পুরুষ-নারী কেমন হওয়া উচিত তার সীমাবদ্ধ ধারণাগুলি বাস্তবে না মিললে শুরু হচ্ছে কুবচন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, রেপ-রেটোরিক, এবং ধর্ষণ। গোটাটাই ক্ষমতা প্রদর্শন।

আরও পড়ুন: এক সন্ধেয় বুঝেছি কন্যার বাবা হওয়া কী

যখন সামাজিক বা ব্যক্তিগত স্তরে একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে, আমরা একজোট হয়ে খুব জটিল আলোচনায় জড়িয়ে পড়ি। কার কখন কোথায় কী ভুল ছিল, যার ফলস্বরূপ দুর্ঘটনাটি ঘটল, স্বাভাবিকভাবেই এসব খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। ছোট ছোট যে ভুল ত্রুটিগুলি সমাজবদ্ধভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লালন করে চলেছি, সেগুলি নিয়ে ভাবনার অবকাশ আমাদের হয় না। আপাত সাধারণ, দৈনন্দিন আচরণগুলি যে বড় দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে, সেই যোগসূত্রটা আমাদের অবিশ্বাস্য মনে হয়।

ছোটখাটো কথাগুলি বড় করে ভাবার এবার সময় হয়েছে। একা পুরুষকে নয়, আরও অনেক, অনেক শিখতে হবে আমাদের সকলকেই।

More Articles