‘ডানকি রুটে’ আমেরিকায় ঢোকার নয়া শর্টকাট এখন কানাডা! যে বিপদের মুখে অসংখ্য ভারতীয়

Indians illegally enter US: মার্কিন কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের তথ্য বলছে, এই বছর জানুয়ারি থেকে জুন মাস, এই সময়ে কানাডা-মার্কিন সীমান্তে ধরা পড়া ভারতীয়ের সংখ্যা প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৪৭ শতাংশ বেড়েছে।

দেশে হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক পড়ুয়া এবং কর্মীর সংখ্যা কমানোর কথা ঘোষণা করেছে কানাডা। যার ফলে এক অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে প্রায় ৭০ হাজার আন্তর্জাতক পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ। তার মধ্যে রয়েছে বহু ভারতীয়ও। আজ থেকে নয়, বহু দিন ধরেই কানাডায় অভিবাসী সংখ্যা বেশ বেশি। এতদিন সেই সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এসেছে কানাডাই। যার ফলে সে দেশের নাগরিকদের বেকারত্বের হার বাড়ছে বলেই দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ উঠছে। যার জন্য অভিবাসী নীতিতে বড়সড় পরিবর্তন আনার কথা ভেবেছে কানাডা সরকার। এই পরিস্থিতিতে আমিরিকা ও ব্রিটেনের বড় অভিযোগের মুখে পড়ল প্রাইম মিনিস্টার জাস্টিন ট্রুডোর কানাডা।

সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কানাডা থেকে আমেরিকায় পাড়ি দেওয়া অবৈধ শরণার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। শুধু বাড়েইনি, কার্যত সাম্প্রতিক কালে বৈধ নথিপত্র ছাড়া কানাডা থেকে আমেরিকায় ঢোকার ঘটনা সর্বকালের রেকর্ড ছুঁয়েছে। যার ফলে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে কানাডায় ভিসা স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া নিয়েই। অন্তত ৫,১৫২ জন ভারতীয় এই জুনেই কানাডা থেকে পায়ে হেঁটে আমেরিকায় ঢুকেছে। এবং তাঁদের কাছে কোনও রকম বৈধ কাগজপত্র নেই। মার্কিন কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন (CBP) এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

আরও পড়ুন: প্রশ্নের মুখে ভবিষ্যৎ! ভারতীয়-সহ ৭০ হাজার বিদেশি পড়ুয়াকে কেন নির্বাসন দিচ্ছে কানাডা?

মেক্সিকো রুট দিয়ে প্রতিবছর অসংখ্য অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে আমেরিকায়। তার জন্য কুখ্যাত হয়ে রয়েছে ওই মেক্সিকো রুট। তবে ২০২৩ সালে মেক্সিকোর রুট থেকে অনুপ্রবেশের ঘটনাকে টপকে গিয়েছে কানাডা দিয়ে আমেরিকায় ঢোকা অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যাকে। মার্কিন-কানাডা সীমান্ত পৃথিবীর দীর্ঘতম অরক্ষিত সীমান্ত। প্রায় ৯০০০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এটি। কার্যত মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্তের থেকে দৈর্ঘ্যে প্রায় দ্বিগুণ। এমনকী চিন-ভারত ৩,৪০০ কিলোমিটার প্রশস্ত সীমান্ত এলাকার থেকেও প্রায় তিনগুণ বড় এই সীমান্ত এলাকা।

মার্কিন কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের তথ্য বলছে, এই বছর জানুয়ারি থেকে জুন মাস, এই সময়ে কানাডা-মার্কিন সীমান্তে ধরা পড়া ভারতীয়ের সংখ্যা প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৪৭ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩ সালে ২,৫৪৮ জনকে আটক, বহিষ্কার বা ঢোকা থেকে আটকেছে আমেরিকা কর্তৃপক্ষ। ২০২৪ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ৩,৭৩৩। তবে এ প্রবণতা আজকের নয়। ২০২৩ অর্থবছরে,মার্কিন এজেন্টরা প্রায় ৯৭,০০০ অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীর আমেরিকা প্রবেশ আটকায়। তার মধ্যে প্রায় ৩০ হাজারই ধরা পড়েছিল কানাডা সীমান্তে। তার পর থেকেই অবৈধ ভাবে অনুপ্রবেশের জন্য কানাডা-মার্কিন সীমান্তের ব্যবহার বেড়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কানাডা-ভারত সীমান্ত থেকে অন্তত ১৪ হজার অবৈধ ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীর মুখোমুখি হয়েছে আমেরিকা।

How the Canada border is becoming the preferred choice for Indians to illegally enter the US

আমেরিকায় ঢুকে পড়া অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নিরিখে এই মুহূর্তে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। PEW রিসার্চ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ থেকে আমেরিকায় বসবাসকারী অবৈধ ভারতীয় শরণার্থীর সংখ্যা ৭২৫,০০০। যাদের কাছে কোনও কাগজপত্র নেই। কেন কানাডা থেকে ভারতীয়দের আমেরিকায় ঢোকায় এমন বাড়বাড়ন্ত? বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, বহু শরণার্থীই বহু ক্ষেত্রে কানাডার ভিসা চায় আমেরিকায় প্রবেশের জন্য। কারণ আমেরিকায় ভিসা পাওয়ার চেয়ে কানাডার ভিসা পাওয়া অনেকটাই সহজ। এর পর নানাবিধ ডানকি রুট তো খোলা রয়েইছে আমেরিকায় প্রবেশের জন্য। আমেরিকা-কানাডার ওই সুবিশাল সীমান্তের বড় অংশ বহু ক্ষেত্রেই অরক্ষিত থেকে যায়। সেই সুবিধাটাই নেওয়া হয়। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আমেরিকায় গুছিয়ে বসতে চান যাঁরা, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত। আরও একটি ভালো জীবন, ভালো রোজগারের আশায় ঘটিবাটি, জমিজিরেত বেচে কোনও মতে বিদেশযাত্রার খরচটুকু তুলে আনেন। দিন কে দিন যেভাবে পেশাগত ভাবে বিপদের মুখে পড়ছে কৃষিজীবীরা, তার ফলেও বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা এবং বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা আশ্রয় নেন 'ডানকি' পথেরও।

'ডানকি' পথ মানেই যে পদে পদে বিপদ, তা বলিউড ছবির দৌলতে সকলেই জানেন প্রায়। তবে সেই সব পথের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ কানাডা থেকে আমেরিকায় ঢোকার পথ। তবে কঠিন কি একেবারেই নয়? ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কানাডার-মার্কিন সীমান্তের কাছে দুটি শিশু-সহ চারজনের এক ভারতীয় পরিবারের সকলে মারা যান। জানা যায়, গুজরাটের একটি গ্রাম থেকে অবৈধ পড়ে আমেরিকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন তাঁরা। রাস্তায় তুষার ঝড়ের মুখোমুখি হয় তাঁরা, যাতে গোটা পরিবারের সকলে মারা যান। সীমান্ত থেকে প্রায় ১৩ গজ দূরে তাঁদের মৃতদেহ উদ্ধার হয়।

How the Canada border is becoming the preferred choice for Indians to illegally enter the US

ভারতীয়দের মধ্যে আমেরিকা যাত্রার স্বপ্ন আজকের নয়। দেখা গিয়েছে, যাঁরা আমেরিকায় অবৈধ ভাবে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই গুজরাট বা পঞ্জাবের বাসিন্দা। মার্কিন গোয়েন্দারা সম্প্রতি একটি চোরাচালান নেটওয়ার্কের খোঁজ পেয়েছেন, যার মাধ্যমে গুজরাটি অভিবাসীদের চোরাগোপ্তা পথে কানাডা সীমান্ত থেকে শিকাগো এলাকায় একটি গুজরাটি-মার্কিন মালিকানাধীন ব্য়বসা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়।

আরও পড়ুন:মানুষ পাচারের সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় বিমান? নেপথ্যে যে কাহিনি ‘ডানকি ফ্লাইটে’র

একই সঙ্গে কানাডায় গুছিয়ে বসতে থাকা ভারতীয়ের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। ২০২৩ সালে কানাডায় আসা ভারতীয় ছাত্রের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩১৯,০০০ জন। চলতি বছরের শুরুতেই স্টাডি পারমিটের সংখ্যায় লাগাম টানে জাস্টিন ট্রুডো সরকার। সেই সংখ্য়া বেঁধে দেওয়া হয় ৩৬০,০০০-এ। একধাক্কায় প্রায় ৩৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া স্টাডি পারমিটের সংখ্য়া। তার পরে এবার আরও কড়াকড়ির কথা ঘোষণা করেছে ট্রুডো সরকার। ভিসা পলিসি থেকে অভিবাসন পলিসি, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিয়ম কড়া করতে চাইছেন ট্রুডো ভোটের আগে।

এদিকে শুধু আমেরিকা নয়, ব্রিটেনেও কানাডা থেকে ঢোকা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বাড়ছে বলে অভিযোগ জানিয়েছে তারা। ইতিমধ্যেই ব্রিটেনের হোম অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, এই অনুপ্রবেশ তারা রুখবেই। এরই মধ্যে আবার অভিবাসন নীতি ও ভিসা পলিসি নিয়ে কড়াকড়ি করার কথা ঘোষণা করছে ট্রুডো সরকার। এর ফলে কি আমেরিকা বা ব্রিটেনে বেআইনি অনুপ্রবেশ আরও বাড়বে? বেআইনি রাস্তায় কিংবা ডানকি পথে বাড়বে আমেরিকায় আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতা? এই সুযোগে বাড়বাড়ন্ত হবে সেই সব দালালদের, যারা টাকার বিনিময়ে বেআইনি পথে কাগজপত্র ছাড়াই অন্য দেশে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবসা ফেঁদে বসবে আরও? স্বাভাবিক ভাবেই থেকে যাচ্ছে সেই প্রশ্নও।

More Articles