দুর্ঘটনার আতুরঘর ট্রেন! শিউরে উঠবেন গত দু'বছরের রেল দুর্ঘটনার খতিয়ান জানলে
Train accidents in 2023-2024: খাতায় কলমে হিসেব বলছে, শুধু ২০২৩ সালেই ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ১৭টি রেল দুর্ঘটনা হয়েছে ভারতে। হ্যাঁ, অঙ্কটা সত্যিই ভয় ধরানোর মতোই।
আরও এক জুন মাস। করমণ্ডলের স্মৃতি উস্কে ফের আরও একটি ট্রেন দুর্ঘটনা। সোমবার সাত সকালে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। শিয়ালদহের দিকে আসার পথে মালগাড়ির ধাক্কায় ট্রেনের পিছন দিকে দু'টি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের। একটি কামরা লাইনের উপরে উঠে যায়, অন্যটি যায় দুমড়েমুচড়ে। ওই দুর্ঘটনায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। জখম জনা চল্লিশেক ব্যক্তি। তবে এই কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের ঘটনা কিন্তু কোনও ব্য়তিক্রমী কাণ্ড নয়। প্রতিবছরই ভারতীয় রেলে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলে। কয়েকদিন সেসব নিয়ে কথাবার্তা হয়। প্রশ্ন ওঠে রেলে যাত্রীসুরক্ষা নিয়ে। তার পর আবার থিতিয়ে পড়ে সব।
গত বছর জুন মাসেই একই রকম একটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেস। ২ জুন সন্ধে সাতটা নাগাদ ওড়িশার বালেশ্বরের বাহানগায় মালগাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে লাইনচ্যুত হয় করমণ্ডল এক্সপ্রেস। ২৯৬ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন ওই দুর্ঘটনায়। আহত হয়েছিলেন প্রায় ১২০০ জন। ওই বছরেরই অক্টোবর মাসে বিহারের বক্সার জেলার রঘুনাথপুর স্টেশনের কাছে লাইনচ্যুত হয় আনন্দ-বিহার কামাক্ষ্যা নর্থ ইস্ট এক্সপ্রেস। মৃত্যু হয় অন্তত ৫ জনের। জখম হয়েছিল অন্তত ৭০। খাতায় কলমে হিসেব বলছে, শুধু ২০২৩ সালেই ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ১৭টি রেল দুর্ঘটনা হয়েছে ভারতে। হ্যাঁ, অঙ্কটা সত্যিই ভয় ধরানোর মতোই। পকেটের টাকা খরচ করে টিকিট কেটে যে ট্রেনে সফর করছেন মানুষ, তার নিরাপত্তা যে ক্রমশ তলানিতে ঠেকছে, তা ফের প্রমাণ করে দিয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের ঘটনা।
আরও পড়ুন: দিনের পর দিন বিনিদ্র ডিউটি! চালক নাকি রেলকর্তৃপক্ষ, দুর্ঘটনার আসল দায় কার?
২০২৩ সালের সতেরোটি দুর্ঘটনার মধ্যে অন্তত ছ'টিই ঘটেছিল জুন মাসে। ওই বছর জানুয়ারি মাসে রাজস্থানের মারওয়ার স্টেশন ছাড়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে সূর্যনগরী এক্সপ্রেস। লাইনচ্যুত হয় ১১টি কামরা। এই ঘটনায় আহত হন ১০ জন যাত্রী। ওই বছর ৩ এপ্রিল কেরলের কান্নুরগামী একটি এক্সপ্রেসে আট সহযাত্রীর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে এক যাত্রীর বিরুদ্ধে। পরে, একটি দুই বছর বয়সি শিশু কন্যা-সহ তিন জনের দেহ লাইন থেকে উদ্ধার হয়। সেই ঘটনায় যাত্রী সুরক্ষা নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষের দিকে আঙুল উঠেছিল।
২০২৩ সালেরই মে মাসে বেঙ্গালুরুগামী চেন্নাই-বেঙ্গালুরু ডাবল ডেকার এক্সপ্রেসের একটি কামরা বেঙ্গালুরু অভিমুখে বিসনাট্টম স্টেশনের কাছে লাইনচ্যুত হয় সাড়ে ১১টা নাগাদ। যদিও ওই ঘটনায় হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। ২ জুন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। পরের দুর্ঘটনাটি ঘটে এর ছ’দিন পর, ৮ জুন। দুপুর ৩টে নাগাদ উটি থেকে মেট্টুপালায়ামগামী নীলগিরি মাউন্টেন রেলের একটি কামরা কুন্নুরের কাছে লাইনচ্যুত হয়। এর এক দিন পরেই লাইনচ্যুত হয় বিজয়ওয়াড়া-চেন্নাই সেন্ট্রাল জনশতাব্দী এক্সপ্রেসের একটি কামরা। চেন্নাই সেন্ট্রাল থেকে কারশেডের দিকে যাচ্ছিল ওই ট্রেন। এর দু’দিন পর আবার চেন্নাই সেন্ট্রাল থেকে তিরুভাল্লুর যাওয়ার পথে লোকাল ট্রেনের একটি কোচ বেসিন ব্রিজ স্টেশনের কাছে লাইনচ্যুত হয়। ২২ জুন চেন্নাই থেকে মুম্বইগামী লোকমান্য তিলক এক্সপ্রেসের একটি কামরায় আগুন ধরে যায়।
এর পর ২৫ জুন নাগাদ বাঁকুড়ার ওন্দাগ্রাম স্টেশনের কাছে লুপ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালগাড়িকে পিছন দিক থেকে সজোরে ধাক্কা মারে অন্য একটি মালগাড়ি। ঘটনায় চলন্ত মালগাড়ির ইঞ্জিন-সহ বেশ কয়েকটি বগি বেলাইন হয়ে ছিটকে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দু’টি মালগাড়ির মোট ১৩টি বগি। রেল সূত্রে খবর, এই দুর্ঘটনার জেরে রেলের ১০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছিল। তবে করমণ্ডলের দুর্ঘটনা ছাড়া, ২০২৩ সালের জুন মাসে ঘটা বাকি পাঁচটি ট্রেন দুর্ঘটনার একটিতেও কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ওই বছরেরই ৭ জুলাই তেলঙ্গানার ইয়াদাদ্রি-ভুবনগিরি জেলার বোমাইপল্লি এবং পাগিদিপল্লির মধ্যে হাওড়াগামী ফলকনামা এক্সপ্রেসের তিনটি কামরায় আগুন লাগে। তবে সেই ঘটনাতেও হতাহতের সংখ্যা ছিল শূন্য।
এরপর ২৬ অগস্ট ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ মাদুরাই স্টেশনের কাছে লখনউ-রামেশ্বরম ভারত গৌরব ট্রেনের একটি কামরায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় ৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আহতের সংখ্যা ছিল ২০ জনেরও বেশি। রেলের তরফে জানানো হয়েছিল, এক্সপ্রেস ট্রেনের ওই কামরাটি ব্যক্তিগত ভাবে ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। ওই কামরার যাত্রীরা আসছিলেন লখনউ থেকে। কামরায় একটি গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। সেখান থেকেই বিপত্তি। ২০২৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ভালসাদ স্টেশন অতিক্রম করার সময় তিরুচিরাপল্লী-শ্রী গঙ্গানগর হামসফর এক্সপ্রেসের দু’টি কামরায় আগুন ধরে যায়। তবে সেই ঘটনায় কেউ মারা যাননি। এর তিন দিন পরে, অর্থাৎ ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে একটি লোকাল ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে মথুরা স্টেশনের ২এ প্ল্যাটফর্মে উঠে যায়।
অক্টোবরের ১১ তারিখ বিহারে ট্রেনদুর্ঘটনাটি ঘটে। তারপরেই ২৯ অক্টোবর রাত ৯টার একটু পরে অন্ধ্রের কোট্টভালাসা স্টেশনের কাছে বিশাখাপত্তনম-রায়গাদা এবং বিশাখাপত্তনম-পালাসা প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সংঘর্ষে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন প্রায় ৫০ জন। এর দু’দিন পরে গাজিপুর থেকে দিল্লির আনন্দ বিহারগামী সুহেলদেও সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজের কাছে লাইনচ্যুত হয়। এর পরের মাসে উত্তরপ্রদেশের ইটাওয়ার কাছে দিল্লি-দ্বারভাঙা সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসে আগুন ধরে যায়। এই দুই ঘটনাতেই কেউ মারা যাননি। তবে বেশ কয়েক জন যাত্রী আহত হন। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালটা গোটাটাই ছিল দুর্ঘটনার বছর।
আরও পড়ুন: এনডিআরএফ আসতে ১ ঘণ্টারও বেশি দেরি! ইদ ফেলে উদ্ধারে ছুটে এসেছিলেন স্থানীয়রাই
২০২৪ সালটাও তার ব্যতিক্রম হল না। চলতি বছর মোট দুটি রেল দুর্ঘটনার খবর মিলেছে। তার মধ্যে একটি এই কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা। এর আগে ২৮ ফেব্রুয়ারি নাগাদ ঝাড়খণ্ডের জামতাড়ায় একটি দুর্ঘটনা ঘটে পূর্ব রেলের আসানসোল ডিভিশনের বিদ্যাসাগর ও কাশিটার স্টেশনের মাঝে। লোকাল ট্রেনের ধাক্কায় দু’জন যাত্রীর মৃত্যু হয়। ডাউন অঙ্গ এক্সপ্রেসে আগুন লেগেছে বলে ভুয়ো খবর যাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর পর যাত্রীরা চেন টেনে অঙ্গ এক্সপ্রেস থামিয়ে দেন বলে খবর। ট্রেন থেকে নেমে রেললাইন ধরে হাঁটার সময় আসানসোল-ঝাঝা লোকাল ট্রেনের ধাক্কায় দু’জনের মৃত্যু হয়। আহতও হন অনেকে। তার পরে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের স্মৃতি ফিরিয়ে ফের ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে গেল শিয়ালদহগামী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে। ফের একই রকম ভাবে প্রশ্ন উঠে গেল যাত্রীসুরক্ষা নিয়ে। কিন্তু তার পরেও সত্যিই কি টনক নড়বে কর্তৃপক্ষ। এর উত্তর যে প্রশ্নের চেয়েও কয়েকগুণ কঠিন, তা বোধহয় ভারতবাসী এতদিনে ঠিকই জানেন।