'অখণ্ড ভারত' তুরুপের তাস! লোকসভা ভোটের আগেই ভারতের দখলে পাক অধিকৃত কাশ্মীর?

Pakistan-occupied Kashmir: বিজেপির এবং গোদি মিডিয়ার তরফে বারবার একটি বিষয় প্রচার করা হচ্ছে, পাক-অধিকৃত কাশ্মীর এবার ভারতেই ফিরিয়ে আনতে চলেছেন নরেন্দ্র মোদি।

পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের ঘর ওয়াপসি! রাম মন্দির নয়, তাহলে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে চির পরিচিত, সবচেয়ে বিশ্বস্ত তাসটিই খেলতে চলেছে মোদি সরকার? বেশ কিছুকাল ধরেই পাক অধিকৃত কাশ্মীরে নানা সমস্যা চলছে। বিজেপির এবং গোদি মিডিয়ার তরফে বারবার একটি বিষয় প্রচার করা হচ্ছে, পাক-অধিকৃত কাশ্মীর এবার ভারতেই ফিরিয়ে আনতে চলেছেন নরেন্দ্র মোদি। বিশেষ করে গিলগিট ও বেলুচিস্তান অংশে লাগাতার বিক্ষোভে নাকি সেই অংশের মানুষ ভারতের সঙ্গে জুড়তে চাইছেন বলে দাবি করা হচ্ছে।

২০১৯ সাল থেকেই বিজেপি সরকার বলছে পাক অক্যুপায়েড কাশ্মীরকে অর্থাৎ পিওকে এবার ভারতের অন্তর্গত করাই সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। বিভিন্ন গোদি মিডিয়া বারবার দাবি করছে, পাক অধিকৃত কাশ্মীরে পাক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন চলছে। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মানুষরাই নাকি জুড়তে চাইছেন ভারতের সঙ্গে কারণ সারা পাকিস্তানের মতোই পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে মানুষের অবস্থা শোচনীয়। বিদ্যুৎ নেই, জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া। জম্মু কাশ্মীরের উন্নতি দেখার পরে নাকি এই অরাজকতা বেড়ে গিয়েছে আরও।

কী এই পাক অধিকৃত কাশ্মীর?

পাক-অধিকৃত কাশ্মীর একসময় জম্মু ও কাশ্মীরেরই অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় ব্রিটিশরা এই অংশের উপর তাদের দাবি ত্যাগ করে বলে, ভারত বা পাকিস্তান- যে অংশের সঙ্গে যুক্ত হতে ইচ্ছুক সেখানেই জুড়ে যাওয়া সম্ভব বা স্বাধীন থাকাও সম্ভব। সেই সময়ে, জম্মু ও কাশ্মীরের শাসক মহারাজা হরি সিং স্বাধীন আধিপত্যকেই বেছে নিয়েছিলেন। তবে সেই ১৯৪৭ সালেই এই অঞ্চলের কৃষকদের উপর হরি সিং কর্তৃক আরোপিত শাস্তিমূলক করের কারণে পুঞ্চে একটি বিদ্রোহ দেখা দেয়।

আরও পড়ুন: কাশ্মীরের দুর্দশার জন্য দায়ী নেহরু, বলছেন অমিত শাহ! কী বলছেন কাশ্মীরে মানুষ?

সেই বছরেরই অক্টোবরে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাজার হাজার পশতুন উপজাতি, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সমর্থনে মহারাজার শাসন থেকে এই অঞ্চল মুক্ত করার লক্ষ্যে জম্মু ও কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করে। মহারাজার সেনাবাহিনী ব্যর্থ হয়। বিদ্রোহীরা পুঞ্চ জেলার বেশিরভাগ অংশ নিজেদের দখলে আনে, মুজাফফরাবাদ ও বারামুল্লা দখল করে। পরবর্তীকালে, এই মহারাজাই ভারত সরকারের সাহায্য চেয়েছিলেন।

ভারত সরকার রাজি হয় সাহায্যে কিন্তু একটি শর্তে। মহারাজাকে একটি 'অধিভুক্তির দলিল' সই করতে হবে। মহারাজা তাতে সই করেন এবং প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয় এবং যোগাযোগের নিয়ন্ত্রণ ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করেন। ভারতীয় সৈন্যদের শ্রীনগরে পাঠানো হয় এবং ভারতীয় ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধের পথ ধরেই দু'টি অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ স্থিতিশীল হয়। পাকিস্তানের বিদ্রোহের ফলে যে এলাকা দখল হয়েছিল, সেটিই এখন পাক-অধিকৃত কাশ্মীর নামে পরিচিত।

এই প্রায় ৭৬ বছরে গিলগিট-বেলুচিস্তানের অবস্থার বদল হয়নি বিশেষ। প্রায় বছর খানেক ধরেই নতুন করে উত্তাল পরিস্থিতি। সেখানে সাধারণ নির্বাচনের আগে বোমা বিস্ফোরণ এবং গোলাগুলি চলছে। অসংখ্য মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, আহত হচ্ছেন বহু, সম্পত্তির ক্ষতি হচ্ছে বিপুল। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) নির্বাচনী অফিস এবং একটি পুলিশ ঈগল বাহিনীর গাড়ি লক্ষ্য করে কোয়েটার কামবারানি রোডে পরপর দু'টি বিস্ফোরণ ঘটেছে। অজ্ঞাত পরিচয় বন্দুকবাজরা পাথরবাহী ট্রলারে হামলা চালাচ্ছে। পাকিস্তান কোস্টগার্ড অফিসের প্রধান দরজাতেও হ্যান্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়। মাস্তুং জেলার কেন্দ্রীয় কারাগারে, পঞ্জগুরের চিতকান এলাকায় জেলা প্রশাসক অফিসে হ্যান্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়।

বেলুচিস্তানের দুক্কি জেলায়, অজ্ঞাত পরিচয় সশস্ত্র ব্যক্তিরা একটি কয়লা খনিতে হামলা চালিয়ে দুই খনি শ্রমিককে অপহরণ করেছে। হামলাকারীরা অবিলম্বে এই খনিতে কাজ বন্ধ করার হুমকিও দিয়েছে। সাধারণ নির্বাচনের আগে, কোয়েটা, খুজদার, কেচ, পাঞ্জগুর, দুক্কি, কালাত, নোশকি, মাস্তুং সহ বেলুচিস্তানের বিভিন্ন জেলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, নির্বাচনী প্রার্থী, পুলিশ ফাঁড়ি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান কোম্পানির উপর ২৯টিরও বেশি হামলা হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত কোনও গোষ্ঠী এসব হামলার দায় স্বীকার করেনি। কিন্তু গোটা বেলুচিস্তান জুড়েই বাড়ছে হামলা।

ফারুক আবদুল্লাহ একবার বলেছিলেন, ৩৭০ ধারা কোনওদিন কেউই বাতিল করতে পারবেন না। কিন্তু মোদি সরকার তা ২০১৯ সালে বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরকে রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করে। বিজেপির দাবি, সন্ত্রাসবাসী কার্যকলাপ নাকি ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার পরে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। অন্যদিকে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের সম্পদ কেড়ে নিয়ে অন্যত্র বন্টন করা হচ্ছে। সেখানকার মানুষ 'মোদি সরকার'-এর থেকে সাহায্য চাইছে বলে দাবি। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মানুষের রাজনৈতিক কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই। সেখানে জমির কোনও মালিকানা নেই কারও, খাবার সংস্থান কম। ২২ ঘণ্টাই লোডশেডিং। বেলুচিস্তানে এখন বহিরাগত ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স বাতিলের দাবি উঠেছে। প্রায় গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। মানুষ সেখানে কার্গিল রোড খুলে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে যাতে সেখান দিয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মানুষরা ভারতে আসতে পারবেন। গোদি মিডিয়ার একটা অংশ বলছে, গিলগিট বেলুচিস্তানে চিনের বিনিয়োগ রয়েছে। তাই পাকিস্তান নয়, মূল লড়াই ভারত ও চিনের মধ্যেই।

গিলগিট-বেলুচিস্তানে গত কয়েক বছরে ফেডারেল সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষের বিক্ষোভের সংখ্যা বাড়ছে। ভর্তুকিযুক্ত গমের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে চলছে লাগাতার আন্দোলন। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন এবং সিএসওর জোট আওয়ামী অ্যাকশন কমিটির ডাকে গিলগিট বেলুচিস্তান জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। স্কার্ডুতে লাগাতার ধর্মঘট চলছে। দিয়ামার, হুনজা, ঘিজার, ঘাঞ্চে এবং নগরের মতো অন্যান্য জেলাতেও হাজার হাজার বিক্ষোভ চলছে।

গিলগিট বেলুচিস্তানের বিতর্কিত অবস্থা এবং ব্যাপক দারিদ্র্যের কারণে, ১৯৭০-এর দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো ভর্তুকি চালু করেন। তিনিই এই অঞ্চলে সংস্কার শুরু করেছিলেন। গম, তেল, পিআইএ টিকিট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের উপর ভর্তুকি ছিল। ধীরে ধীরে গম ছাড়া সব ভর্তুকিই তুলে নেওয়া হয়। ভর্তুকির দাবির পাশাপাশি কর বাতিল এবং ফাইন্যান্স অ্যাক্ট ২০২৩ স্থগিত করা, বিদ্যুৎ বিভ্রাট কমানো এবং গিলগিট-বেলুচিস্তান-এর খনিজ সম্পদের শোষণ বন্ধের দাবি উঠেছে। গত কয়েক বছরে কিছু ধর্মীয় নেতা সহ নাগরিক অধিকার কর্মীদেরও আটক রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন: হাজার হাজার মানুষ বুঁদ নেশায়! কয়েক বছরে কাশ্মীরে কেন হু হু করে ছড়াল মাদক মহামারী?

শোনা যাচ্ছে, এই বিক্ষোভকে ব্যবহার করে পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগে নাকি ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, লোকসভা ভোটের আগে আবারও সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মাস্টারস্ট্রোক খেলবে না তো মোদি সরকার? তবে  কি রাম মন্দিরের এই দেশব্যাপী ঢক্কানিনাদ তেমন ভাবে দানা বাঁধল না? কর্মসংস্থান, নারীসুরক্ষা, মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নগুলো যেন সে-ই জেগেই রইল। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, 'অখণ্ড ভারতের' জিগির তোলাটাই এখন ব্রহ্মাস্ত্র বিজেপির? কিন্তু এত সব কিছুর মধ্যে প্রশ্ন হল,  কাশ্মীর আসলে কী চাইছে? আপাতত সেই উত্তরটাই খুঁজছে গোটা দেশ। 

More Articles