রাম মন্দিরের রায় দিতে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়?
DY Chandrachud: প্রধান বিচারপতি যখন সংবিধানের পরিবর্তে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের কথা, ব্যক্তিগত ধর্ম এবং ঈশ্বরের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন তখন সেই বিচারপতি এবং বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।
ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ ভারতীয় বিচারব্যবস্থা। সেই বিচারব্যবস্থার যিনি মাথা অর্থাৎ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি, তাঁর প্রতিটি বক্তব্য, প্রতিটি রায়, তাঁর সমস্ত আচরণ দিয়েই ভারতীয় বিচারব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রের উন্নতি বা অবনতির মূল্যায়ন করা হয় সাধারণত। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পাঁচ সদস্যের একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ, শতাব্দী প্রাচীন অযোধ্যা মামলার রায় দেয়। ওই রায়ের পরেই অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয়। সেই বেঞ্চের অন্যতম একজন সদস্য ছিলেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। আগামী ১০ নভেম্বর তিনি অবসর গ্রহণ করবেন। তার প্রাক্কালে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছেন, যে সময়ে অযোধ্যা মামলা চলছিল, সেই সময় তিনি রোজ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন, যাতে ঈশ্বর অযোধ্যা মামলার রায়ের ক্ষেত্রে তাঁর পথপ্রদর্শক হন। এই বক্তব্য কি ভারতীয় বিচারব্যবস্থাকে আরও একবার ভুলুণ্ঠিত করার শামিল নয়?
ভারতীয় বিচারব্যবস্থা দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারতীয় সংবিধানের উপর। সেই সংবিধানে কোথাও বলা নেই যে কোনও মানুষ ব্যক্তিগত ধর্মাচারণ করতে পারবেন না। কিন্তু একজন প্রধান বিচারপতি যখন কোনও রায়ের ক্ষেত্রে সংবিধানের পরিবর্তে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের কথা, ব্যক্তিগত ধর্ম এবং ঈশ্বরের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন তখন সেই বিচারপতি এবং বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। বিচারপতি চন্দ্রচূড় ঠিক কী বলেছেন যা নিয়ে এই বিতর্ক? অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়েছিল তাঁর সম্বর্ধনা উপলক্ষ্যেই, আর সেখানেই তিনি বলেন, জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যখন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ঈশ্বরই একমাত্র পথপ্রদর্শক হতে পারেন। তিনি আরও জানান যে তিনি রোজই ঈশ্বরের সামনে বসেন কিন্তু অযোধ্যা মামলা চলাকালীন তিনি রাস্তা খোঁজার জন্যই প্রার্থনা করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকে, তাহলে যে কোনও সমস্যা থেকে পরিত্রাণের রাস্তা পাওয়া সম্ভব।
আরও পড়ুন- ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের গণেশপুজোয় মোদি! ভারতের প্রধান বিচারপতি আদৌ নিরপেক্ষ?
চন্দ্রচূড়ের এই কথার প্রেক্ষিতে বেশ কিছু প্রশ্ন ওঠে। তিনি ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে তাঁর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন কিন্তু তিনি যদি হিন্দু না হয়ে অন্য কোনও ধর্মে বিশ্বাস করতেন, তাহলে কি তাঁর আরাধ্য দেবতা তাঁকে একইরকম রায় দিতে উৎসাহ দিতেন? সম্ভবত বিচারপতি চন্দ্রচূড় বিস্মৃত হয়েছেন তাঁর শপথ বাক্যের কথা। তিনি ঈশ্বরের নামে শপথ নেননি এবং সম্ভবত কোনও বিচারপতিই তা করতে পারেন না। বিচারপতিকে শপথ নিতে হয় যে, সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করবেন। কোনও ভয় বা আনুকূল্যের জন্য তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকবেন না। সেই সংবিধান কখনই একটি বিশেষ ধর্ম অনুশীলনের কথা বলে না। সংবিধান বলে, প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত ধর্মাচারণের অধিকার থাকলেও, রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম নেই। সেই অর্থে বলতে গেলে, দেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি যখন সর্বসমক্ষে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার কথা বলেছেন, তখন তিনি ভুলই করেছেন। আগেও অবশ্য এইরকম ‘ভুল’ তিনি করেছেন এবং যত তাঁর অবসর এগিয়ে আসছে এই ভুলের প্রবণতাও যেন বাড়ছে।
যে রামমন্দিরের রায় নিয়ে তিনি এত উদ্বেল ছিলেন, সেই রামমন্দিরের উদ্বোধনের দিনে তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বহুবার তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়টিকে সবার সামনে নিয়ে এসেছেন। কখনও গুজরাতের সোমনাথ মন্দির দর্শন করতে গেছেন, কখনও তাঁর বাড়িতে গণেশ পুজোর আরতিতে খোদ প্রধানমন্ত্রীর পাশে তাঁকে দেখা গেছে। তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারংবার।
অবশ্য শুধু বিচারপতি চন্দ্রচূড়কে দোষ দিয়েই বা কী লাভ? ওই মামলায় যাঁরা রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ওই রায়ের পরে একটা ছবি সামাজিক মাধ্যমে এবং গণমাধ্যমে ছেয়ে গিয়েছিল। সমস্ত বিচারপতিরা হাতে হাত রেখে ছবি তুলেছিলেন। দেখাতে চেয়েছিলেন, তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রায় দিয়েছেন। সেই ঐক্যবদ্ধ ছবি থেকে পরবর্তীতে আমরা কী পেয়েছি মনে করতে পারলেই ছবির আসল অর্থ বোঝা যাবে।
আরও পড়ুন- অবসরের মুখে ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, কে হতে পারেন দেশের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি?
ওই মামলার পাঁচজন বিচারপতির একজন পরে রাজ্যপাল হয়েছিলেন। আরেকজন সরাসরি রাজ্যসভার সদস্য হন। তৃতীয়জনকে আইন সংক্রান্ত একটি সংস্থার প্রধান করা হয় আর সর্বশেষতম, যিনি এখন প্রধান বিচারপতি তিনি অপেক্ষা করছেন, কখন তাঁকে পুরস্কার পদ দেওয়া হবে। সমস্যা এখানেই! একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দিয়ে যদি এইরকম পুরস্কার পাওয়া যায়, তখন কেই বা বিরোধিতা করার সাহস দেখিয়ে বিচারপতি লোয়া হতে চাইবেন? অন্যান্য বহু মামলায় কোনও কোনও বিচারপতি কখনও সখনও বিরোধী মতামত রাখেন কিন্তু অযোধ্যা মামলার ক্ষেত্রে কোনও বিরোধী মতামত দেওয়ার সাহসটুকুও কেউ দেখাননি। কোনও বিচারপতি যখন নিজে মুখে স্বীকার
করেন যে, আইনি সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি সংবিধানের পরিবর্তে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়েছেন, তখন কি ভারতীয় গণতন্ত্রের থেকে কোনও আশা অবশিষ্ট থাকে?
আশা থাকে কিনা, তা বড় কথা নয়। বড় কথা এটাই যে, প্রধান বিচারপতি নিজে হয়ে উঠতে পারতেন ভারতীয় গণতন্ত্রের রক্ষার অন্যতম কাণ্ডারী। তিনি নিজেই যখন আশাভঙ্গ করেন তখন অনেক প্রশ্ন সামনে আসে। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় কিন্তু আধারের রায়ের সময়ে বিরোধী রায় দিয়েছিলেন। এই বিচারপতিই কিন্তু নির্বাচনী বন্ড বাতিলের ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। যদিও সেই রায়ের পরে, কে বা কারা
নির্বাচনী বন্ড নিয়ে লাভবান হয়েছে, সেই মামলা খারিজ করে দিয়েছেন তিনি কিন্তু নির্বাচনী বন্ডের মতো একটি অস্বচ্ছ টাকা তোলার পদ্ধতি বাতিল হয়েছে অবশেষে। আসলে সমস্যা অন্যত্র। সরকারের তরফ থেকে যে কোনও বিচারপতিকে তাঁর নিজস্বতা, স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য কখনও হয় চাপ দেওয়া হয়, কখনও আবার বন্ধুত্বের বার্তা দেওয়া হয়। সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার না করলে বিচারপতি লোয়া হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহনলাল সিনহার মতো মেরুদণ্ড ক'জনেরই বা থাকে! ১৯৭৫ সালের ১২ জুন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে নির্বাচনী অস্বচ্ছতার জন্য কারাগারে নিক্ষেপ করতে পেরেছিলেন তো তিনিই।