দিনের আলোয় শিল্প ‘চুরি’! যেসব প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে দেবজ্যোতি মিশ্রের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ
Debojyoti Mishra: তথ্য বলছে, ছবিটি আসলে আঁকা ইতালীয় চিত্রশিল্পী জিওভান্নি বলদিনির। কিন্তু সম্প্রতি ছবিটি ফেসবুকে নিজের ওয়ালে নিজের নামে পোস্ট করেন প্রখ্যাত সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র।
জীবনানন্দ বলেছিলেন, "সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।" ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও বোধহয় এ কথা একশো শতাংশ সত্য। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছে একটি ছবি ঘিরে। তথ্য বলছে, ছবিটি আসলে আঁকা ইতালীয় চিত্রশিল্পী জিওভান্নি বলদিনির। বিখ্যাত চিত্রকর্মটির নাম ‘আ পাথ থ্রু ট্রিজ় ইন দ্য বোয়া দে বোলোনে’। কিন্তু সম্প্রতি ছবিটি ফেসবুকে নিজের ওয়ালে পোস্ট করেন প্রখ্যাত সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র। পরিবেশ দিবসের কথা মাথায় রেখে প্রকৃতি বাঁচানোর বার্তা ছিল সেই পোস্টে। তবে তার পাশাপাশি ছবিটি নিজের আঁকা বলে দাবি করে বসেন শিল্পী। আর তাতেই শুরু হয় গন্ডগোল। শিল্পীর বিরুদ্ধে ওঠে বড়সড় কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ।
মুহূর্তে পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়া। অনেকেই অবশ্য না জেনে না বুঝে শিল্পীর আঁকার গুণের কদরও করে বসেন। পোস্ট ভাসতে থাকে প্রশংসায়। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না সেই ঢেউ। তার আগেই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে শুরু হয় নিন্দার ঝড়। ততক্ষণে জানাজানি হয়ে গিয়েছে, ছবিটি দেবজ্যোতি মিশ্রের নয়, বরং বিখ্যাত ইতালীয় চিত্রকর জিওভান্নি বলদিনির। পোস্টে দেবজ্যোতিবাবু লেখেন, ‘‘জল রং আর ওয়াশে সবুজ এঁকে ফেলা যায়...ফেললামও। তার পর! সবুজ বনবীথিকা রক্ষার জন্য কী করছি আমরা!!’’ সেই পোস্ট ঘিরেই শুরু হয় হইচই। ছবির কমেন্টবক্স ভরে ওঠে বিরূপ মন্তব্যে। কার্যত ফেসবুক জুড়েই শুরু হয় ছবিচুরি ঘিরে নিন্দার ঝড়। কোনও একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী কোনও চিত্রকরের আঁকা ছবি পোস্ট করতেই পারেন। কিন্তু কেন ছবি থেকে চিত্রশিল্পীর সইটি কৌশলে কেটে বাদ দেওয়া হল, সেই নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। পোস্টে ছবিটি তিনিই এঁকেছেন বলে দাবিও করেছেন দেবজ্যোতিবাবু। আর সেখান থেকেই শুরু সমস্যার।
আরও পড়ুন: সত্যজিতের চিত্রনাট্য সত্যিই কি চুরি করেছিলেন স্পিলবার্গ?
ফেসবুক ইউজারদের অনেকেরই অভিযোগ, এই প্রথম নয়। এর আগেও খ্যাত-অখ্যাত বহু শিল্পীর ছবি এই ভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন দেবজ্যোতিবাবু। সেই সব কটি ছবি থেকেই কৌশলে ওয়াটারমার্ক বা চিত্রশিল্পীর সই করা অংশটি কেটে বাদ দিয়েছেন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর ছবিগুলি পোস্ট করার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ জাগে। সুরকার, সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে যথেষ্ট পরিচিত নাম দেবজ্যোতি মিশ্র। সঙ্গীতশ্রষ্টা হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে তাঁর। তবে এই ছবি-কাণ্ডের পর নেটিজেনরা প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁর সুরসৃষ্টি নিয়েও। সেগুলোও আদৌ তাঁর নিজের সৃষ্টি কিনা সে নিয়েও উঠে গিয়েছে সওয়াল।
চিত্রশিল্পী হিসেবে সাম্প্রতিক কালে বাজারে বেশ নামডাক হয়েছে দেবজ্যোতি মিশ্রের। ইতিমধ্যেই তাঁর ছবি ঘিরে বেশ কয়েকটি প্রদর্শনীও হয়ে গিয়েছে। ২০১২ সালে কলকাতায় দু'টি একক প্রদর্শনী হয় তাঁর ছবির। লকডাউন পর্বেও নিজের আঁকা ছবির প্রদর্শনী করেছিলেন তিনি। গত বছর তাঁর আঁকা ছবি নিয়ে সেরাম থ্যালাসেমিয়া প্রিভেনশন ফেডারেশনের উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছিল ক্যালেন্ডারও। নিজেকে একাধিক বার পেশাদার শিল্পী হিসেবে পরিচয় দেওয়া দেবজ্যোতিবাবু এত বড় ভুল কী ভাবে করলেন তবে?
বৃহস্পতিবার ফেসবুকে দেবজ্যোতিবাবুর ছবি নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধতেই রাতারাতি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পোস্টটি উড়িয়ে দেন শিল্পী। তার বদলে আসে একটা সাফাই-পোস্ট। যেখানে শিল্পী এই ভুলের গোটা দোষটাই চাপিয়েছেন নিজের সহযোগী ইন্টার্নের উপরে। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর দলের এক সদস্য ভুল করে ছবিটি পোস্ট করেছেন। বিষয়টি জানতে পেরেই তিনি পদক্ষেপ করেন। তিনি আরও লেখেন, “বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবির সঙ্গে আমার আঁকা ছবিগুলোও একই ফোল্ডারে রাখা ছিল। আমাকে বিষয়টি নিয়ে অবগত করার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।” ঘটনাচক্রে এই পোস্টটির সঙ্গে একটি ছবি পোস্ট করেন দেবজ্যোতিবাবু। সেটি থেকে অবশ্য কৌশলে শিল্পীর সইটি কেটে ফেলা হয়নি।
অনেকেরই দাবি, এটিও দেবজ্যোতি মিশ্রের আঁকা নয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পোস্টের কমেন্ট বক্স বন্ধ করে দেন দিবজ্যোতি মিশ্র। পরে একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, বহু ক্ষেত্রেই বহু নামী শিল্পীর ছবি দেখে মকশো করেন তিনি। যাতে তাঁর আঁকা ছবির মান বাড়ে।
চিত্রশিল্পী দেবজ্যোতি মিশ্রের আঁকা ছবি ও তাঁর প্রদর্শনী নিয়ে একাধিক সংবাদমাধ্য়মে একাধিক লেখালিখি হয়েছে। ভুয়সী প্রশংসা হয়েছে তাঁর ছবির। ফেসবুকে এই ছবি কেলেঙ্কারির পর সেগুলির সত্যতা সম্পর্কেও স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। দেবজ্যোতিবাবুর চিত্রপ্রদর্শনীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি পিআর সংস্থার যোগাযোগ রয়েছে বলেও অভিযোগ। ইন্টারনেটে খুঁজলে দেবজ্যোতিবাবুর একটি ওয়েবসাইটের খোঁজ মেলে। যেখানে তাঁর কাজকর্ম নিয়ে খুঁটিনাটি তথ্যের সঙ্গে রয়েছে পেন্টিং বলে একটি বিভাগ, যেখানে গেলে শিল্পীর আঁকা বেশ কিছু ছবি দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে আপলোড করা বেশিরভাগ ছবিই দেবজ্য়োতিবাবুর সই করা। তাঁর বহু ছবিতেই বহু বিখ্যাত শিল্পীর প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে হলদে কাগজে এক কালিতে আঁকা একটি ছবি নিয়ে। যেখানে এক ব্যক্তিকে পিয়ানো বাজাতে দেখা যাচ্ছে।
একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, ছবিটিতে চিত্রশিল্পীর সইটি বাকি ছবির সঙ্গে মেলে না। এবং তাঁর তলায় যে সময়টি লেখা রয়েছে সেটি ১৯১৩। যে সময় দেবজ্যোতিবাবু জন্মগ্রহণও করেননি। ওই ছবিটি আসলে ফরাসি শিল্পী জঁ মরিস ইউজিন ক্ল্যেমেন্ত ককতোর আঁকা একটি কার্টুন। সেই ছবিটি দেবজ্যোতিবাবুর আঁকার ভিড়ে কী করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বৈকি।
আরও পড়ুন:রুদ্ধশ্বাস! যেভাবে গোয়েন্দারা উদ্ধার করলেন ভ্যান গগের চুরি যাওয়া ছবি
কিছুদিন আগেই খাস কলকাতার একটি বেসরকারি আর্ট গ্যালারিতে নন্দলাল বসুর জাল ছবির প্রদর্শনী নিয়ে বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল। তার পরেই দেবজ্যোতিবাবুর ফেসবুক পোস্ট বিতর্কে ফের উস্কে উঠেছে জাল ছবি নিয়ে উদ্বেগ। অভিযোগ উঠেছে এর আগেও একাধিক অন্য শিল্পীর ছবিকে নিজের আঁকা বলে পোস্ট করেছেন তিনি। ফেসবুক ইউজারদের কেউ কেউ একে মানসিক বিকৃতি বলেই উল্লেখ করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় জমানায় এমন কাজকর্ম হামেশাই হতে থাকে। অন্যের ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টিকে নিজের বলে চালিয়ে দেন অনেকেই, বিন্দুমাত্র ঋণস্বীকার না করেই। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ধরা পড়ে যাওয়ার সুযোগ বহু জানার পরেও তাঁরা সেই কাজটি করেন এবং বুক ফুলিয়ে ঘোরেন। চালিয়ে যান কুম্ভীলকবৃত্তি। অনেকেই তোপ দেগেছেন এই ধরনের কাজকে সরাসরি চুরি বলে। সত্যিই কি চুরির মানসিকতার সঙ্গে যোগ রয়েছে এই কাজের। এর নেপথ্যে আসলে কাজ করে কোন মনস্তত্ত্ব? এর সঙ্গে কি আদৌ রয়েছে ক্লেপটোম্যানিয়া বা চৌর্যোন্মাদবৃত্তির সম্পর্ক? একাধিক প্রশ্ন উঠে গিয়েছে এই ঘটনায়।