গালাগাল হইতে সাবধান
International Mother Language Day : রেগে গিয়ে শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা বলার আগে দু-বার ভাববে।
স্থির করেছি রূপচাঁদকে বাংলা শেখানোর চেষ্টা এবার বন্ধ করে দেব। এ চেষ্টা কেন বন্ধ করে দেব তার একটা কারণ হল এই, কাউকেই কিছু পুরোটা শেখানো যায় না, শুধু শেখার ইচ্ছেটুকু জাগিয়ে দেওয়া যায় মাত্র। রূপচাঁদের মনে সে ইচ্ছে জাগিয়ে দেওয়া গেছে যখন তখন এবার চুপ করার সময় এসেছে।
চুপ করার আগে আজ বাংলা ভাষায় ‘গালাগাল’ নিয়ে একটা-দুটো কথা বলে যাই। ইদানীং খেয়াল করে দেখেছি রাজনীতিবিদ, কবি, পণ্ডিত সকলেই মাঝে-মাঝে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং গালাগালকেই প্রতিবাদের ভাষা বলে মনে করেন। এমনিতে ‘গালাগাল’ কে দিচ্ছেন সেটা খেয়াল করার মতো বিষয়। ক্ষমতার কে কোন স্তরে আছেন তার উপরে গালাগালের শক্তি নির্ভর করে। যিনি গালাগাল দিচ্ছেন তিনি তাঁর অবস্থান, ক্ষমতার স্তরে তাঁর অবস্থান, অনেক সময় খেয়াল করেন না। আবার আমরা অনেক সময় অসচেতনভাবে এমন শব্দ ব্যবহার করি যা আমাদের মতে নির্দোষ শব্দ। গালাগাল নয় বলেই মনে হচ্ছে অথচ খেয়াল করলে দেখা যাবে তা গালাগালের চাইতেও মারাত্মক।
আগে তেমন কয়েকটি শব্দ বাক্যে প্রয়োগ করে দেখাই:
১। রাজনৈতিক চুরি-চামারি বন্ধ করা দরকার।
সন্দেহ নেই রাজনৈতিক চুরি বন্ধ করা কর্তব্য। চোরে ছেয়ে গেছে। যে কোনও বর্ণ-ধর্ম-বৃত্তির মানুষ চুরি করলে চুরি। চোরের শাস্তিও বিধেয়। তাই বলে চুরি-চামারি? অনুপ্রাস অলঙ্কার, ‘চ’-এর অনুপ্রাস। শুনতেও বেশ। কিন্তু অত্যন্ত অভদ্র এই প্রয়োগ। চামার শব্দটি এসেছে চর্মকার থেকে। সেই বৃত্তি-নির্বাহ করে যাঁরা পেট চালাতেন উচ্চবর্ণের মানুষেরা তাঁদের ছোট করতেন। এ-তো বর্ণাশ্রমের কুফল। প্রশ্ন হল এই চর্মকার বা চামাররা যে জরুরি কাজটি করতেন সেই কাজটির সঙ্গে যুক্ত সমস্ত মানুষদের চোর বলে দেগে দেওয়া অন্যায়, অপরাধ। অপহারক যিনি তিনি চোর। চামার একটি বৃত্তিলগ্ন জনগোষ্ঠীর পরিচয়। তাঁরা অসৎ মানুষ কেন হবেন? চামার-এর প্রতিশব্দ হিসেবে অভিধানে লেখা হয় চর্মকার, মুচি, হৃদয়হীন, নীচাশয়, কৃপণ। প্রথম দু'টি প্রতিশব্দ বৃত্তির সূচক, পরের প্রতিশব্দগুলি সামগ্রিকভাবে বিশেষবৃত্তির সবাইকে যেন হীন বলে চিহ্নিত করছে। পুরুতদের মধ্যে অনেকেই ঠগবাজ। অভিধানে পুরোহিত থেকে তৈরি হয়ে ওঠা পুরুত শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ঠগবাজ শব্দটি ঢুকে পড়েনি। বর্ণাশ্রমের মহিমা সন্দেহ নেই। তাই সবিনয় নিবেদন চোর লিখুন, চুরি করা বলুন কিন্তু চুরি-চামারি করা বলবেন না।
আরও পড়ুন- রামপাঁঠা, রাম ছাগল বোকারাম, হাঁদারাম বললে কি রামের অপমান হয়?
২। ‘জমীদারদিগের দ্বারা অনেক সৎকার্য অনুষ্ঠিত হইতেছে। গ্রামে গ্রামে যে এক্ষণে বিদ্যালয় সংস্থাপিত হইতেছে, আপামর সাধারণ সকলেই যে আপন আপন গ্রামে বসিয়া বিদ্যোপার্জন করিতেছে, ইহা জমীদারদিগের গুণে।’
এ-বাক্যটি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সাম্য’ নামের লেখা থেকে উদ্ধার করলাম। বঙ্কিমচন্দ্র জমিদারদের গুণ গেয়েছিলেন বলে অনেকেই বঙ্কিমকে নিয়ে পরিহাস করেছিলেন। জানিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র জমিদারদের দলে, ডেপুটি বঙ্কিম শ্রেণিস্বার্থ অতিক্রম করতে পারেননি। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। অভিধানে ‘আপামর’ শব্দের অর্থ ‘পামর হইতে সাধারণ লোক’। পামর শব্দের অর্থ হীন, নীচ, অধম, দুর্বৃত্ত। আ এই উপসর্গটি আমরা অন্যত্রও প্রয়োগ করি। যেমন আজানুলম্বিত, আসমুদ্রহিমাচল। এখানে বঙ্কিমচন্দ্র আপামর সাধারণ প্রয়োগ করেছেন। তবে মনের কিন্তু-কিন্তু ভাব থেকেই যাচ্ছে। সাধারণের আগে বিশেষণ হিসেবে ‘পামর’ শব্দটিকে উপসর্গ যোগে ‘আপামর’ করার সময় সাধারণকে একটু খাটো যে করা হচ্ছে তা যেন অস্বীকার করার উপায় নেই। জমিদাররা কত ভাল। তাদের স্কুলে পামরদেরও স্থান হয়। জমিদার করুণাময়। তাই সাধারণ পামরদেরও স্কুলে আসতে দিচ্ছেন। বঙ্কিমের এ-বাক্যটি লেখার আগে একবার ভাবা উচিত ছিল। আপামর শব্দটি বাদ দিয়ে ‘সাধারণ সকলেই’ লিখলে কিছু সমস্যা ছিল না। প্রোলেতারিয়েত মাত্রেই কি লুম্পেন? বলা যাবে না তা। বলা উচিতও নয় । মার্ক্স ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে Lumpenproletariat শব্দবন্ধটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। সুতরাং বঙ্কিম যাই লিখুন ‘আপামর’ লিখে সাধারণ মানুষকে চিহ্নিত না-করাই ভালো।
৩। তোর মতো আকাট দুটো দেখিনি।
শুধু সেকালের নয়, একালের মাস্টারমশাইরা অনেক সময় পড়ুয়াদের বলেন। আকাট শব্দের অর্থ অসংবেদনশীল। আকাট মানে রসহীন। অনেক সময় সন্তানহীন নারীকে গঞ্জনা দেওয়ার জন্য শব্দটি ব্যবহার করা হত। অভিধানে হস্তিমূর্খ শব্দটিও রয়েছে। হাতিরা নিতান্ত বাংলা পড়তে জানে না। না-হলে বডি-শেমিং-এর অভিযোগ আনত। হাতির মতো মূর্খ। হাতির মতো বড়, প্রকাণ্ড মূর্খ। মাস্টারমশাইরা যাঁরা গালাগাল দেন তাঁরা অধিকাংশই অসংবেদনশীল। মানুষ ছাড়া পশু-পাখিদের নাম তাঁরা গালাগাল দেওয়ার সময় প্রয়োগ করেন। যেমন আমার এক মাস্টারমশাই ছাত্রকে গাড়ল বলেছিলেন। গড্ডল থেকে এসেছে। বিবেচনাহীনভাবে আগেরজনকে অর্থাৎ আগের ভেড়াকে নাকি পরের ভেড়ারা অনুসরণ করে। সেটা বোঝাতেই তিনি গাড়ল বলেছিলেন। নরম মেষ-শাবকগুলির জন্য মন কেমন করল ছাত্রের। আমি তাই রূপচাঁদকে কতগুলি বাক্য লিখতে নিষেধ করেছি।
আরও পড়ুন- ফেসবুকে বাংলা লেখেন? যে যে বানানগুলি ভুল করছেন রোজ…
রেগে গিয়ে শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা বলার আগে দু-বার ভাববে।
তিনি বিচলিত হয়ে কুঁই কুঁই করতে লাগলেন এই বাক্য লেখার আগে ভাবা দরকার।
মাস্টারমশাইরা ক্ষমতার বিশেষ চেয়ারে বসে থেকে ছাত্রদের উপর যখন বাক্য-বর্ষণ করেন তখন তা প্রতিবাদ নয়। আবার একইভাবে কোনও প্রতিবাদী ছাত্র কোনও শিক্ষককে যখন ‘গালাগাল’ দেন তখন তিনিও ক্ষমতার জুতোতে নিজের অজান্তে পা গলিয়ে দিচ্ছেন।
ক্ষমতা অতি ধূর্ত নিরাবয়ব পিচ্ছিল একটি বস্তু, যেখানে আধার পায় সেখানেই ঢুকে পড়ে। কখনও ছাত্রের স্বরে, কখনও শিক্ষকের। এমনকী ক্ষমতা ঢুকে পড়ে হিতবাদী বঙ্কিমের কলমেও। সাধারণের ভালো করতে চেয়ে তিনি তাঁদের ‘পামর’ বলে ডেকে ফেলেন।
সুতরাং, গালাগাল হইতে সাবধান। গালাগাল ক্ষমতার আধার। প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেই ক্ষমতার আধারে কে যে কখন জেনে কিম্বা না-জেনে ঢুকে পড়ছে!
বাংলা শেখানোর ক্লাস থেকে বাইরে এলাম। রূপচাঁদ খেলতে গেল। রাস্তার বাচ্চা কুকুরটি আমার কাছে আসতেই কোলে নিলাম। আমরা দু-জনে কুঁই-কুঁই করতে করতে পরস্পরের প্রতি আদর প্রকাশ করতে শুরু করেছি। এ পৃথিবী শুধু মানুষের নয়, কুকুরেরও। এ পৃথিবী মেষ ও মেষ-শাবকদেরও।