এক কাপ চায়েই ঘুম ভাঙছে বাঙালির, কিন্তু জানেন কি কাপ-প্লেট-ট্রে-এর বাংলা প্রতিশব্দ?

Bengali Language : বিট্রিশ আমলে চা প্রবেশ করে বাংলায়। তারপর সময়ের সঙ্গে তাদের হাত থেকেই চা ঢুকে পড়ে বাঙালির অন্দরে। আর এই চায়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়ে ইংরেজদের ব্যবহৃত কাপ, প্লেট, ট্রে ইত্যাদি জিনিস।

ঘুম থেকে উঠেই ধূমায়িত চায়ের দিকে চোখ পড়তেই শীতের চাদর ছাড়েন অনেকেই। ধরা যাক, ঠিক এরকম সময় হঠাৎ উপস্থিত বিদ্যাসাগর মহাশয়। আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করলেন এই যে কাপ প্লেটে করে চা খাচ্ছেন, এই কাপ প্লেটের বাংলা কী বলুন তো? ব্যাস পড়লেন মহা বিপদে! মাথা চুলকে কিছুতেই মনে করতে পারছেন না বাংলা প্রতিশব্দ! বারবার মনে হচ্ছে এটাই তো বাংলা। ইতিমধ্যে ধূমায়িত চা জুড়িয়ে জল হয়ে গেল কিন্তু মীমাংসা হল না কিছুই।

বাংলার এমন অবক্ষয়ের দোষ অবশ্য কোনও একজন ব্যক্তির নয়। ঠিক কবে থেকে কীভাবে যে হারাতে বসল বাংলা শব্দ তার হিসেব কষা মুশকিল। কিন্তু এ কথা খুব সত্যি যে, এমন অনেক কাপ প্লেট এবং ট্রে এর মতো অনেক ইংরেজি শব্দই ব্যবহারিক জীবনে এমনভাবে চেপে বসেছে যে তার থেকে পালানো মুশকিল। উপরন্তু কেউ যদি আসল বাংলা শব্দটা বলে বসেন সেটাই বোধগম্য হবে না অনেক ক্ষেত্রে। শুধু ব্যবহারিক জীবন তো নয়, সাহিত্যের ভাষাতেও এই ইংরেজি শব্দগুলিই বাংলা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।

আরও পড়ুন - ভাষার মারপ্যাঁচে গলদঘর্ম বাঙালির! জানেন কি চেয়ার-টেবিলের বাংলা প্রতিশব্দ?

‘বাংলা ঠিক আসে না’ আজকাল অনেকেরই। চলতে ফিরতে ইংরেজি বলাই দস্তুর। আধুনিকতায় পাল্লা দিতে দিতে সব থেকে বেশি মার খেল যারা তার মধ্যে সর্বাগ্রে আসে ভাষার নাম। সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করা দিয়েই এই জার্নিটা শুরু হয়ে যায়। বকৃতাম সময়ে যখন চাকরি নিয়ে এত এত দুর্নীতি তখন আরও বেশি করে ভয় চেপে বসে। ইংরেজি বলতে পারলেই ভবিষ্যত বদলাবে এমনটা ভেবে বসতে বাধ্য হয় বর্তমান প্রজন্ম।

যাই হোক, কাপ প্লেট ট্রের বাংলাটা এবার অন্তত জানিয়ে দেওয়া উচিৎ। পুরনো কিছু সাহিত্যের বই ঘাঁটলে কাপের বদলে ‘পেয়ালা’ শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করবেন অনেকেই, তবে প্লেটের বদলে ‘পিরিচ’ শব্দটি অনেকদিনই অস্তাচলে। নিমন্ত্রণ বাড়িতে রান্নার ঠাকুরদের কথায় কান পাতলে এখনও শুনবেন ‘ট্রে’ বদলে ‘রেকাবি’ বলছেন কেউ কেউ। কিন্তু রোজকার জীবনে এই শব্দগুলির ব্যবহার একেবারেই লক্ষ্য করা যায় না আর। তাই হয় তো কবির সুমনও তাঁর গানে এক ‘পেয়ালা’ চায়ে প্রেমিকাকে খুঁজতে ভয় পান। বরং এক ‘কাপ’ চায়েই নিশ্চিন্ত।

আরও পড়ুন - অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় বসে ‘ম্যাজিক’ শুরু, যেভাবে তৈরি হল ‘নাটু নাটু’ গান

চা পানের অভ্যাসে যতোই অভ্যস্ত হয়ে পরিক বাঙালি, চা কিন্তু খোদ চীনা শব্দ। বিট্রিশ আমলে চা প্রবেশ করে বাংলায়। তারপর সময়ের সঙ্গে তাদের হাত থেকেই চা ঢুকে পড়ে বাঙালির অন্দরে। আর এই চায়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়ে ইংরেজদের ব্যবহৃত কাপ, প্লেট, ট্রে ইত্যাদি জিনিস। বাংলায় অবশ্য এর অনেক আগে থেকে পেয়ালা, পিরিচ অথবা রেকাবি শব্দের চল। রান্নাঘরের বাসনের ভিড়ে এসব খুবই পরিচিত জিনিস। একটু বড় মাপের ট্রে হলেক্টাকে বারকোশ বল হয়। যদিও এই শব্দগুলিও বিদেশি শব্দভাণ্ডার থেকে প্রবেশ করেছে বাংলা অভিধানে।

ভাষা হল বহমান স্রোতের মতো। জীবনের নিয়ত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাষাও বদলে বদলে যায়। বদলে যায় ভাষা ব্যবহারের অভ্যাসও। পরিবেশ পরিস্থিতির দায়ও এক্ষেত্রে অনেকখানি। তবে যে কোনও ভাষাতেই অন্য ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এমন অনেক শব্দই অভিধানে যোগ হয় যা একেবারেই ভিন্ন ভাষার। বাংলাও ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন সময়ে যেসব দেশ এখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছেন তাদের বেশি কিছু শব্দও রেখে গিয়েছেন এখানে। ফরাসি, পর্তুগিজ, চিনা শব্দেরা প্রায়শই তাই ঘোরাফেরা করে আমাদের চোখের সামনে। অভিধানের নিয়মেই জায়গা করে নেয় তারা। কিন্তু ইংরেজির এই যে দাপট, তা একেবারেই আলাদা। আধুনিক হতে গিয়ে ভাষার ওপর যে ইংরেজি প্রভাব পড়ছে তাতে বাংলাভাষার চোখে জল আসে স্বাভাবিক। তাই কাপের বদলে পেয়ালায় চা পান করে হয় তো বদলাবে গোটা পরিস্থিতি। এর জন্য প্রয়োজন সার্বিক আলোচনার। প্রয়োজন বাংলা শব্দ ভান্ডার নিয়ে কথপোকথন। তবেই হয়তো কবির সুমনও বিশ্বাস নিয়ে এক পেয়ালা চায়েই হারানো প্রেমিকাকে ফিরে পেতে চাইবেন।

More Articles