১০ বছর ধরে একটি কফি মেশিনের দিকে তাক করা ছিল বিশ্বের প্রথম ওয়েবক্যাম! কেন?
Coffee Pot Webcam : ট্রোজান রুম কফি পট সত্যিই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের ইতিহাসে জায়গা করেছিল।
ওয়েবক্যাম। ভাগ্যিস ছিল, নাহলে কোভিডের সেই দিনগুলিতে একে অপরের সঙ্গে শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন থেকেও জুড়ে থাকা যেত না সামাজিকভাবে। একসঙ্গে অনলাইনে গেম খেলা যেত না। দূরবর্তী স্থানে থেকেও অফিসের মিটিং করা যেত না। আবার ওয়েবক্যাম আছে বলেই গোপনে আমাদের কে বা কারা দেখে যায় নিয়ত, জানতেও পারি না। আমাদের গোপনীয়তা, আমাদের নিভৃত সময়ে কারা সব কিছু দেখে ফেলে আড়ালে বসেই, বোঝা যায় না। অথচ ওয়েবক্যামের কাজ কিন্তু মোটেও ছিল না এমন। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, ওয়েবক্যাম আসলে তৈরি হয়েছিল কফি দেখার জন্য!
কফি আবার দেখার কী আছে? চায়ের সঙ্গেই বিকল্প হিসেবে আসে কফির নাম। অনেকেই কফির নেশায় পড়ে যান। কিন্তু কফিকে ওয়েবক্যামে দেখার কী আছে এত? এই গল্প লুকিয়ে আছে 'ট্রোজান রুম কফি পট’-এ। বিষয়টার শুরু ১৯৯১ সালে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব সবে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। কম্পিউটার বিজ্ঞানী কুয়েন্টিন স্ট্যাফোর্ড-ফ্রেসার, সহ গবেষক পল জার্ডেটস্কির সঙ্গে মিলে এই কফি পট ক্যাম তৈরি করেছিলেন।
আরও পড়ুন- সেলিব্রিটিদের পছন্দ, মল থেকে তৈরি এই কফির নেপথ্য ইতিহাস জানলে শিউরে উঠবেন
১৯৯৫ সালে লেখা আত্মজীবনীতে কুয়েন্টিন স্ট্যাফোর্ড-ফ্রেসার বলছেন, "আমি ট্রোজান রুম নামে পরিচিত কম্পিউটার ল্যাবের একটি অংশে এটিএম নেটওয়ার্কে কাজ করছিলাম। আমাদের মধ্যে প্রায় পনেরো জন সংশ্লিষ্ট গবেষণায় জড়িত ছিলাম। টাকাপয়সা ছিল না তেমন, গরিবই ছিলাম সবাই। ফলে আমাদের কেবল একটিই কফি ফিল্টার মেশিন ছিল, সেটি ট্রোজান রুমের ঠিক বাইরের করিডোরে থাকত।" সারাদিন গবেষণা ও কাজ করতে করতে বিরতিতে কফি যে কী গুরুত্বপূর্ণ পানীয় তা আর বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু কফি ফিল্টার মেশিন মাত্র একটা। ফলে সকলেই ওই একটিই কফি মেশিনের উপর চরম নির্ভরশীল। ফলে যা হওয়ার তাই, কিছু লোক কফি পায়, কিছুজনের ভাগ্যে লবডঙ্কা।
কিছু গবেষক ওই বিল্ডিংয়ের অন্যান্য অংশে থাকতেন। কফির মেশিন অবধি আসার জন্য বহু সিঁড়ি ওঠানামা করে ঝক্কি পোহাতে হতো। এসেও হয়তো দেখতেন কফি নেই। স্ট্যাফোর্ড-ফ্রেসার বলছেন, বিষয়টা মনে হতেই পারে কী এমন আর! অথচ কম্পিউটার বিজ্ঞানের পুরো ভবিষ্যতই ক্ষতির মুখে ছিল! কফির অভাব থেকেই XCoffee প্রোগ্রামটির জন্ম।
স্ট্যাফোর্ড-ফ্রেসার লিখছেন, “আমরা একটি ক্যামেরা স্ট্যান্ডে বসাই, করিডোরের কফি মেশিনের দিকে ক্যামেরার চোখ ঘুরিয়ে রাখি এবং ট্রোজান রুমের নীচ দিয়ে তারগুলি নিয়ে আসি। জারডেটস্কি তারপরে একটি 'সার্ভার' প্রোগ্রাম লেখেন। মেশিনে সেই প্রোগ্রাম চালানো হয় এবং বিভিন্ন রেজোলিউশনে প্রতি কয়েক সেকেন্ডে কফি পটের ছবি তোলা হতে থাকে। আমি একটি 'ক্লায়েন্ট' প্রোগ্রাম লিখেছিলাম, এই প্রোগ্রাম প্রত্যেকে চালাতে পারে। প্রোগ্রামটি সার্ভারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। কম্পিউটার স্ক্রিনের এক কোণে কফি পটের একটি আইকন দেখা যেত।"
আরও পড়ুন- সুফি সাধকদের রাতের ওষুধ! কীভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে জন্মাল বিশ্ববিখ্যাত কফি ‘মোকা’?
১৯৯৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ট্রোজান রুম কফি পট সত্যিই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের ইতিহাসে জায়গা করেছিল। মার্টিন জনসন ছিলে আরেক ক্যাফিনপ্রেমী কম্পিউটার বিজ্ঞানী। তবে কেমব্রিজের ইন্টারনাল সার্ভারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন না তিনি। ফলে এই XCoffee চালাতে পারেননি মার্টিন। প্রথম তিনিই প্রোগ্রামটি অনলাইন করে দেন।
২০১২ সালে বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে মার্টিন বলেন, যে ছবিগুলো তোলা হচ্ছিল সেগুলোকে নিয়ে একটি ছোট স্ক্রিপ্ট তৈরি করেন তিনি। প্রথম সংস্করণটি সম্ভবত মাত্র ১২ লাইনের কোড ছিল। ছবিটি মিনিটে প্রায় তিনবার আপডেট করা হয়। কফির পাত্রটি যেহেতু ধীরে ধীরে ভরত তাই এই প্রতি মিনিটে তিনবার হিসেবটা খুব কমও না। ছবিও ছিল কেবল গ্রেস্কেলে। তাও ঠিকই ছিল, কারণ কফির রঙও তেমনই। ট্রোজান রুম কফি পট ৯০-এর দশকের শুরুর দিকে ভাইরাল হয়ে যায়। সারা বিশ্বের মানুষই চাইলে কেমব্রিজের কফির অবস্থা দেখতে পেতেন।
এখন যদি দেখতে ইচ্ছে করে সেই কফির পাত্রটিকে? ওয়েবক্যামটি থেমে গিয়েছে। ২০০১ সালের ২২ অগাস্ট চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় এই সিস্টেমটি৷ সফটওয়্যারটির দেখভাল হচ্ছিল না একেবারেই। ট্রোজান রুম কফি পটটিও অনলাইনে নিলাম ডেকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ৪,০৯৫ ডলারে বিক্রি হয় সেই পাত্র।