মনের চিকিৎসার নামে ভয়াবহ ভাঁওতা, দেশজুড়ে নতুন মহামারী

Psychotherapist in India: মনের ডাক্তার। সে তো 'ইটালিয়ান' সেলুনের মতোই গজিয়ে গিয়েছে রাস্তার চতুর্দিকে। তাঁরা সকলেই কি মনোবিশেষজ্ঞ? নাকি মনের হাতুড়ে?

মনের কথা শোনার মতো পেশাদার 'সই'-এর অভাব নাই ভুবনে। 'সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।' কিন্তু থেরাপিস্ট এ ভুবনে প্রায় সকলেই। অর্থ ব্যয় করলে আপনার মনের দুঃখ, বেদনা, যতেক যাতনা শোনার লোকের অভাব পাবেন না ত্রিভুবনে। তবে মোড়ে মোড়ে অলিতে গলিতে গজিয়ে ওঠা ল্যাংচার দোকানের মতোই এই যে এত থেরাপিখানা, থেরাপিমহল বা থেরাপিভবন, তা কি আদৌ কাজের? আপনার মনের কথা শুনে সমস্যা মেটানোর মতো অভিজ্ঞতা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা তাদের আছে কি! প্রশ্ন জাগে বৈকি!

করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে যাহা কিছু অনলাইন, তাহাই 'নিউ নর্মাল'। ফলে এখন ভার্চুয়ালিই সারা হয়ে যায় সকল কাজ। দোকান, বাজার, অফিস, স্কুল থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত, সবই হয়ে যাচ্ছে ভার্চুয়ালি। ভার্চুয়াল বিশ্বে সুখে সংসার করছেন স্বামী-স্ত্রী। ভার্চুয়ালি প্রেম, ভার্চুয়ালি ঘর এমনকী যৌনতাও। এই তো বেশ কিছু দিন আগে ভার্চুয়াল চুমু খাওয়ার যন্ত্র আবিষ্কার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে চিনের একদল গবেষক। এত কিছু ভার্চুয়ালি হতে পারলে মনের কথা শোনার সই-ই বা মিলবে না কেন অনলাইনে। যার কেউ নেই, তাঁর গুগল আছে। অতএব ঢুকে পড়ুন ব্রাউজারে। খুঁজে নিন পছন্দের ভার্চুয়াল থেরাপিস্ট। যে আপনার হাতে ধরিয়ে দেবে জীবনে ভালো থাকার চাবিকাঠি।

আরও পড়ুন:গর্ভের মধ্যেই ভ্রূণের মাথায় বিরল অস্ত্রোপচার! চিকিৎসা জগতে শোরগোল ফেলল যে ঘটনা 

তবে শুনতে যতটা সহজ, জীবন ততটা নয়। এই মহিলার কথাই ধরুন না। গুয়াহাটির বাসিন্দা ৩৬ বছরের এই মহিলা হঠাৎ করেই বিয়ের একদিন আগে বাতিল করে দিলেন অনুষ্ঠান। অন্য কেউ নয়, নিজের মানসিক অবস্থাকেই দায়ী করলেন গোটাটার জন্য। আমরা কথায় কথায় বলে থাকি, শরীরের অসুস্থতায় চিকিৎসকের সাহায্য নিতে পারলে, মনের ক্ষেত্রে দোষটা কোথায়। সত্যিই কোনও দোষ নেই, বরং আজকের দিনে ভীষণ জরুরি এই পদক্ষেপটুকু। অন্তত সচেতনতাটুকু তো বটেই।

তবে মনের ডাক্তার। সে তো 'ইটালিয়ান' সেলুনের মতোই গজিয়ে গিয়েছে রাস্তার চতুর্দিকে। তাঁরা সকলেই কি মনোবিশেষজ্ঞ? নাকি মনের হাতুড়ে। গুয়াহাটির এই মহিলা কিন্তু দেরি না করে সাহায্য নিয়েছিলেন থেরাপিস্টের। কিন্তু তাঁর কাছে গিয়ে উপকারের বদলে অপকার হল বেশি। তাঁর মনের শুশ্রুষা তো দূরের, মন খুলে নিজের দুঃখের কথাই শোনাতে শুরু করলেন সেই বিশেষজ্ঞ। তাঁর প্রেম ভাঙার গল্প শুনতে শুনতে রোগীর ভাঙা মন ভেঙে গেল আরও। বিনামূল্যের চ্যাট সেশন যে এইভাবে তাঁর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলবে, তা বোধহয় দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তিনি।

আদতে একটু তাকিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, হঠাৎ করেই ভয়ঙ্কর রকমের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছে এই থেরাপিস্ট পেশাটির। কথায় বলে, অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী। ফলে সামান্য কিছু জ্ঞান নিয়ে যারা অন্যের মন সারানোর কাজে নামছেন, তারা আখেরে রোগীর বিপদটাই বাড়াচ্ছেন না তো! শরীরের ডাক্তারদের ক্ষেত্রে বেশ কিছু স্তর এবং ধাপ পেরিয়ে তবে রোগী দেখার ছাড়পত্র মেলে। তবে কাউন্সিলর বা থেরাপিস্ট, এই পেশাটির ক্ষেত্রে তেমন কড়াকড়ি নেই। মনোচিকিৎসক যাঁরা, তাঁরা রীতিমতো ডাক্তারি পড়ে এই পেশাটায় আসেন, কিন্তু এই সব কাউন্সিলর বা থেরাপিস্টদের সেই বালাই নেই। অনেকের ক্ষেত্রেই সেই ন্যূনতম পড়াশোনাটুকও নেই। প্রশিক্ষণ বা অন্য কিছু তো দূরের।

মানসিক সমস্যা, নানাবিধ মনের রোগ বোধহয় আমাদের বর্তমান সময়ের উপসর্গ বলা যায়। কাজের চাপ থেকে সম্পর্কের জটিলতা, গত কয়েক দশকে বেড়েছে কয়েক গুণ। ফলে তার যত্ন বা শুশ্রুষার ক্ষেত্রেও প্রয়োজন যত্নের। গুয়াহাটির ওই তরুণী জানান, তাঁর থেরাপিস্ট তাঁকে জানিয়েছিলেন, প্রেম ভাঙার পর তিনিও আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। এদিকে, আত্মহত্যার মতো শব্দ এই ধরনের সেশনে ব্যবহার ভয়ঙ্কর প্রমাণিত হতে পারে। তবে সেই জ্ঞান নেই এসব গজিয়ে ওঠা কাউন্সিলরদের মধ্যে। মজার ব্যাপার, ঠিক দু'দিন বাদেই ওই অনলাইন সাইটের তরফে একটি অফার এসে পৌঁছয় তরুণীর হাতে। কাউন্সিলর হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ।

জ্বর বা পেট ব্যথার রোগী হলেই যে সব ধরনের জ্বর বা পেট ব্যথার দাওয়াই তাঁর জানা থাকবে, এ কথা ভাবা যেমন হাস্যকর, ঠিক তেমনই এই প্রস্তাব। মনের অসুখ হেলাফেলার কোনও বিষয় নয়। শরীরের চেয়েও আরও কঠিন তার রোগ নির্ণয় এবং তার চেয়েও কঠিন তার চিকিৎসা। আর সে ক্ষেত্রে ছোট্ট একটা ভুলও কিন্তু হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতী।

ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, ফেসবুক-ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্ম মানুষের সামনে খুলে দিয়েছে অনন্ত সম্ভাবনা। যে সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে মানুষ এতদিন ভয় পেত, কুণ্ঠাবোধ করত, সোশ্যাল মিডিয়ায় সৌজন্যে তা-ও হয়ে উঠেছে অনেক সহজ। বহুদিন পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে চাইত না সমাজ। সেই ভয়, লজ্জা এবং ট্যাবু অনেকটাই কেটেছে সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে। তবে সব জিনিসেরই ভালো-খারাপ দুটো দিকই রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াও ব্যতিক্রম নয়। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এখন প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পথ অনেকটাই সহজ। তা সে ইউটিউবারই হোক, অভিনেতাই হোক বা থেরাপিস্ট। যাচাই করে নেওয়ার রাস্তা নেই বললেই চলে, অথচ চাকচিক্যে মানুষ আকর্ষিত হয় অনেক বেশি। আর সেই ফাঁকেই বাড়বাড়ন্ত বহু ছদ্ম থেরাপিস্টের। উচ্চমাধ্যমিকে পড়া সাইকোলজির জ্ঞান নিয়েই অনেকে বসে পড়ছেন কাউন্সেলিং করতে। এদিকে, সাইকোলজির গ্র্যাজুয়েট তো দূরের, পোস্ট গ্র্যাজুয়েটদের পর্যন্ত কাউন্সিলিং বা সাইকোথেরাপি করার অনুমতি দেয় না মেডিক্যাল বোর্ড। অথচ সেই ব্যাপারটাই চলছে রমরমিয়ে।

আরও পড়ুন: জন্মদিনে বন্ধুদের নিয়ে হইহুল্লোড়, তবুও ভুগছেন হতাশায়! কেন হয় এই ‘বার্থডে ডিপ্রেশন’?

২০২১ সালেই এ বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রক। আনা হয় ন্য়াশনাল কমিশন ফর অ্যালায়েড অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রফেশনস অ্যাক্ট নামে একটি আইনও। যার মাধ্য়মে নিশ্চিত করা হয়েছে, কতদূর পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ থাকলে কেউ মনের শুশ্রুষা করতে পারবেন। তবে আইন থাকলেও মানছে আর কে! তাই ফুলেফেঁপে উঠছে মনের হাতুড়েদের কারবার। আর বাইরের রংচঙ দেখে মজে যাচ্ছেন বিপদে পড়া মানুষও। নিজেদের মনের কথা খুলে বলে হালকা হচ্ছেন, কখনও কখনও ভুলভাল ওষুধ নিয়ে ফিরছেন। যা ব্যবহার করে ডুবে যাচ্ছেন আরও কোনও বিপদের অন্ধকারে। আসলে মনে কথা বলার 'সই' পেলেই তো হল না, সেই সই-য়ের গায়ে চিকিৎসা করার যোগ্য়তাছাপ লেবেল আছে কিনা তা-ও দেখে নেওয়া জরুরি। সব চকচকে জিনিসই তো আর সোনা হয় না!

More Articles