যৌনতার সঙ্গে নিবিড় যোগ! জানেন, কেন তৈরি হয়েছিল স্টিলেটো?
History of Stiletto: ব্লক হিল এবং প্ল্যাটফর্ম হিল গ্রিকদের সময় থেকেই পরা হতো কিন্তু পাতলা স্টিলেটো বিশ শতকের আবিষ্কার।
হাঁটা চলা হবে সহজ গতিতে। ফলে পায়ের উপর কোনও চাপ পড়া চলবে না। দৌড়ে বাস ধরো, গুঁতোগুঁতি করে মেট্রো চাপো, সাততলা সিঁড়ি ভাঙো! জুতো যদি মানানসই না হয়, হোঁচট খেয়ে, মুখ থুবড়ে দফা রফা। এত কিছু সত্ত্বেও মহিলাদের হিলপ্রেম কমে না। ফ্ল্যাট হিল না হয় তাও শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখল, তাবলে স্টিলেটো? ওরম পেনসিলের মতো সূঁচালো হিল পরে কীভাবে সম্ভব হাঁটাচলা? কীভাবেই বা সারা শরীরের ভার ধরা থাকবে ওই সরু কাঠির উপর? চল্লিশের দশকের শেষের দিকে এবং পঞ্চাশের দশকের শুরুতে জুতোশিল্পে প্রযুক্তিগত উন্নতির ফল এই স্টিলেটো। তারপর থেকে স্টিলেটো হয়ে উঠল মহিলাদের ফ্যাশনের এক অঙ্গ। আসলে যৌনতা ও নারী- বিষয়টি পালে হাওয়া পেল নানাভাবেই। সত্তরের দশকে চারদিকে কঠিন সমালোচনার মুখে পড়ল স্টিলেটো, মহিলাদের স্বাভাবিক চলাফেরার ক্ষমতাকে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠল এই জুতোর বিরুদ্ধে। আশির দশকে সেই স্টিলেটোই হয়ে উঠল নির্দিষ্ট গোত্রের কর্মজীবী মহিলাদের ব্যক্তিত্বের অংশ। তারপর থেকে স্টিলেটোকে আর ফ্যাশনের অংশ থেকে আলাদা করা যায়নি কখনই।
স্টিলেটো পরতেন পুরুষরা
উঁচু জুতো মানেই তা ঐতিহ্যগতভাবে আভিজাত্য, ক্ষমতা এবং সম্পদের প্রতীক। ১৬ শতকে ভেনিসের বড়লোক মহিলারা তাদের স্কার্টে যাতে কাদা না লাগে, সেই জন্য উঁচু জুতো পরতেন। ১৭ শতকে পশ্চিম এশিয়ায় ঘোড়ার পিঠে যুদ্ধরত সৈন্যরা হিল পরতেন যাতে তাদের পা নিরাপদ থাকে। ১৮ শতকে, ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুই তাঁর কর্তৃত্বের প্রতীক হিসাবে লাল হিল পরতেন। ১৮ শতকের শেষ অবধি লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলেই হিল পরতেন। তারপর থেকে ধীরে ধীরে মহিলাদের সৌন্দর্যের সঙ্গে জড়িয়ে যায় হিল বিষয়টি। পুরুষদের ক্ষেত্রে যেহেতু 'সৌন্দর্য' বিষয়টি তত গুরুত্বই পায়নি কখনও তাই ফ্যাশন বিষয়টি হয়ে ওঠে মহিলাদের একান্ত নিজস্ব। হিল ক্রমেই আরও উঁচু হয়ে ওঠে। মহিলারাও নিজেকে যৌনভাবে আকর্ষণীয় প্রমাণের দায় এড়াতে পারেন না কিছুতেই।
আরও পড়ুন- বিড়ালের চোখ হয়ে উঠল চশমা! যেভাবে জন্ম নিল ক্যাট আই গ্লাসেস
ক্ষুরধার হিলের জন্ম
ব্লক হিল এবং প্ল্যাটফর্ম হিল গ্রিকদের সময় থেকেই পরা হতো কিন্তু পাতলা স্টিলেটো বিশ শতকের আবিষ্কার। সূঁচালো এই স্টিলেটো নামটি আসে একটি ইতালিয় ছুরির নাম থেকে। ১৯৫০-এর দশকে বিমানবাহী জাহাজের নতুন উপকরণ এবং কৌশলগুলি জুতো নির্মাণেও প্রয়োগ করা হয়, তখন এই হিলের জন্ম। ধাতু এবং প্লাস্টিককে মেশানো হলো। ছাঁচনির্মাণ করে হিলকে লম্বা করা হলো আরও। উদ্দেশ্য ছিল পায়ের পাতাটিকে ধরে রাখার উপায় খুঁজে বের করা, পায়ের আঙ্গুল এবং গোড়ালি থেকে চাপ সরিয়ে নেওয়া।
স্টিলেটো সাধারণত এক থেকে পাঁচ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। ডিজাইনার সালভাতোর ফেরগামো, রজার ভিভিয়ের এবং আন্দ্রে পেরুগিয়া স্টিলেটো উদ্ভাবনের নেপথ্যে রয়েছেন। কিন্তু স্রষ্টার সৃষ্টিকে বাজারখ্যাত করলেন নায়িকারাই। ১৯৫০-এর দশকে, মেরিলিন মনরো চার ইঞ্চি ফেরাগামো স্টিলেটো পরে যে মোহময়ী চলনকে তুলে ধরলেন, তারপর থেকেই স্টিলেটোর খ্যাতিকে রোখা দায়! হলিউডের সিনেমায় একের পর এক নায়িকা বেছে নিলেন স্টিলেটোকে। সেলিব্রিটি ফ্যাশনে জুড়ে গেল হাই হিল! আসলে স্টিলেটো জুড়ে গেল মহিলাদের শরীরি আকর্ষণের সঙ্গে। মহিলাদের দেহসৌন্দর্যকে আরও গুছিয়ে সাজিয়ে দিল এই জুতো। স্টিলেটো পা-কে লম্বা করে এবং বুকের অংশকে সামনের দিকে এবং নিতম্বের ভারকে আরও পিছনের দিকে ঠেলে ভারসাম্য রাখে, যাতে মহিলাদের শরীরের নানা ভাঁজ আরও স্পষ্ট হয়। এই হিল পরে বড় বড় পা ফেলা সম্ভব না। ছোট পদক্ষেপে আরও মোহময়ী হলেন মহিলারা। গতি কমল, কিন্তু পুরুষদের মতিকে নিজের দেহের দিকে টানা গেল।
আরও পড়ুন- ছিল ধনীদের বিলাস! কীভাবে মধ্যবিত্ত মহিলাদের ‘জাতীয় পোশাক’ হয়ে উঠল নাইটি?
কর্মজীবী মহিলাদের কী হবে?
১৯৭০-এর দশকে একটি পাল্টা সংস্কৃতি আসে যা স্টিলেটোকে প্রত্যাখ্যান করে। এর অদ্ভুতুড়ে গড়ন, সহজে হাঁটাচলা না করতে পারা, সব কিছুর জন্যই সমালোচিত হতে হয় স্টিলেটোকে। কিন্তু ১৯৮০-র দশকে 'পাওয়ার ড্রেসিং’-এর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে স্বমহিমায় ফেরে স্টিলেটো। স্টিলেটোকে আরও আরামদায়ক এবং আকর্ষণীয় করা হয় যাতে এক বিশেষ শ্রেণির কর্মজীবী মহিলাদের কাছে তা চূড়ান্ত ফ্যাশন স্টেটমেন্টে পরিণত হয়।
পপ সংস্কৃতির ইতিহাসে স্টিলেটো
১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকের শুরুতে স্টিলেটো ফের ফিরে আসে 'সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি'-র হাত ধরে। আমেরিকার এই শোয়ের (যা ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত চলেছিল) ৯৪টি পর্ব জুড়ে স্টিলেটোর ব্যবহার একে আবার মূলধারায় নিয়ে আসে। স্টিলেটো ক্যাটওয়াকের প্রধান অংশ থেকে ধীরে ধীরে আমজনতার দুর্গাপুজোর ফ্যাশনেও ঢুকে যায়। যৌনতা এবং নারী- বিষয়টিকে গুলে মেখেই তো স্টিলেটোর জন্ম। দেহসৌন্দর্যের বাইরে কোনওদিনই মূলধারার ফ্যাশন তাকায়নি। স্টিলেটোও না।