৫০ বছর পেরিয়েও কমেনি ধার! কেন কোনও দিনই পুরনো হবে না মারীচ সংবাদ?
Marich Sangbad : পৃথিবীতে যতদিন রাজনীতি থাকবে, যতদিন যুদ্ধ থাকবে, ততদিন এই নাটক নিজের প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না।
একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক। বাংলা মঞ্চে চলা আর পাঁচটা লোকনাট্যকেন্দ্রিক নাটকের থেকে মারীচ সংবাদের মূলগত পার্থক্য কোথায়? অন্যান্য যে প্রচুর লোকনাট্যকেন্দ্রিক বা বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি আশ্রিত নাটক বাংলা মঞ্চে হয়ে চলেছে, তাদের মূল বক্তব্য হলো তারা বিলুপ্তপ্রায় লোকশিল্পকে বা হারিয়ে যাওয়া লোকসাহিত্যের অংশ উদ্ধার করে মানুষের সামনে নিয়ে আসছে। তবে এখানে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, একটি লোকশিল্পকে (যদি ধরেও নিই সেটি বিলুপ্তপ্রায়) তার যাপন থেকে, তার সামাজিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে একটি অন্য মাধ্যমে, একটি অন্য পরিবেশে, অন্য মানুষদের সামনে এনে ফেলে দিলেই কি সেই শিল্পের সঙ্গে সুবিচার করা হয়? প্রত্যেকটি লোকশিল্পের নিজস্ব শ্রেণি চরিত্র আছে। তাকে সেই শ্রেণি চরিত্র থেকে উচ্ছেদ করে আনলে হয়তো সেই নির্দিষ্ট শিল্প টিকেও গেল কিন্তু যে জনযাপনের ভিতর দিয়ে তার জন্ম, সেই যাপন আর টিকে থাকে না। ফলে সেই শিল্পের জন্ম দেওয়া মানুষদের আসলে ঠকানোই হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মারীচ সংবাদ’ কেন আলাদা, কোথায় আলাদা। ‘মারীচ সংবাদ’ আলাদা এর ফর্মের জন্য নয়, এর বিষয়ের জন্য। ‘মারীচ সংবাদ’ একটি লোকনাট্যের মোড়কে আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক নাটক। কেন একে রাজনৈতিক নাটক বলা হবে, তার ব্যাখ্যা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, এটি লেখা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়। দ্বিতীয়ত, এই নাটকে তিনটি কেন্দ্রীয় চরিত্র আছে যারা দেশ, কাল, সময়ের ভিন্নতাতেও একটি বিষয়ে গিয়ে মিলে যায়। এরা তিনজনেই নিজেদের অনিচ্ছায় কোনও না কোনও কাজ করে, বলা ভালো করতে বাধ্য হয়। ‘মারীচ সংবাদ’ রচনা, তার ফর্ম ও কন্টেন্ট নিয়ে তাই বিস্তারিত আলোচনা করা যায়।
১৯৭৩ সালের ১৬ জানুয়ারি কলামন্দিরের বেসমেন্টে নতুন নাট্যদল ‘চেতনা’র প্রথম নাটক ‘মারীচ সংবাদ’ অভিনীত হয়। আগেই উল্লেখ করেছি, নাটকের তিনটি গল্পের একটি অংশের মূলে আছে আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধ। অন্য একটি অংশে আছে বাংলার জমিদার জোতদারদের অত্যাচারের গল্প ও আরেকটি দিকে আছে রাবণ, কালনেমি ও মারীচের গল্প।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশ নিজের জায়গা ধরে রাখতে পেরেছে; পশ্চিমবঙ্গ পারেনি : কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
অরুণ মুখোপাধ্যায় ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট কো-অর্ডিনেশন কমিটির কনফারেন্সে মঞ্চস্থ করার জন্য একটি নাটক রচনার পরিকল্পনা করছিলেন। সেই সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছে। আরও একটি বিষয় ছিল, সেই বছর নাটকের জন্য কোনও অভিনেত্রীকে পাওয়া যায়নি, সুতরাং অরুণ মুখোপাধ্যায়কে এমন কোনও নাটক করতে হতো যাতে কোনও মহিলা চরিত্রই নেই। অরুণ মুখোপাধ্যায় সেইভাবেই পরিকল্পনা শুরু করলেন। এই সময়কালে একদিন হাওড়া শিবপুরে তাঁর বড় ছেলেকে (সুমন মুখোপাধ্যায়) রামযাত্রার আসর থেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে গিয়ে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের কানে আসে রামযাত্রার কালনেমির সঙ্গে মারীচের এক সংলাপ, “আমি কি রাবণের বেতনভুক কর্মচারী নাকি?” রাবণের বিরুদ্ধে মারীচের এই বিদ্রোহ থেকেই জন্ম হয় নাটক মারীচ সংবাদের। এই নাটক প্রথম রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট কো-অর্ডিনেশন কমিটির কনফারেন্সে মঞ্চস্থ হয়। পরবর্তীতে যখন চেতনা নাট্যদল গঠিত হয়, তখন তার প্রথম নাটক হিসেবে উঠে আসে ‘মারীচ সংবাদ’। অরুণ মুখোপাধ্যায়ই পরবর্তীকালে জানান, এই নাটকটি তৈরি করতে প্রাথমিকভাবে খরচ হয়েছিল ৭৫ টাকা। একটি সেকেন্ড হ্যান্ড বাংলা ঢোল কেনা হয়, একটি হারমোনিয়াম ভাড়া করা হয়, এমনকী পোশাকও ভাড়া করা হয়। সেট এবং প্ল্যাকার্ড তৈরি হয় পিচবোর্ড কেটে। এইভাবেই জন্ম হয় বাংলার অন্যতম সেরা নাটক ‘মারীচ সংবাদ’-এর। নাটকে মারীচের ঘরানার আরও দু'টি চরিত্র জন্ম নেয়, ঈশ্বর লেঠেল ও সাংবাদিক গ্রেগরি, যারা দু'জনেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এই নাটকের ফর্মের দিকে তাকালে তার মূলে পাওয়া যাবে রামযাত্রা অর্থাৎ লোকনাট্য। এই গোটা নাটকটাকে বেঁধে রেখেছে একটি চরিত্র - মাদারি কা খেলের ওস্তাদ। এই ওস্তাদের ওস্তাদিতেই বাকি চরিত্ররা তাদের কাজকর্ম চলে। এই মাদারির মধ্যেও ভারতের মাটির গন্ধ মিশে আছে। এই নাটকে দেশিয় ধারাকে জীবন্ত রেখে আধুনিক নাট্যভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
অরুণ মুখোপাধ্যায়ের অগ্রজ পুত্র, নাট্যব্যক্তিত্ব সুমন মুখোপাধ্যায় একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, মারীচ সংবাদের মূল যে কথা, সেটি হচ্ছে চাপের গুণকীর্তন। এটি সার্বিকভাবে একটি চাপের ইতিহাস। রাষ্ট্র বা ক্ষমতাবানদের যে চাপ, যা সব সময় নিম্নবর্গের বা সমাজের অন্যান্য স্তরের মানুষের উপর কাজ করে, এই নাটক সেটি নিয়েই। এই চাপ রাজনৈতিক চাপ হতে পারে, সামাজিক চাপ হতে পারে, সেই চাপের গল্পই মারীচ সংবাদ।
সুমন আরও বলছেন, নাটকের বিষয় এবং আঙ্গিক, দুটোকে আলাদা করার যে প্রথা, সেটি একটু পৌরাণিক মনে হয় এখন। দুটোকে এখন আলাদা করে দেখা যায় না কারণ এখন কন্টেন্ট বলা হয় যাকে, তার মধ্যেই ফর্ম বা আঙ্গিক ঢুকে থাকে। সুমনের মতে, মারীচের মাধ্যমে যে আধুনিক নাট্যমননের বিস্তার ঘটছে, সেটা কিন্তু পুরোটাই আসছে দেশজ লোককলার লোক-ভাব থেকে। মারীচ সংবাদের সংগীতে কীর্তনাঙ্গের গানের বড় ভূমিকা রয়েছে। মেরিবাবা সার্বিকভাবে একটি সাম্রাজ্যবিরোধী গান। কীর্তনের সুরে যে এরকম ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক কথা বলা যায় তা মেরিবাবার হাত ধরেই এসেছিল।
যদি একটু তলিয়ে ভাবা যায়, তাহলে দেখা যাবে তিনটি চরিত্র, মারীচ, ঈশ্বর লেঠেল ও গ্রেগরি, এদের প্রথম দু'জন সাবঅল্টার্ন, একজন তাড়কা রাক্ষসীর পুত্র, অন্যজন বংশানুক্রমিক লেঠেল। তৃতীয়জনকে সাবঅল্টার্ন না বলা গেলেও, সে অবদমিত তো বটেই। এই নাটকটির সবথেকে জোরের জায়গা হচ্ছে, নাটকটি ৫১ বছর আগেও যতটা গ্রহণযোগ্য, যতটা বাস্তবের কাছাকাছি, যতটা প্রাসঙ্গিক ছিল, আজও ঠিক ততটাই। সুমন মুখোপাধ্যায় বলছেন, মারীচকে কেন্দ্র করে যে আধুনিক নাট্যমনের বিস্তার ঘটেছে, তা সম্পূর্ণভাবে দেশজ ঐতিহ্যকে সামনে রেখেই। অরুণ মুখোপাধ্যায় নাটকটি রচনার বহু আগে থেকেই জানতেন তাঁর নাটকের বিষয়বস্তু হবে যুদ্ধবিরোধিতা। আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধ সেই সময়কার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির মধ্যে একটি। যেকোনও সচেতন শিল্পীর মতো অরুণ মুখোপাধ্যায়ও এই ঘটনাটিকে শিল্পে তুলে আনার চেষ্টা করেন। তবে এখানেই সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জটিও ছিল। যুদ্ধবিরোধিতা, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধ তো সম্পূর্ণই রাজনৈতিক বিষয়। যদি সেটিকে প্রোপাগান্ডা হিসেবেও দেখা যায়, তা নিয়ে কথা বলতে গেলে ব্যাপারটি খুবই সরাসরি হয়ে যায়। এই নিয়ে বক্তৃতার মাধ্যমেও কথা বলা যায়, প্রবন্ধ লিখেও বলা যায়। তাহলে একটি রাজনৈতিক ভাষণের থেকে একটি রাজনৈতিক থিয়েটার ঠিক কোন জায়গায় আলাদা হবে? সেটি আলাদা হবে অবশ্যই তার শিল্পগুণে, তার উপস্থাপনার ক্ষমতায় এবং তার ঘটনাগুলি দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে।
আরও পড়ুন- নাটকের চরিত্রের ফাঁসির বিরোধিতায় রাস্তায় মানুষ! কেন আজও পড়তেই হয় হুমায়ূন আহমেদ
নাটকটি যদি শুধুমাত্র ভিয়েতনাম যুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হতো, তাহলে তাতে গ্রেগরি চরিত্রটি এবং তার দ্বন্দ্ব থাকা স্বাভাবিক ছিল। বাকি দু'টি চরিত্র এবং তাদের দ্বন্দ্ব থাকা ততটা স্বাভাবিক ছিল না। এইখানেই অরুণ মুখোপাধ্যায় দ্বন্দ্বকে স্পেসিফিক বা ইনডিভিজুয়াল থেকে জেনারেল বা ইনক্লুসিভ করে দিয়েছেন। এখানে একটি উদাহরণ দিতেই হয়। ধরা যাক, শঙ্খ ঘোষের লেখা ‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতাটির কথা। কবিতাটি ব্যক্তি বাবরের পুত্রের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে দুশ্চিন্তার ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা হলেও, সেই কবিতাটি সার্বিকভাবে পিতাদের অপত্য স্নেহের কবিতা হয়ে ওঠে। কবিতাটি একস্বরীয় থেকে বহুস্বরীয় হয়ে ওঠে। ঠিক সেটিই ঘটিয়েছেন অরুণ মুখোপাধ্যায়, তাঁর মারীচ সংবাদ নাটকে। তিনি একটি চরিত্রকে এনেছেন আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষিত থেকে, একটি চরিত্রকে এনেছেন শিবপুরের রামযাত্রার আসর থেকে এবং একটি চরিত্রকে এনেছেন সামন্ততান্ত্রিক গ্রাম জীবন থেকে। এবার এই তিন চরিত্রের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বকে তিনি সাধারণের দ্বন্দ্বে বা গোষ্ঠীর সমস্যায় রূপান্তরিত করেছেন। চাপের মুখে পড়ে কোনও কাজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও করা যুগ যুগান্তর ধরে মানুষের ইতিহাসে চলে আসছে। যেমন রামায়ণের আমলে ছিল, ২০২৪-এ দাঁড়িয়েও তা বর্তমান। এই সত্যটি তিনি নিজের মুন্সিয়ানায় তিনটি চরিত্রের মধ্যে প্রতিস্থাপিত করলেন।
কিন্তু এখানে সব থেকে বড় সমস্যার বিষয়টি ছিল তিনটি চরিত্রকে এক সুতোয় গাঁথা। সেই কাজটি করার জন্য আরও একবার অরুণ মুখোপাধ্যায় হাত পাতলেন লোক সংস্কৃতির কাছেই। তুলে আনলেন ওস্তাদের মতো একটি চরিত্র। ওস্তাদ অর্থাৎ যিনি মাদারির খেলা দেখান, তার জাদুকাঠি ও ডুগডুগির নেশা ধরানো শব্দেই সেজে উঠল ‘ভানুমতির খেল’ মারীচ সংবাদের আখ্যান। এই ওস্তাদ সৃষ্টি করলেন এক অভিনয় বা খেলা দেখানোর পরিস্থিতি, যেখানে নাটকের মধ্যে একটি নাটক হতে থাকল এবং সেখানে অভিনয় করতে থাকলেন মারীচ, ঈশ্বর লেঠেল, গ্রেগরিরা। এর সঙ্গে অরুণ মুখোপাধ্যায় মেশালেন পয়ারের ছন্দ, কীর্তনের সুর, বাংলার দেশজ যন্ত্রসঙ্গীত। সবটা নিয়ে দেশিয় গন্ধ মেখে মারীচ হয়ে উঠল লোকাল থেকে গ্লোবাল।
মারীচ সংবাদ যখন লেখা হয় তখন তার পটভূমিকায় ছিল আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধ। আজ সেই যুদ্ধ নেই, কিন্তু আছে রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধ, আছে প্যালেস্তাইন ইজরায়েলের যুদ্ধ। এই কথা ফলিত সত্য যে যতদিন পৃথিবীতে যুদ্ধ থাকবে, ততদিন মারীচরা থেকে যাবে, ততদিন থেকে যাবে গ্রেগরিরা। একটি চারাগাছ তখনই মহীরুহে পরিণত হতে পারে যদি তার শিকড়টি মজবুত হয়। ভারতীয় সংস্কৃতির শিকড়টি হচ্ছে পুরাণ, মহাকাব্য। অরুণ মুখোপাধ্যায় সেই শিকড়ের কাছে গিয়ে তুলে এনেছেন রামায়ণের ধারাকে, তুলে এনেছেন প্রায় অবহেলিত একটি চরিত্র মারীচকে, যাকে আমরা কেবল সোনার হরিণের প্রসঙ্গেই মনে রেখেছি। এখানেই মারীচ সংবাদ অনন্য। বাংলায় লোকনাট্যের ধারা বহু বহু কালের এবং বাংলায় রাজনৈতিক নাটকের ধারাও অনেকদিনের। নীলদর্পণ, চাকর দর্পণ, গজদানন্দ, কারাগার থেকে শুরু করে ফেরারী ফৌজ, অঙ্গার, ব্যারিকেডের মতো নাটক বাংলার রাজনৈতিক নাটকের ধারাকে ঋদ্ধ করেছে। তবে এই ঘরানার নাটক, যেখানে লোকনাট্য এবং রাজনৈতিক বক্তব্য একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলে, তা বিরলতম। যেকোনও নাট্যকর্মীর রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে ধারণা পাল্টে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ‘মারীচ সংবাদ’ এবং এই নাটক শিখিয়ে যায় লোকনাট্যর আঙ্গিককে ঠিক কীভাবে মঞ্চে ব্যবহার করতে হয়। মারীচ নিজের পঞ্চাশ বছরের যাত্রাপথ অতিক্রম করে একান্ন বছরে পা দিয়েছে। পৃথিবীতে যতদিন রাজনীতি থাকবে, যতদিন যুদ্ধ থাকবে, ততদিন এই নাটক নিজের প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না।