৫১বর্তী - বাঙালির হারানো ৫১ পদ : স্বাদের শিকড় সন্ধানে এক সফর

Bangalir Harano 51 Pod Book Review : ইন্দিরার এই বই কোনও রেসিপির বই নয়, এমনকী হারিয়ে যাওয়া রান্নাকে ফেরানোর বইও না। লেখিকা রান্নার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা যাপনকে লিখেছেন।

রান্না বিষয়ক দু'টি কথা খানিক বড় হতে হতেই শুনেছিলাম। আমাদের বাড়িতে বরাবর রান্না করতেন বাবা, করতে ভালোবাসতেন। ভালোবাসা পরে 'কাজ' হয়ে যায়। রান্না নিয়ে অমন খুঁতখুঁতানি জন্মে দেখিনি! একবার তো চরম মরো-মরো দশা, ক্যান্সারে প্রায় শেষ। হাসপাতালের আইসিইউতে শুয়ে আছে অর্ধ অচেতন। আমি পাশে বসে। ওই ঘোর লাগা অবস্থাতেও বাবা বলেছিল, "আমি ফিরব বাড়ি। পটলের ঝোল করব, ভালো টমেটো আসবে এই সিজনে..."! অবাক হয়ে বুঝেছিলাম রান্না বিষয়ক প্রথম কথাটি। বাবাই বলত, রান্না আসলে এক শিল্প। মাপ করে কাটা, প্রতিটা তরি তরকারির আনাজ এক এক রকমভাবে কাটা, কতটা তাতে রং মিশবে, নুন না দিলে রং কেন খুলবে না, কেন গরম মশলা না দিলে সেই পদ পাতে দেওয়াই যাবে না- সমস্তটা শুনে মনে হতো রান্না আসলে ছবি আঁকার মতো, অথবা কোনও এক আলাপ গাওয়া, ধৈর্য ধরে। আর এই ছবি আঁকা হোক বা আলাপ ধরা, যত্নে উলকাঁটা বোনা হোক- এর এক ইতিহাস আছে। মানুষের আঙুলের ছাপ যেমন আলাদা আলাদা, কী আশ্চর্য প্রতিটা বাড়ির রান্নার স্বাদও আলাদা! কারণ প্রতি পরিবারের শিকড় মিশে রয়েছে রান্নায়। মিশে রয়েছে সেই শিকড় ধরে উঠে আসা মানুষদের দিন যাপন, সেই মানুষদের নানা টোটকা, ভালোবাসা। বড় সংসারে ধরানো উনোনের ধোঁয়ায় ভেসে সেই সব ভালোবাসার ঘ্রাণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বয়ে যায়। কিছু ঘ্রাণ হারায়, কিছু কিছু যত্নের তোরঙ্গে ভরে রেখে দেন কেউ কেউ। যেমন রেখে দিয়েছেন ইন্দিরা, ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। মান্দাস প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত তাঁর বই '৫১বর্তী - বাঙালির হারানো ৫১ পদ' আমাদের সেই শতাব্দী সফর করায়। সফর পথে আমাদের দেখা হয়ে যায় আশ্চর্য সব রান্নার সঙ্গে, আশ্চর্য সব নাম, আশ্চর্য সব উপকরণ আর আশ্চর্য সব ইতিহাস! ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের বই কোনও রেসিপির বই না, এক ভ্রমণকাহিনি বলা যায়, রান্নার শিকড় খোঁজার সফর।

রান্না বিষয়ক দ্বিতীয় কথা যেটা শুনেছিলাম তা হচ্ছে, মূলত দুই ধরনের মানুষ আছেন। একদল, বাঁচার জন্য খান, অন্যদল খাওয়ার জন্যই বাঁচেন। তবে পরে বুঝেছি, এই দুই দলের বাইরে বিবিধ শাখা প্রশাখাও আছে। সেই সব শাখা প্রশাখা ধরে রেখেছে যে মহীরূহ, সেইটিই হচ্ছে রন্ধনশিল্প। ইন্দিরা তাঁর বইয়ে এই শিল্পের সাতজন শিল্পীর কথা লিখেছেন। এই সাত শিল্পী ঘটনাচক্রে তাঁর আত্মীয়, তাঁর স্বজন এবং এরা প্রত্যেকে এক আস্ত বৃক্ষ। যার তলে বসেই ইন্দিরা শিখেছেন বাংলার প্রাচীন সব পদের ইতিবৃত্ত। জেনেছেন হারিয়ে যেতে থাকা রান্নাকে ফেরানোর মন্ত্র। এই সাত শিল্পী আসলে সপ্তকন্যা। লেখিকার ঠাকুমা সুহাসিনী দেবী, দিদা প্রতিভা মুখোপাধ্যায়, ঠাকুমাশাশুড়ি শিবরাণী দেবী, দিদিমাশাশুড়ি প্রতিভা বন্দ্যোপাধ্যায়, জেঠিমাশাশুড়ি শোভা দেবী, শাশুড়ি রেবা মুখোপাধ্যায় এবং মা কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়- এই শিল্পীদেরই বইখানি উৎসর্গ করেছেন তিনি। বইয়ের সূচিপত্র খুললেই অবাক হওয়ার পালা শুরু! সত্যি সত্যিই রান্নার পদ নাকি ঈষৎ মস্করা, মনে হতেই পারে! পাঠককে এখানেই বইটির গভীরে যেতে কৌতূহলী করে তোলেন ইন্দিরা।

আরও পড়ুন- মেমসাহেবের আবদার! সুলেখার ফিরিঙ্গি কালির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে বাংলার নাড়ির টান

শিউলিপাতার কাটলেট, পলতার বড়া, নিমঝোল, চালকুমড়োর শুক্তো, এঁচোড়ের গুলিকাবাব, ওলভাপা চিংড়ি, মুলোঘণ্ট- এমন ৫১ খানা হারানো পদের কথা লিখেছেন লেখিকা। পদের নাম শুনে অধিকাংশই অচেনা ঠেকাই দস্তুর! এমন রান্না আদৌ সম্ভব কিনা শঙ্কা জাগাও দস্তুর! শিউলিপাতা দিয়ে কাটলেট রান্না শুনে পাতা উল্টে তাই দেখতেই হয় বিষয়টা আসলে কী? কাঁঠালবিচির শশশড়ি বস্তুটাই বা কীভাবে সম্ভব- কৌতূহল তো জাগেই। কৌতূহলী পাঠককে এবার ইন্দিরা নিয়ে যান আরও গভীর সফরে। সেই শতাব্দী ভ্রমণ, সেই শিকড়ের সন্ধানে যাত্রা, সেই ইতিহাসের ঘ্রাণের উৎসের কাছে একবার নতজানু হয়ে বসা।

পদগুলি সাবেকি নিঃসন্দেহে। তবে সেই সপ্তকন্যার হাতের এক একটি পদ আসলে এক একটি যাপনের মতো। ইন্দিরা যেন প্রতিটি পদে কোথাও আবিষ্কার করছেন তাঁর বিধবা ঠাম্মাকে, আবিষ্কার করেছেন তাঁর ফেলে আসা পুতুলের রান্নাবাটির সংসার। কোথাও আবার ফিরে গিয়েছেন দিদিশাশুড়ির কাছে। দিদিশাশুড়ি আবার সেই পদ শিখেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর কাছে, সেই পদ তিনি শিখিয়ে গিয়েছেন ইন্দিরার শাশুড়িকে। কত কত যুগ পেরিয়ে, কত যুদ্ধ-স্বাধীনতা, সমাজ বদল পেরিয়ে শাশুড়ির ডায়রি থেকে সেই পদ ইন্দিরার হেঁশেলে ঠাঁই করে নিয়েছে এখন। পাঠক পাতা উল্টালেই সেই হেঁশেলের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবেন, দেখতে পাবেন কী মমতায় সেখানে এখনও রান্না হয়ে চলেছে ফিশ পুডিং, মাঝের পাতলা ঝোল অথবা তেতো শুক্তো!

ইন্দিরা তাঁর '৫১বর্তী - বাঙালির হারানো ৫১ পদ' বইতে মূলত ঘটিবাড়ির ঐতিহাসিক সব পদের গল্প বলেছেন, রয়েছে বাঙালবাড়ির পিঠে বা তিলপিটুলি বেগুনভাজার কথাও। অথচ লেখিকার ঠাম্মা আর দিদা, যাদের কথা তিনি বারেবারে উল্লেখ করেছেন এইসব পদগুলির শিল্পী হিসেবে, বিবাহসূত্রে গিয়ে পড়েন দুই পৃথক পরিবারে। ঠাম্মা পূর্ববাংলার খুলনার কন্যা, দিদা বরানগরের। ঠাম্মার বিয়ে হয় ঘটিবাড়িতে, দিদার বিয়ে হয় বাঙাল বাড়িতে। এই দুই পরিবারের মিশ্র রন্ধনপ্রণালীই জন্ম দেয় এক বিচিত্র ঘরানার। দুই বাংলার শিকড় এসে মিশে যায় যৌথ কড়াইয়ে, পাক দিতে দিতে উঠে আসা ঘ্রাণে ম্লান হয়ে যায় দেশভাগের গন্ধ। এই গন্ধের কথাই তো লিখেছেন ইন্দিরা। লিখেছেন মনসামঙ্গল থেকে শুরু করে অন্নদামঙ্গল এমন কী শক্তি চাটুজ্যের কবিতাতেও কীভাবে জায়গা করে নিয়েছে বাঙালির প্রাচীন সব পদ, বাঙালির সুপরিচিত খাদ্যপ্রীতি। শিউলি ফুল নিয়ে বাঙালির যত চর্চা, শিউলি পাতা ততটাই আড়ালে। অথচ কী মারাত্মক ঔষধিগুণ! এই গুণের হদিশ জানতেন মা-দিদিমারা। জানতেই বলেই বাড়িতে নিয়মিত রান্না হতো শিউলিপাতার কাটলেট। কীভাবে রান্না হতো? কীই বা এর গুণ? ইন্দিরা যত্নে লিখে রেখেছেন পাঠকের জন্য। বসন্তকালে হাওয়াবদলের সময় কীভাবে নিমঝোল হয়ে উঠত মহৌষধ, কীভাবে হারানো রুচি ফিরে আসত ঝকিতে- সাতক্ষীরার সেই হারানো রেসিপির সঙ্গে জুড়ে থাকা টুকরো টুকরো পাতাই যেন সেলাই করে গিয়েছেন ইন্দিরা।

পর্তুগিজরা না এলে যে বাঙালি শুক্তোতে আলু দিতেই শিখত না, অথবা দোলমা যে আসলে ইরাকের রন্ধনশৈলী, বা রাসবিহারী বসু না থাকলে যে জাপানিদের কাছে পাতলা মাংসের ঝোল কদরই পেত না, গল্পের ছলে সেই প্রসঙ্গও ছুঁয়ে গেছেন ইন্দিরা। ছুঁয়ে গেছেন সরস্বতী পুজোর পরদিন ঘটিবাড়ির গোটাসেদ্ধ খাওয়ার ইতিহাসকেও। ইন্দিরার এই বইয়ে উঠে এসেছে বাঙালি বাড়ির বিধবাদের হেঁশেল। উঠে এসেছে, সমাজের বিধি নিষেধে, বঞ্চনায় ক্ষয়ে যেতে যেতে, মাছ মাংস থেকে দূরে থাকতে থাকতেই কীভাবে বাঙালি বিধবারা উদ্ভাবন করে ফেলেন অসামান্য এক পদ! ঝালের ঝোল! মাছের বিকল্প হিসেবে কীভাবে ঠাঁই করে নিয়েছিল মটরডালের বড়া।

আরও পড়ুন- স্বাদের পাড়া ঘুরে স্মৃতির তর্পণ: শ্রীভোজনেষু রসেবশে রসনায়

বাস্তবিকই, ইন্দিরার এই বই কোনও রেসিপির বই নয়, এমনকী হারিয়ে যাওয়া রান্নাকে ফেরানোর বইও না। লেখিকা রান্নার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা যাপনকে লিখেছেন। সমাজ বিচ্ছিন্ন নয় সেই হেঁশেল, পারিবারিক রাজনীতি বর্জিত নয় সেই হেঁশেল। সেই হেঁশের কর্মীদের ঘামের কথা লিখেছেন ইন্দিরা, প্রতি কর্মী, প্রতি শিল্পীর নিজস্ব শিকড়ের কথা লিখেছেন। শিকড়ের গায়ে গায়ে লেগে আছে অঘ্রাণের বড়ি দেওয়া, লেগে আছে গরম ফ্যানা ভাত দিয়ে ব্রেকফাস্ট করার এক স্মৃতি মেদুরতা, রয়েছে নরম মাটির মতো লেপ্টে থাকা প্রাদেশিক বৈচিত্র্য। বাঙালির নিজস্ব রান্নাঘরে কীভাবে জায়গা করে নিল অ্যাংলোইন্ডিয়ান পদ বা মোগলাই খানা, সেই সূত্রও ধরিয়ে দিয়েছেন ইন্দিরা।

হিচকক-কে উদ্ধৃত করেছেন লেখিকা, তাঁর বইয়ে। “Happiness is a small house with a big kitchen”। এই বড় হেঁশেলেই তো এসে মিশেছে দুই বাংলার রান্নার কারিকুরি, মিশে গেছে ঔপনিবেশিকদের নানা কায়দা কানুন, মিশে গেছে নবাবি চাল, মোগলাই চলন। এই বড় হেঁশেলেই তো আমাদের মা-ঠাকুমারা জীবনের ৭০ শতাংশ কাটিয়ে হারিয়ে গিয়েছেন কোন এক মৃদু বাতাসে। কাটানো সেই জীবনগুচ্ছই মিশে রয়েছে আনাজে, মশলায়। বেছে বেছে কেনা সবজির গায়ে লেগে রয়েছে মায়ের জলভেজা হাতের ছাপ, বাবার ঘুমঘোরে বলে চলা টমেটোর তীব্র লাল রঙ লেগে রয়েছে ওভেনের আঁচে। আসলে খাওয়ার জন্য বাঁচা আর বাঁচার জন্য খাওয়ার বাইরেও রয়েছে আরও অনেকে। ইন্দিরা সেই মানুষদেরই একজন, তাঁর এই বই 'বাঙালির হারানো ৫১ পদ' সেই মানুষদেরই এক 'গাইডবুক'। জীবনের যে পথ হেঁশেল হয়েই পেরোতে হয়, সেই পথের দিশা দেখায় এই বই।

 

৫১বর্তী - বাঙালির হারানো ৫১ পদ
রান্নার বিবর্তন, রেসিপি ও রান্নাঘরের স্মৃতিকথা
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ- সুপ্রসন্ন কুণ্ডু
বিনিময়- ৩৫০/-

More Articles