বিপ্লব আর প্রেম রূপকথা নয়! রূপ-যৌনতার ঊর্ধ্বে 'রক্তকরবী'-র ভালবাসা
Red Oleandars: রঞ্জন আর নন্দিনী তো পরস্পর পরস্পরের রূপতরাসী যৌনশ্রমিক নয়।
গ্রামের ধারে বন। বনের লাগোয়া নদী। নদীতে নৌকো বাওয়ার প্রতিযোগিতা হয়। ছেলেরা একটি মেয়েকে জয় করার জন্য সেই নৌকা বাওয়ার প্রতিযোগিতায় দেখায় তাদের কৃৎকৌশল। যে মেয়েটিকে ঘিরে তাদের এই স্বাভাবিক উৎসাহ, সেই মেয়েটির নাম নন্দিনী। ছেলেরা তো অনেকে, তাদের মধ্যে দু'জনের নাম আমরা জানি– একজন রঞ্জন, অন্যজন বিশু। শেষ অবধি নন্দিনীর পাল্লা রঞ্জনের দিকেই ঝুঁকল।
তখন বিশু কী করল?
প্রেমে প্রাপ্য বস্তুর অপ্রাপ্তিতে পুরুষ বা নারীরা সচরাচর কী করে?
দু'টি বিকল্প প্রকট হয়। হতাশায় ডুবে যাওয়া কিংবা অপর কাউকে বিয়ে করে প্রত্যাখ্যানের বেদনা ভোলার চেষ্টা- এই তো পরিচিত দু'টি উপায়। এই দুই আসলে প্রত্যাশার অপ্রাপ্তিতে এবং প্রত্যাশিত বস্তুকে কেবল 'আমার, আমার, আমার' ভাবার ফলে ঘটে। বিশু দেবদাসের মতো হতাশায় ডুবে মাতাল হয়ে পড়ল না, তবে বিয়ে করল। যাকে বিয়ে করল, তার বস্তুপ্রপঞ্চর ওপর বড় লোভ– বিয়ে তার কাছে প্রেম-ভালবাসার ফল নয়, বিয়ে তার কাছে ‘চাই-চাই-এর’ সামাজিক, স্বীকৃত উপায়। বিশু চাকরি নিল খনি-শহরের প্রশাসনে। সেই চাকরি আড়ি পাতার, নজরদারির। রাজনীতির ভাষায় বললে, সে খোচড়। আর রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ভাষায় বললে গুপ্তচর। এতে টাকা আছে, কিন্তু আত্মসম্মান নেই, নৈতিকতাও নেই। তাই আত্মগ্লানিতে ভুগে বিশু চাকরি দিল ছেড়ে। তার বউয়ের বস্তুপ্রাপ্তিতে টান পড়ল। বর রোজগেরে নয় তেমন, বউটি বিদায় নিল। তখন বিশু একা, চাকরি নেই– খনি শহরে নিরুপায় থেকে যাওয়া আছে।
আরও পড়ুন: ‘প্রেম অতি হাস্যকর বস্তু’, কেন এমনটা মনে করতেন রাজশেখর বসু
সেই খনিশহরে এল নন্দিনী, আলাদাভাবে ঢুকল রঞ্জন। খনি শহরের অর্থনীতিকে তারা বিপর্যস্ত করে দিতে বদ্ধপরিকর। তাদের মধ্যে রয়েছে ভালবাসার টান– সেই টান রূপ-যৌনতার মাত্র নয়, সেই টান কর্মনীতির রূপায়ণের জন্য হাতে-হাত কাঁধে-কাঁধ রেখে লড়াইয়ের মানসিকতা থেকে জেগে ওঠে। প্রেম ও বিবাহ যেখানে কেবল রূপ-যৌনতার খেলা, সেখানে একসময় দম বন্ধ হয়ে যায়, অধিকারের, অধিকারের, অধিকারের প্রমত্ততা গ্রাস করে। তখন একই চাকায় পাক খাচ্ছে দু'জন– কিছুতেই চাইলেও বাইরে আসতে পারে না। ঠিক যেমন বাইরে আসতে পারে না সোনালোভী ওভারটাইম খাটা শ্রমিকরা, ঠিক তেমন বাইরে আসতে পারে না রূপলোভী প্রেমে কিংবা দাম্পত্যে আবদ্ধ যৌনশ্রমিকেরা।
রঞ্জন আর নন্দিনী তো পরস্পর পরস্পরের রূপতরাসী যৌনশ্রমিক নয়।
তারা তাই বাইরে আসে– ছড়িয়ে দেয় পারস্পরিক ভালবাসা, বৃহৎ কর্মপথে। রঞ্জন আর নন্দিনী একসঙ্গে হলেই বিপদ। তাদের মিলতে দিলে মনের আনন্দে পরস্পর-পরস্পরকে পেয়ে বিপ্লবাত্মক চিন্তা ছড়িয়ে দেবে খনি-শ্রমিকদের মধ্যে। তখন শ্রমিকরা আর কলুর বলদের মতো ওভারটাইমের চাকায় ঘুরবে না। তারা বলবে, টাকার জন্য বাঁচা নয়, বাঁচার জন্য টাকা। টাকা কত আর লাগে?
তার থেকে ঢের বেশি ভাল লাগে প্রয়োজনীয় উপার্জনের বাইরে বেঁচে থাকা সময়ে নিজের মতো থাকতে ও ভাবতে। একথা বললে খনি-শহরের লাভ কমে যাবে। তাই এজাতীয় কথা শেখায় যারা, সেই রঞ্জন-নন্দিনীকে আলাদা করে দাও– আঘাত করো। রঞ্জন খুন হলো। নন্দিনীকে বলাৎকারের পরিকল্পনা পাকা। তবে তা রূপায়িত করা গেল না।
নন্দিনীর একজন বিশু ছিল। রঞ্জনের কাছে হেরে যাওয়া, ঘা-খাওয়া বিশুর তখন বদল হয়েছে। সে জানে, নন্দিনী তার জমি-জিরেত নয়, অধিকারের ক্ষেত্র নয়– বস্তুত কারওরই জমি জিরেত নয় নন্দিনী, রঞ্জন বা বিশু। একসময় নন্দিনীকে না পেয়ে, ক্ষিপ্ত পৌরুষের অধিকারবোধ তৃপ্ত করতে চরের চাকরি নিয়েছিল বিশু। দাও-দাও-দাও বিবাহের সমাজ-স্বীকৃত জোয়ালে কলুর বলদের মতো ঢুকে পড়েছিল। এখন সেই অবস্থা ও অবস্থান থেকে দূরে এসেছে সে। বুঝেছে ভালবাসার নানা রূপ। নন্দিনীর সঙ্গে কর্মপথে এগিয়ে যাওয়াও তো ভালবাসাই। সে আর রঞ্জন, সে আর নন্দিনী কর্মপথে পারে মিলে যেতে। ঈর্ষার, অধিকারের, লড়াইয়ের, প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে সম্প্রসারিত হতেই পারে নানারূপী ভালবাসা।
ভালবাসা কি এক? তার যে নানা রূপ।
এক মানুষের জীবনেও কি একরকম থাকে ভালবাসার বোধ? সে বোধেরও তো রূপান্তর হয়।
ভালবাসা অভিযাত্রা, অভিযাত্রা বিপ্লবও।
যখন বিপ্লব পার্টি হয়ে যায় কিংবা বিপ্লব সংজ্ঞায়িত হয় একমাত্রায়, তখন বিপ্লব ভালবাসাকে ভয় পায়। ভালবাসার মধ্যে থাকে দুর্দান্ত এক চলার শক্তি। বিপ্লব যেমন প্রতি মুহূর্তে প্রশ্নশীল, তেমনই ভালবাসাও। একটা রূপে স্থির থাকে না সে। প্রশ্ন করতে করতে এগোয়। বিপ্লবের ঘর হয় না, ভালবাসারও কি হয়?
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকটিকে রূপক বলে ভাবতে ইচ্ছে করে না, রবীন্দ্রনাথও রূপক বলে ভাবতেন না। তাঁর মতে এ-নাটক সত্যমূলক। সত্য তো গাছের আম নয়। যেমন গাছের আম নয় বিপ্লব, যেমন গাছের আম নয় ভালবাসা। সত্য, ভালবাসা, বিপ্লব গাছের আমের মতো টুপ করে নিশ্চিন্ত কোলের ওপর খসে পড়ে না। তাকে প্রতি মুহূর্তে অর্জন করতে হয়– চলায়, উপলব্ধিতে। তা স্থির নয়। চলমান। আগে যা ভাবছি, তাতেই যে সে আটকে থাকবে- এমন তো নয়।
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকে তাই নন্দিনী, রঞ্জন, বিশু তিনজনেই চলেছে– ঘরে তো কেউ আটকে থাকেনি, চলার মানে চেয়েছে বুঝতে। রবীন্দ্রনাথ মিলনের নিশ্চিন্ততা তাদের দেননি– ভালবাসার কায়েমি নিশ্চিন্ততার চেয়ে তাঁর কাছে অনেক বড় না-পাওয়ার বেদনা। এই বেদনা গড়ে। যেমন গড়ে বিপ্লবের পথ। বিপ্লবের ঘর হয় না।
যে কবিরা বিপ্লবের, যে কবিরা প্রেমের, তারা কেউ দলের হতে পারে না– যে কবিরা দলের, দলের এবং দলের তারা কি প্রেমের কিংবা বিপ্লবের হতে পারে?
বিশুর কী হলো? নন্দিনীর? এই নাটকের শেষ একটা লড়াইয়ের খবর পাই, ফলাফল জানি না।
ফলাফল সুস্থির নয়, ফলাফল বদলায়। আজ একরকম, কাল আরেকরকম– ফলাফলের জন্য প্রতিনিয়ত সচেতনতা জরুরি। ফলাফলের সুস্থির রূপকথা হয় না, রূপকথায় তারপর চিরকাল তারা সুখে বসবাস করতে পারে– সেই চিরকালীন অধিকরণ স্বর্গের মিথ্যা স্বপ্ন।
বিপ্লব আর প্রেম রূপকথা নয়।
সত্য কি রূপকথা হতে পারে?
রূপকথার দিকে, রূপকথার জন্যই সত্য, প্রেম, বিপ্লবের যাত্রা– যাত্রা কিন্তু থামে না। সত্য চলে– প্রেম ও বিপ্লবও, কেউই রূপকথায় পৌঁছয় না।