প্রেমের রসায়নে কার হাত? হৃদয় না মস্তিষ্ক?

সে সব সময়ে বলে-কয়ে আসে না। বেশিরভাগ সময়েই আসে না জানিয়ে, ধীর পায়ে। কোথাও যেন পড়েছিলাম, সকালের নরম রোদের উষ্ণতা বা দূর থেকে ভেসে আসা রেডিওর গানের মতো ছোটোখাটো বিষয় জানান দিয়ে যায় সে এসেছিলো - প্রেম এসেছিলো, ধীর পায়ে ।

প্রেমকে বেশিরভাগ সময়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে হৃদয় দিয়ে, তবে আদতে প্রেম আদ্যপান্ত মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত, রাসায়নিক একটি ঘটনা। ল্যারি ইয়ং নেচার জার্নালে প্রকাশিত তাঁর এক আর্টিকলে লিখেছেন ভালোবাসা আদতে  নিউরোপেপটাইড এবং নিউরোট্রান্সমিটার দিয়ে তৈরি ককটেলের ক্রিয়াকলাপ।এবং বলা বাহুল্য নিউরোন বা নার্ভকোশ থেকে ক্ষরিত এই রাসায়নিকগুলি আদতে আদিম।

যদি আমাদের বিবর্তনের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই দেখতে পাবো এই রাসায়নিকগুলো কয়েক হাজার মিলিয়ন বছর আগে থেকেই আমাদের নিউরোন থেকে ক্ষরিত হচ্ছে, আমাদেরকে একে-অপরের সাথে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ করবে বলে, আমাদের সঙ্গী নির্বাচনে সাহায্য করবে বলে এবং শেষমেশ যৌনমিলনের পর অপত্যের জন্ম দিয়ে আমাদের জিনকে যুগের পর যুগ টিকিয়ে রাখবে বলে।

নিউরোসায়েন্টিস্ট আর্থার অ্যারন জার্নাল অফ পার্সোনালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সে লিখেছেন,  ভালোবাসা এমনকী কোনো অনুভূতিও নয়, এটি একটি মোটিভেশন সিস্টেম অর্থাৎ যার একটি প্রক্রিয়া যার ফলে আমরা নিজেদের নির্দিষ্ট চাহিদা এবং প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে এগিয়ে চলি। আর এই প্রয়োজনগুলির মধ্যে অন্যতম সঙ্গী নির্বাচন, একসাথে থাকা, প্রজনন ইত্যাদি।

মানুষ-সহ বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সমাজবদ্ধ থাকতে সাহায্য করে অক্সিটোসিন নামের নিউরোট্রান্সমিটার, যেটি তৈরি হয় পেপটাইড দিয়ে। পেপটাইড তৈরি হয় বেশ কয়েকটি অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে। অক্সিটোসিনই দু'টি কিংবা ততোধিক মানুষকে একে-অপরের কাছে নিয়ে আসে, তাদেরকে আবদ্ধ করে একসঙ্গে। এই নিউরোট্রান্সমিটারটির তাই গাল ভরা নাম রাখা হয়েছে "লাভ হরমোন"। দেখা যাচ্ছে যে সমস্ত মানুষ জানাচ্ছেন তারা প্রেমে পড়েছে, তাদের রক্তের প্লাজমায় বেশি পরিমাণে অক্সিটোসিন থাকে। শুধু তাই নয়, সঙ্গীরা যখন কোনো সম্পর্কে একসাথে থাকে, তখনও তাদের রক্তে অক্সিটোসিনের মাত্রা বেশিই থাকে এবং এদের ক্ষেত্রে প্রথম নয় মাস, অক্সিটোসিনের মাত্রা কমে না।

 সমাজবদ্ধ রাখা, সন্তান লালন-পালন করা, নিজেদের সামাজিক পরিচয় নির্ধারণ করতে সাহায্য করা ছাড়াও অক্সিটোসিন আরেকটি কাজে সাহায্য করে - তা হল যৌনতা বিষয়টিকে আরও সুন্দর করে তুলতে। অক্সিটোসিনকে যৌন হরমোন কখনোই বলা চলে না, কিন্তু এই নিউরোট্রান্সমিটার পুরুষদের লিঙ্গোত্থান থেকে শুরু করে, মহিলা ও পুরুষ দুইয়েরই অর্গ্যাজ়মে সাহায্য করে। সুতরাং প্রেমে যে শারিরীক চাহিদা তৈরি হবে, তা-ই স্বাভাবিক। প্লেটোনিক বলে দাবি করা প্রেম বা ভালোবাসা কতটা প্লেটোনিক আদতে, সে বিষয় নিঃসন্দেহে প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছে।

আরও মজার বিষয় হলো, অক্সিটোসিনের কারণেই সঙ্গীর উপর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে, নৈকট্য বাড়ে, আর তার উপর নির্ভর করেই কিন্তু দীর্ঘকালীন সম্পর্কের ভিত তৈরি হয়। দেখা যাচ্ছে, শারীরিক নৈকট্যের সময়ে মহিলাদের শরীরে তৈরি অক্সিটোসিনের কারণে মনোগ্যামাস বা একগামী সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে মহিলা ও তার সঙ্গীটির মাঝে। পুরুষদেহে ঠিক একই কাজ করে ভেসোপ্রেসিন নামের একটি নিউরোট্রান্সমিটার।

প্রেমিকযুগলের মধ্যে সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কের রসায়ন বদলাতে থাকে, তার জন্যেও দায়ী নার্ভ থেকে ক্ষরিত হওয়া এই রাসায়নিকগুলি। একাধিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্রেম বা ভালোবাসার প্রতিটি ধাপে আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ এবং বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটার আলাদা আলাদা ভাবে কাজ করে। দেখা যাচ্ছে প্রেমের প্রাথমিক ধাপে পস্টেরিয়ার সিঙ্গুলেট কর্টেক্সের বামদিকের অংশ এবং কডেট অংশ বেশি সক্রিয় থাকে; প্রেম যত পুরোনো হয় এই দুই অংশের সক্রিয়তা কমে যায় আগের তুলনায়। অন্যদিকে দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকে যে সমস্ত সঙ্গী, তাদের কর্টেক্সের এন্টেরিয়ার সিঙ্গুলেট, ইনসুলার কর্টেক্স, ভেন্ট্রাল প্যালিডিয়ামের মত অংশের।

তবে প্রেম দীর্ঘদিনের হোক, কী স্বল্প দিনের, প্রেমে ডোপামাইন নামের নিউরোট্রান্সমিটারটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রেমের ছোটো-বড় পাওনা গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে ডোপামাইন রিওয়ার্ড সিস্টেম। আমরা প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে সুন্দর সময় কাটালে ডোপামাইনের ক্ষরণ বাড়ে, এই ডোপামাইনই আবার  হ্যাপি হরমোন। প্রত্যেক সম্পর্কেই মেঘাচ্ছন্ন দিন থাকে, ডোপামাইন রিওয়ার্ড সিস্টেম সেদিন আমাদের পুরষ্কার বা রিওয়ার্ড দিতে পারে না। তবে দেখা যাচ্ছে ডোপামাইন রিওয়ার্ড সিস্টেমই আমাদের সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হবে নাকি ভঙ্গুর, তা ঠিক করে দেয়।

প্রেমের প্রথম ধাপে দেখা যাচ্ছে রক্তের প্লাজ়মায় কর্টিসল, বিভিন্ন সেক্স হরমোন ইত্যাদি বেশি থাকে। কর্টিসল স্ট্রেস হরমোন - এটি প্রকারান্তরে নিয়ন্ত্রণ করে হৃদপিন্ডের ওঠানামা, রক্ত চলাচল প্রভৃতি। সুতরাং, সেই বিশেষ মানুষটিকে দেখে বা তার কথা ভেবে বুক ধড়ফড় কেন করে তা আশা করি বোঝানো গেল। তাই প্রেম আদ্যপান্ত মস্তিষ্ক -নিয়ন্ত্রিত একটি বিষয় হলেও, হৃদয়ের উপর তার প্রভাব পড়ে বৈকি।

দেখা যাচ্ছে, সম্পর্কের সময় যত বাড়ে, অক্সিটোসিনের মাত্রা যত বাড়ে, স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা তত কমে। ভালোবাসায় থাকলে  ক্লান্ত-দগ্ধ দিনের শেষে শান্তি খুঁজে পাওয়া যায় বোধহয় এই কারণেই।

বস্তুত আমাদের সমস্ত অনুভূতি কতগুলি রাসায়নিকের খেলা মাত্র। কিন্তু সেই খেলাগুলো আছে বলেই পৃথিবীতে হিংসা, ক্রোধ, লালসার পাশাপাশি ভালোবাসা, মায়া-মমতা, স্নেহের মত সুন্দর জিনিস বেঁচে আছে, যতই তার কারণ চাঁচাছোলা বিজ্ঞান হোক না কেন। শোনা যায়, প্রেমে-ট্রেমে পড়লে না-কি আচ্ছা-খাসা বুদ্ধিমানেরও বুদ্ধিলোপ ঘটে। ও হ্যাঁ, আমাদের মস্তিষ্কের বিচার-বিবেচনা করার জন্যে দায়ী যে অংশগুলি তা একটু ঝিমিয়ে যায় বটে। গোঁয়ার-গোবিন্দ লোকেও বলে নাকি ভালোবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাবে, আর এসবের জন্যে তো এই নিউরো-হরমোনগুলিকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।

ভালোবাসার জন্যে হৃদয় দায়ী নয়, দায়ী মস্তিষ্কই। বিশুদ্ধ ভালোবাসা বলে কিছু হয় না। সবই নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের জিন, আমাদের বিবর্তনের ইতিহাস, সামাজিক ও পারিবারিক পরিকাঠামোর জন্যে তৈরি হওয়া জটিল মনস্তত্ত্ব। কিন্তু এত কিছুর পরেও, "আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি, কার তাতে কী?" শুভ প্রেম দিবস!

More Articles