যোগী টিচার, মিস্টার কিউকাম্বার ও প্রাগৈতিহাসিক

Philosophy of life : অনেক রাতে আরও দূরে মাদল বাজত। সদ্য ফাঁকা হয়ে যাওয়া আদিবাসী সে কুঁড়েঘরে একলা লম্ফ জ্বলে থাকত বোধহয়।

কেউ একটা, যাকে আমি কখনওই চিনিনি, আমার প্রতি অতি যত্নবান ছিল। না হলে আমায় নিয়ে গিয়ে বরবিলে কেনই বা ফেলবে? বা হয়তো ছিলেন, ফেলেছিলেন বলা উচিত। কারণ তাঁর কাণ্ড দেখে, আমার বদ্ধ ধারণা, তিনি প্রাগৈতিহাসিক। বা সিম্পলি, সময় বা এমন কিছুর ধরাছোঁয়ার বাইরে। মানে ওই যে রুক্ষ অথচ স্নিগ্ধ এক আশ্চর্য মোহনায় জল-হাওয়া পেল আমার সে কাল, অল্প অল্প করে একটি বুদ্বুদ সহোদর খুঁজে খুঁজে নিয়ে কোন যে কসমিক পরিকল্পনায় বুনতে থাকল এক জাতিস্মরের জীবন, তাও নির্ঘাৎ এই আজকের আমি’র কথা ভেবেই। অ্যাটলিস্ট আমি তাই মানি। যেন কেউ রোদের তীব্র চাহনি মাঝেও কোন নিরিবিলি থেকে মুঠোভর আড়াল-ছায়ার বন্দোবস্ত করে, বিঘেখানেক ওম পেতে প্রথমে আমায় ধাতস্থ হওয়ার নিদান দেয়, সরি দেন। প্রশ্রয়ও পাই তাঁর কাছে, আনমনা হওয়ার। তার পর তিনি এক বিলম্বিত লয়ে নিয়ে গিয়ে পালকের মতো ভাসিয়ে দেন আমায়। কোথায় যে, সে খেয়াল নেই। কিন্তু তন্দ্রাচ্ছন্ন সে সত্ত্বা আমার এটুকু টের পায়, যে আজ, ঠিক সে মুহূর্ত বড় কোমল, আরামের রাজধানী।

অমন মাহেন্দ্রক্ষণেই কি শিখিয়ে দেওয়া কর্তব্য নয়, অদৃশ্য প্রাগৈতিহাসিকের, অন্ত বলেও একটা নির্দিষ্ট অবস্থান থাকে। তা হয় আসে অকস্মাৎ বা ইনল্যান্ডে দিনক্ষণ খোদাই করে, কিন্তু সে আসে, এসে খুঁড়ে দিয়ে যায় এক অতল, তার পর বোধহয় বলে, 'যাও বাছা আজ ঘুমিয়ে পড়ো, কাল সকালে ফের স্কুল না…'

কিন্তু স্কুল গিয়ে বুঝি, যোগী টিচার নেই (নাম পরিবর্তন করলাম)। হাসিখুশি যোগী টিচার আমাদের ছোটবেলায় পড়াতেন। আর ছোটবলায় কী হয়, (অন্তত তখনকার ছোটবেলায় যা হত আর কী) আমরা করিডর বা মাঠ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়, কোনও স্যার বা মিস (সেন্ট মেরি’জ-এ আমরা মিস না বলে বলতাম টিচার) মুচকি হাসলে, মনে হত, চলো ডে ইজ মেড। কিন্তু যোগী টিচার সবসময়ই হাসছেন, গাল টিপে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছেন, কারওর অসম্ভব জরুরি নালিশ শুনছেন (সেকালে তো সব নালিশকেই অতি গুরুত্বপূর্ণ মনে হত আমাদের) বা ধরুন কোনও বাচ্চা হলুদ প্লাস্টিকের টিফিন বক্সের লাল ঢাকনা খুলে যেই না অপছন্দের শসা-টসা খাইয়ে দেওয়ার তাল করছে দূর দিয়ে দুলকি চালে হেঁটে যাওয়া আমাদের কনভেন্ট স্কুলের ফাদার/ব্রাদারের পোষ্য গরু কিংবা ঘোড়াকে (হ্যাঁ ঘোড়াও ছিল! বানিয়ে বলছি না), যোগী টিচার অমনি তাকে পাকড়াও করে, বাবা-বাছা করে ঠিক খাইয়ে দিচ্ছেন সে শসা, সাথে আবার গল্প-ও, যে মিস্টার কিউকাম্বার এক দিন নেচেকুদে কী কাণ্ডই না করেছিল! শসা বর্জনকারী তো ততক্ষণে মিস্টার কিউকাম্বারে বুঁদ আর টিফিনও সযত্নে পেট কে অন্দর।

যোগী টিচার তার পর হঠাৎ একদিন চলে গেলেন, স্কুল ছেড়ে। শোনা গেল বিয়ে। আমাদের বড় মনখারাপ হল। কিন্তু তাতে কী-ই বা আর আটকায়? টিচার তাঁর প্রায় হাঁটুর পিছন অবধি নেমে যাওয়া বিনুনি বাঁধা চুল নিয়ে আমাদের দিকে শেষবার হেসে আবছা হয়ে গেলেন। তারও কিছুদিন পর, এল সেই দিন, যে দিন গিয়ে শুনলাম যোগী টিচার নেই, যা দিয়ে প্রায় লেখার শুরু। শুনলাম, দিল্লি বা পাঞ্জাবের কোথাও একটা, (এখন আর ঠিক মনে নেই বা মনে রাখতেই চাইনি, হতেও পারে) সকাল বেলায় যোগী টিচারের বর, পুলিশ, অফিস বেরোবেন বলে রেডি হচ্ছেন, খাওয়ার টেবিলে লোডেড সার্ভিস রিভলভারটা রেখেছিলেন নাকি, যোগী টিচার বোধ হয় বর-কে টিফিন তৈরি করে দিচ্ছিলেন, পাশের বাড়ির একটি বাচ্চা খেলতে এসে, ওই রিভলভার দেখে উৎসাহ পেয়ে হাতে তুলে নেয়, নাকি, এবং ‘খেলাচ্ছলেই’ গুলি চলে যায়, যোগী টিচার আর কখনও আমাদের মিস্টার কিউকাম্বারের গল্প বলতে আসেন না।

আরও পড়ুন: স্টিল খোপ-থালা ও গোল্ড স্পট

মহান্তি আঙ্কলের এক ছেলের মৃত্যুর কথা জেনেছি, যোগী টিচার শূন্য হলেন, সিমলিপালের জঙ্গলে কারওর কথা না শুনে মত্ত অবস্থায় হুডখোলা একটা গাড়ি নিয়ে কেরামতি দেখাতে বা অন্য কোনও অজানা কারণে রাজ বা পদ্ম (নাম বদল করলাম) নেভি-তে কাজ করা যমজ ভাইয়ের এক জন ভাল্লুকের থাবায় অর্দ্ধেক খুলি হারিয়ে মারা গেলেন, এ সবের চেয়ে কত আগে বড় মামা মালগাড়িতে কাটা পড়ে চলে গেল। বা এখনও মনে পড়ে, রাদার শুনতে পাই, খানিক দূরের কোনও এক কুঁড়ে ঘর থেকে ছিটকে আসা প্রথম শোকের উচ্চারণ। মরাকান্না বলে তাকে, কলকাতায় এসে শুনলাম। আর কেন যে প্রায় প্রতিবারই ঠিক আলো পড়ে আসা আর আঁধার-শিশুর চোখ ফোটার সন্ধিক্ষণে শোকে মূহ্যমান এক আবহ ঘিরে ধরত আদিবাসী কোনও কুঁড়েঘরকে, আজও তল পাই না। অনেক রাতে আরও দূরে মাদল বাজত। সদ্য ফাঁকা হয়ে যাওয়া আদিবাসী সে কুঁড়েঘরে একলা লম্ফ জ্বলে থাকত বোধহয়। আরও কিছুটা দূরে, যেখানে সার্কাস এসে বিশাল তাঁবু খাটিয়েছে, আর যেখান থেকে প্রতিরাতেই পুকুর পেরিয়ে সিংহের ডাক শুনতে পেতাম, বাথরুম এলেই, সে রাতে ওই চৌহদ্দিও কোনও এক মায়াবলে অজানা এক কালেক্টিভ শোকজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ করত, নিশ্চিত।

Walking through a down memory lane journey of Barbil and phylosophy of life and death

তখন আর রাত আটটায় চিত্রহার দেখতেও ভাল লাগত না। অথচ আমার তো কেউ নন, হয়তো জীবনে কখনও দেখিওনি তাঁকে, যিনি মিলিয়ে গিয়েছেন সে কুঁড়ে ঘর থেকে। এবং ভেবে দেখুন, না ভাবলেও চলবে অবশ্য, আমি তো জানি, তখন চিত্রহার বা রবিবার সকালের রামায়ণ, বা হি ম্যান বা ভাস্কর ভট্টাচার্যের কুইজের শো, এই, এই তো অনন্ত কুয়োর জলে ভেসে থাকা আমাদের কয়েকটি স্বর্নিম ধুলোকণা। এমনও তো নয় যে আমি ছোট থেকেই কোনও বড় মানুষের মৃত্যুতে দূরদর্শনে তিন দিনব্যাপী যে জাতীয় শোক পালন হত, তাতে অহরহ বেজে চলা ভিজি যোগের বেহালায় মন্ত্রমুগ্ধ এক বালক? তবু কোন এক অমোঘ টানে আমি গিয়ে থিতু হতাম অপার নিস্তব্ধে। আদিবাসী অপরিচিতের প্রয়াণে। কেন? কী করেই বা। আজও রহস্য আমার কাছে।

নাকি এ সেই অজানা প্রাগৈতিহাসিকের আমায় যত্ন করে শেষ নামক অবস্থানের শিরা-উপশিরা বিলম্বিত লয়ে আত্মস্থ করিয়ে দেওয়ার ফল! এমন ভাবে ভাবীকালের অগুনতি নিশ্চিত নিথর-যাত্রায় শুধু মাত্র ফুঁপিয়ে, তার পরেই বিধ্বস্ততা অল্প সামলে কার্যক্রমের সমাপ্তি অবধি উপস্থিত থাকাই যে এক-একটা পর্বের প্রয়োজনীয় বিরামচিহ্ন, সে শিক্ষাকেই কি আজকের ভাষায় 'কামিং অফ এজ' বলে?


হ্যাঁ, প্রাগৈতিহাসিক?
আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করছি।
শুধু এ ভাবে মুচকি হেসে এড়িয়ে যাবেন না!

আচ্ছা এক মিনিট, তাই কি বরবিল ছেড়ে চলে আসার পর, কাঁকুড়গাছিতে যখন শেষবারের জন্যে বাবাকে নীচে শুইয়ে রাখা হল, আমি সাদা চাদরে ঢাকা বাবাকে দেখে প্রাণপণ কাঁদিনি! একটু জোর করেই, আমার কিছু আত্মীয়কে কাঁদতে দেখে, কেঁদেছিলাম?

কোনটা ঠিক কামিং অফ এজ, আজও খ্যাপার মতো খুঁজে ফিরি।

প্রাগৈতিহাসিক তিনি, আর একবার বাগে পেলে, বা বাগে পেতে চাইলে হয়তো মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝাতেন, যে প্রিয়, শোন, ও ভাবে পরশপাথর খোঁজে না। বৃথা। মনের মধ্যে এই যে তোর ছেড়ে আসা বরবিল নিয়ে ঘুরে মরিস তুই, খড়কুটো ভেবে আঁকড়ে ধরিস আনতাবড়ি, এলোপাথাড়ি, তাতে শেষমেশ শান্তি কি পাচ্ছিস? আরও উতলা, বিক্ষিপ্তই তো হচ্ছিস। তা বরং একটু যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে দেখ না, নিজের সঙ্গেই, নিজের মধ্যেই। লেট গো। তাকে বয়ে যেতে দে না সমান্তরাল হয়ে আপন ঘুরপথে। খ্যাপার অধিবেশনে বরং আজ অন্য শর্ট ওয়েভ ধর। একটা অন্য ব্যূহ রচিত হোক না। ধর একটু আলগা ভাবে। অতীব মনোনিবেশ করেই, কিন্তু মুঠির মাঝখান দিয়ে হাওয়ার স্রোত বয়ে যাওয়ার অবকাশ রাখ। বিশ্বাস রাখ, কক্ষপথে তোর সঙ্গে হয়তো আবার মিনিটখানেকের মোলাকাত হবে কোনওদিন, তোর ফেলে আসা চেয়ারের। লেট গো প্রিয়। যত কষ্টই হোক। লেট গো। আমি জানি, তুই বিশ্বাস করছিস না আমায়, আমি জানি তুই আপাতত পারবি না ছেড়ে দিতে এ খ্যাপামি, তবু বলি ফের… লেট গো।

আরও পড়ুন: ছোট টাউনের আশ্চর্য সেই হাওয়া

আচ্ছা, এক কথা শুধু ভাল লাগছে না শুনতে নিশ্চয়ই, অসুবিধে নেই, এক বার পারলে, রেললাইন পেরিয়ে, ঢাল বেয়ে উঠে, তুষারদের আগের বাড়ি পেরিয়ে, অদ্ভুত সুন্দর গাছে ঘেরা সেই মাঠটায় আসিস, যেখানে এখনও বেশ কয়েকটা রাবার আর ক্যাম্বিসের বল হারিয়ে আছে। মাঠে নেমে, ডায়গোনালি একটু হেঁটে ডান দিকে সেই বিশাল গাছটার নরম ছায়ায় থামিস, তুই তো জানিস, তার পর কী হয়!

না, অনির্বাণ?
আমি তোকে একটা প্রশ্ন করছি।
শুধু এভাবে চুপ করে এড়িয়ে যাবি?

More Articles